আবীরের চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী।
ছবি- বুড়ো সাধু
অভিনয়- ঋত্বিক চক্রবর্তী, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, দোলন রায়, ইশা সাহা, মিশমি দাস
পরিচালনা- ভিক
প্রাণীজগতে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক মানুষ ছাড়া আর কারও তেমন আছে কি? বাঘ-সিংহ-কুকুর-বেড়াল, প্রত্যেকেই মা’কে চেনে, বাবাকে নয়। নিজের বাচ্চার সঙ্গে হুলো বেড়ালের শত্রুতা আমরা কে না দেখেছি? একমাত্র মানুষের মধ্যেই কি তবে পিতৃত্বের প্রকাশ? তাই কি বিষণ্ণ বেদনার্ত মানুষের মনে হয়, ‘মনে হয় বাবা যেন ডাকছে আমায়/আয়...’। নতুন পরিচালক ভিকের প্রথম ছবি ‘বুড়ো সাধু’দেখতে দেখতে সন্তান আর পিতার সম্পর্কের সমীকরণ দর্শককে ভাবাবে। এখানে অবশ্য খুকুর বদলে খোকার গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আবীর(ঋত্বিক চক্রবর্তী) কীভাবে সময়ের সম্পাদ্য কষতে কষতে অসময় পেরিয়ে সুসময়ে পা রাখতে চায়, বিষাদের জলরঙে তার এক চমৎকার আলেখ্য বুনেছেন নবীন পরিচালক, যিনি এই ছবির কাহিনিকারও।
একদম শৈশবেই নিজের বাবাকে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল আবীর। দাদুর বাড়িতে জীবনের নতুন স্লেটে অ-আ-ক-খ লিখতে লিখতেই সে শুনেছিল যে তার বাবা আসলে ‘বাবা’নয়, একজন ‘দৈত্য’,যাকে ভুলে যাওয়াই দরকার। মায়ের নতুন স্বামীকে ‘বাবা’বলে চিনতে শেখে আবীর। কিন্তু ভুলিয়ে দিতে চাওয়া হয় যাকে, তাকে কি সত্যিই ভুলে যাওয়া যায়? নাকি সে নতুন বোতলের পুরনো জ্বালা হয়ে গলা বেয়ে নামতে থাকে বুকে, বুক থেকে পাকস্থলীতে, আর সেখান থেকে উঠে এসে আবারও লেগে থাকে চোখে?
‘বুড়ো সাধু’আসলে গড়িয়ে যেতে চাওয়া কান্নাকে চোখে ধরে রাখার এক অনুপম আখ্যান। ঋত্বিক চক্রবর্তীর অসামান্য অভিনয়ে অনায়াসে ফিরে যাওয়া যায় সেই শৈশবে, যেখানে পাড়ার একটা বা দুটো বাড়িতে টেলিভিশন সেট থাকত আর সারা পাড়া ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ত সেই বাড়িতে।
আরও পড়ুন-মুভি রিভিউ 'দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক': প্রিয়ঙ্কা লিখলেন গোলাপি আকাশ তৈরির গল্প
আবীরের মা চিত্রা(দোলন রায়) তাঁর নতুন স্বামীর(দেবেশ রায়চৌধুরী) সংসারেমুক্তির স্বাদ পেলেও, আবীর যেন ক্রমশ তলিয়ে যায় কোনও এক অচেনা মনখারাপের গহ্বরে। হ্যালুসিনেশনের চেহারা নিয়ে বারবার তার কাছে ফিরে আসতে থাকে এক অস্বস্তি, যার উৎস আবছা, পরিণতি অস্পষ্ট।
ছবির একটি দৃশ্যে ইশা এবং ঋত্বিক
এই যে এক ডিপ্রেশন যা ইদানীং কারণ-অকারণের বাইরে, দাঁড়িয়ে থাকে প্রায় প্রতিটি মানুষের মনের চৌকাঠে, তা এই ছবির অনেকটা জুড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। সে যেন এমন এক অন্ধকার, একশোটা রংমশাল জ্বালিয়েও যাকে শেষ করা যায় না, এমনই কুয়াশা, হাজার হেডলাইট জ্বালিয়েও দেখা যায় না যার ওপার।
নীলাঞ্জনার(মিশমি দাস) সঙ্গে প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার ধাক্কা, নীলাঞ্জনার নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অসদুপায় অবলম্বন এবং পরে আবীরের নামে পুলিশের কাছে নালিশ ঠুকে দেওয়া খানিকটা ‘ছকে বাঁধা’ঠেকে, সম্পর্কের গভীর জটিলতার আভাস যার মধ্যে পাওয়া যায় না। হয়তো আবীরের নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়ার দুর্বোধ্য তাড়নার একটা চালচিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন পরিচালক এখানে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ‘নীলাঞ্জনা’প্রথম প্রেমিকা থেকে খলনায়িকায় রূপান্তরিত হয়েছে প্রায়। কাহিনির একটা উপকারই কেবল করেছে ওই প্রেম বা প্রেমের মতো ব্যাপারটা, আবীরের বন্ধুদের আলোর আওতায় নিয়ে এসেছে। সেই বন্ধুদের মধ্যে কেউ বা হালকা টিটকিরি দেয়, কেউ অবহেলা, কিন্তু পুরো সময়টা বটের আঠার মতো একটা ঘন ভালবাসা দিয়ে আবীরকে ঘিরে রাখে বাঞ্ছা (অমিত সাহা)। এই ছোট কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিতে নজরকাড়া অভিনয় করেছেন অমিত। ঋত্বিক এবং তাঁর যুগলবন্দি কখনও-সখনও সৌমিত্র-রবি ঘোষকে মনে পড়িয়ে দেয়। বাঞ্ছার দৌলতেই আত্মহত্যাপ্রবণ আবীর বাংলা মেগাসিরিয়ালের জগতে প্রবেশ করে এবং হাওয়ায় শাটল ককের মতো ভাসতে ভাসতে এসে দাঁড়ায় সেই সান্ধ্য পৃথিবীতে, অবিমিশ্র বিনোদনের ভিতরে জীবন যেখানে বদ্বীপের মতো টিকে আছে। কিন্তু সুনামির ঝড় সেখান থেকেও ধুলোবালির মতো তাড়িয়ে নিয়ে যায় আবীরকে। ততদিনে ওর জীবনে এসেছে শ্বেতা(ইশা সাহা)। নীলাঞ্জনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে সে, যে বৈভবে নয়, অনুভবে পেতে চায়।
অভিনয়ে ঋত্বিক একাই একশো
কিন্তু মেগাসিরিয়ালের অবাস্তব পৃথিবী বাস্তবে যে রোজগার যোগাত তার কী হবে? হতাশা আর ব্যর্থ আক্রোশে তলিয়ে যাওয়ার জন্য যে বারের চার দেওয়ালটাকে নিজের যক্ষপুরী বানিয়ে নেয় আবীর, একদিন সেই কি ওকে রক্তকরবীর সন্ধান দিয়ে যায়? সেই রক্তকরবী কি একইসঙ্গে ফুল আর কাঁটা? সাফল্য এবং মৃত্য? প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে এবং কীভাবে সিনেমার শেষদিকে একটি নামহীন চরিত্রে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর আবির্ভাব ঘটিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দেন ভিক, আবিষ্কার এবং ধ্বংসকে দাঁড় করান মুখোমুখি, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য আপনাকে ‘বুড়ো সাধু’ সিনেমাটি দেখতে হবে।
সঞ্জীব ঘোষের ক্যামেরার এবং অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনায় একটি ‘মৌলিক’ বাংলা ছবি দেখার আবেশ মনে লেগে থাকবে। প্রাঞ্জল দাসের সুরে ও কথায় মনকাড়া কয়েকটি গান কানে লেগে থাকবে যার মধ্যে ‘জলে ঝাঁপাস না’ গানটা আর একটু দক্ষ কোনও কণ্ঠশিল্পী গাইলে মারকাটারি হত একদম। আলাদা করে বলতে হবে, টাইটেল ট্র্যাকে কবিতা ব্যবহারের অভিনবত্বের কথাও।
আরও পড়ুন-বৃদ্ধ দম্পতির একচালায় মেয়েকে গুড়-রুটি খাওয়ালেন অক্ষয়
অভিনয়ে ঋত্বিক একাই একশো, বাকিরাও যথাসাধ্য ভাল করেছেন। ‘বুড়ো সাধু’তাই পর্দা কিংবা মনে ভেসে থাকার মতোই একটা ছবি যার ‘শিরোনাম’টা অনুদিত হলেও যন্ত্রণাটা নয়। নবীন পরিচালক ভিককে অভিনন্দন, কারণ তিনি বোতলের দৈত্যটাকে বাইরে বের করে আনার সাহস দেখিয়েছেন বলেই আমরা আবারও দেখলাম, নেশার অনুবাদ দরকার হলেও, ভালবাসার অনুবাদ দরকার হয় না কারণ তার অক্ষরগুলো পৃথিবীর সব ভাষাতে একইরকম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy