Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Bohomaan

মুভি রিভিউ ‘বহমান’: শ্যাওলা সরিয়ে সম্পর্কের স্রোত

‘বহমান’ খুব তীব্রতার সঙ্গে আবিষ্কার করতে চেয়েছে মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের গভীরে, আরও গভীরে নেমে যাওয়া বড়শিতে টান লেগেছে অনুভূতির।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:৪৭
Share: Save:

অভিনয়: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু

পরিচালক: অনুমিতা দাশগুপ্ত

অনুমিতা দাশগুপ্তের ‘বহমান’ একটি সম্পর্কের ছবি। অবশ্য সে ভাবে দেখতে গেলে কোন সিনেমাই বা সম্পর্কের নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, মানুষের সঙ্গে বিশ্বজগতের। ‘বহমান’ খুব তীব্রতার সঙ্গে আবিষ্কার করতে চেয়েছে মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের গভীরে, আরও গভীরে নেমে যাওয়া বড়শিতে টান লেগেছে অনুভূতির। আর সেই হাওয়াতে রিনরিনে জেগে উঠেছে বেদনা।

মাধুরী (অপর্ণা সেন), তার ছেলে সুব্রত (ব্রাত্য বসু) আর জয়িতা (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের) সংসারে খুব সম্মানিত অতিথি হিসাবেই থাকে। কোথাও কোনও অবহেলা নেই। ছেলের বউ তাঁরই বান্ধবী নীলিমা (সোহাগ সেন)-এর মেয়ে। আর ছেলে তাঁকে চক্ষে হারায়। প্রতিটা মুহূর্তে মা কী করছে, মা সময়মতো খেল কি না? মায়ের ওষুধ, স্বাচ্ছন্দ্য এই সব দেখতে গিয়ে ছেলে যেন অতিরিক্ত পজেসিভ হয়ে পড়ে মায়ের ব্যাপারে। আর এখান থেকেই একটা জটিলতার শুরু হয়।

কারণ, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অদর্শনের পর মাধুরীর সঙ্গে পরিচয় তাঁর যৌবনের হার্টথ্রব সেলিম খানের। জনপ্রিয় অধ্যাপক সেলিম খানকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) অনেক মেয়েই ভালবাসত। এমনকি, তাঁর পুত্রবধূ জয়িতাও ছাত্রী থাকাকালীন সেলিম খানের প্রতি একটা চোরা টান অনুভব করত। তাঁর বৈদগ্ধ, ব্যক্তিত্ব এমনই যে তাতে আবিষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মাধুরীর সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছর দেখা না হওয়ার পর এই যে আবার দেখা হল, সম্পর্কটা যেখানে থেমে গিয়েছিল সেই একই জায়গা থেকে আবার চলতে শুরু করল। আর এখানেই সুব্রত এসে দাঁড়াল একটা পাহাড়ের মতো। এক দিকে সন্তান, আর এক দিকে প্রেমিক, মাধুরী যেন পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল।

ছবির একটি দৃশ্যে ব্রাত্য ও অর্পিতা।

সেলিম তাঁকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল কোনও পারিবারিক কারণে নয়। একটা কল্পবিপ্লবের ডাকে। সে বিপ্লব সফল হয়নি। কিন্তু বিপ্লবীদের অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে সফল হয়ে বিদেশে চলে গিয়েছে। আর কেউ কেউ মারা গিয়েছে অকালে। এই দুই পরিণতির কথাই মাধুরী সেলিমের সঙ্গে তাঁর সংলাপের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু এত দিন পর যখন আবার দেখা, তাঁরা কি পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে? সেলিম খানের এই ইচ্ছার কথা জেনে মাধুরীর মনের ভিতরেও তোলপাড় চলতে থাকে। কিন্তু এই পরিকল্পনা কি আদৌ সফল হবে?

আরও পড়ুন: কখনও গুগলি, কখনও বাউন্সার... স্বভাবোচিত সরস ভঙ্গিতে খোঁচা সোজাসাপটা দেবের!

মাধুরী আর সেলিমের এই যোগাযোগ সুব্রত একদমই পছন্দ করে না। এবং সেলিমের সঙ্গে মাধুরীর এই সম্পর্ক ঘিরে সুব্রতর হতাশা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে মদ ক্রমে গ্রাস করে ওকে। মানুষের সঙ্গে ওর দুর্ব্যবহার ক্রমে বাড়তে থাকে। আর তা এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে ওর স্ত্রী জয়িতা ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। সুব্রত নিজের একটা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে থাকে সেলিম খানকে। প্রাণপণ চেষ্টা করে মায়ের জীবন থেকে সেলিম খানকে সরিয়ে দিতে। আবিষ্কার করতে থাকে সেলিম আর মায়ের জীবনের রসায়নটা কী? সেই খোঁজে সেলিমের বাড়িতেও হানা দেয় ও।

ছবির দৃশ্যে সৌমিত্র ও অপর্ণা।

সেলিমের বাড়িতে তাঁর পরিচালক দোলা কিংবা দুলাল (গৌতম হালদার) অভিনয়ের চমৎকারিত্বে আপ্যায়ন জানায় ওকে। লাল ডায়েরিটা ও নিয়ে এসেছিল। পিকনিকে সেলিম খানকে কে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাই নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে ও। ওর একমুখী ইচ্ছে, মা যেন কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মা’কে এ ভাবে আটকে রাখতে চাওয়ার মধ্যে যে ইডিপাস কমপ্লেক্স তা কোথায় ঠেলে নিয়ে যায় সুব্রতকে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর মায়ের জীবনের অতীত খুঁজতে গিয়ে তা যেন অনেক অজানা রং নিয়ে ডানা মেলে সুব্রতর জীবনে।

আরও পড়ুন: ৮৫ বছর বয়সে বলি ডেবিউ, চিনতে পারছেন এই ‘কাবারিওয়ালি দাদি’কে!

এর আগে অবশ্য সেলিম খানকে মারার জন্য সুপারিও দিয়ে ফেলেছে কোনও এক বাচ্চুভাইকে। কিন্তু সেলিম খানের শেষে কী হয়? সুব্রত অতীতের এমন কোন রসায়ন আবিষ্কার করে ফেলে যে সেলিম খান হয়ে পড়ে সুব্রত আর মাধুরীর মধ্যেকার এক সেতু? ‘বহমান’ যেন তারই আবহমান এক সন্ধান। সম্পর্কের এই গল্প স্বাভাবিক ভাবেই খুব দ্রুতলয়ের নয়। কিন্তু সংলাপের তীব্রতায় ও এক অদ্ভুত জাম্পকাটে অনুমিতা দাশগুপ্ত তাকে সাজিয়েছেন খুব নিপুণ ভাবে। একটু ভিন্ন ধরনের ছবি দেখতে যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের ভাল লাগবেই এই ছবি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্বকীয় উপস্থিতিতে উজ্জ্বল। তবুও তাঁর নড়াচড়া, কথাবার্তায় কিছুটা বয়সের ছাপ পড়েছে আর তা অবশ্যই কাম্য। অপর্ণা সেন তাঁর নিচু চাবির অভিনয়ে অনবদ্য। তবে এই সিনেমায় সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ব্রাত্য বসু। বাংলা নাটকের কিংবদন্তি যে সিনেমার অভিনয়েও অনবদ্য সুনিপুণ এক শিল্পী, ‘বহমান’ তারই এক স্বাক্ষর রেখে গেল। অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ও অসাধারণ। তাঁর সহজাত অভিনয় শৈলির পরিচয় এখানেও সুস্পষ্ট। স্বল্প দৈর্ঘ্যের চরিত্রে সোহাগ সেন, গৌতম হালদার অনবদ্য। ছোট্ট একটি চরিত্রে নজর কেড়েছেন অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। ক্যামেরার কাজ যথাযথ। গানের ব্যবহার খুবই স্বল্প। এই সিনেমার শেষটায় একটা ওপেন এন্ডিং রেখে পরিচালক অনুমিতা দাশগুপ্ত যেন দর্শককে ভাবার একটা পরিসর দিয়েছেন। বহু দিন বাদে একটা বাংলা ছবি দর্শককে ভাবার সুযোগ দিয়ে গেল, নয়তো প্রায় সব কটাই তো স্ট্রাইকার ছাড়াও ক্যারমের ঘুঁটিগুলো সবকটাই পকেটে ফেলে দেওয়ার মতো। যে সেতু হয়তো মাধুরী, সুব্রত আর সেলিমের মধ্যেও গড়ে উঠল কি না জানার জন্য দর্শককে ছবিটা পুরোটা দেখতে হবে আর দর্শক ও ছবিটার মধ্যে সেই সেতু গড়ে উঠবে। ‘বহমান’ দর্শকের মনের মধ্যে বহতা থাকবে অনেক দিন।

অন্য বিষয়গুলি:

Bohomaan Movie বহমান
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE