‘উরি’তে ভিকি, ‘তানাজি’তে অজয় ও ‘পানিপত’-এ অর্জুন
হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের ফরওয়ার্ডেড মেসেজ, যেখানে কোনও নতুন-পুরনো ঘটনার বর্ণনা বা ভাইরাল হওয়া ভিডিয়ো... এগুলোর সত্যাসত্য কতটা? আমরা জানি না, হয়তো বা জানতেও চাই না। সকলেই যখন একই জিনিস শেয়ার করছে, তখন মনে হয়, ওটাই সত্যি। অথচ সকলেই জানে, মগজ ধোলাইয়ের স্বার্থে তথ্য বিকৃতও করা হয়। তবুও ওই মেসেজ বা ভিডিয়োগুলো প্রচারিত হতে থাকে। একই কথা বোধহয় সিনেমার ক্ষেত্রেও খাটে। একাধিক ছবিতে একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে দেখতে সেটাই বাস্তব মনে হতে পারে। ঘটনাচক্রে সেই একপেশে ছবিগুলোই রমরমিয়ে চলে বাজারে।
বলিউডের সাম্প্রতিক কিছু ছবিতে ইসলামোফোবিয়ার ছাপ স্পষ্ট। হিন্দুত্ববাদকে তোল্লাই দিতে গিয়ে অন্য জাতিকে কোণঠাসা করার অভিপ্রায় কি আমাদের একচোখো করে দিচ্ছে না? কিছু দিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন পরিচালক কবীর খান। সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদে তিনিও শামিল। তাঁর ছবিতে একাধিক বার রাজনীতি উঠে এসেছে। আনন্দ প্লাসের সাক্ষাৎকারেই সাম্প্রতিক কিছু হিন্দি ছবির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কোন ছবিতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হচ্ছে, তা বুঝতে গেলে রাজনৈতিক সচেতনতা প্রয়োজন। যদি পরপর তিনটে ছবিতে দেখানো হয়, মুঘলরা আমাদের শত্রু ছিল, তা হলে চতুর্থ ছবিতে তো মনে হতেই পারে, হ্যাঁ, মুঘলরা তো ভিলেনই! কেউ পাল্টা প্রশ্ন তুলবে না। এখন লোকে হোয়্যাটসঅ্যাপে আসা তথ্যকে সত্যি বলে ধরে নেয়। এতে ইতিহাস এবং সত্যি তো বিকৃত হবেই।’’
গত বছরের শেষে মুক্তি পেয়েছিল আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘পানিপত’। ইতিহাস-নির্ভর ছবিতেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছিল। হিন্দু জয়গাথা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মুঘলদের নিকৃষ্ট প্রমাণের তাগিদ ছিল সেখানে। অথচ এই পরিচালকই ‘জোধা আকবর’ বানান। সেখানে কোনও ধর্মকে নিচু দেখানোর প্রয়াস ছিল না। হয়তো যুগের হাওয়ায় ছবির গতিপথও বদলে যায়! ‘পানিপত’ বক্স অফিসে সফল হয়নি কিন্তু মরাঠা সাম্রাজ্যের জয়ধ্বজা ওড়ানো ছবি ‘তানাজি: দি আনসাং ওয়ারিয়র’ এ বছরের অন্যতম সুপারহিট। সেখানেও একই প্রয়াস, একপক্ষকে নিচু দেখিয়ে অন্য পক্ষকে তোল্লাই দেওয়া। বিকৃত জিনিস সহজেই বিক্রীত। যেমন অক্ষয়কুমারের ‘কেশরী’। সুপারহিট এই ছবিতে ব্যাটল অব সারাগরহিকে অন্য আঙ্গিকে পেশ করা হয়। ছবিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ইতিহাসবিদরা।
বলিউডে যে এখন প্রোপাগান্ডা ফিল্মের ট্রেন্ড, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সেলফি ব্রিগেডের অভিনেতারা সে সব ছবির নিয়মিত মুখ। কিন্তু এই ট্রেন্ড কি একেবারেই নতুন? যত বার ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে, তত বার সেই সংক্রান্ত ছবি তৈরি হয়েছে বলিউডে। ‘বর্ডার’, ‘এলওসি কার্গিল’, ‘গদর’... তালিকা দীর্ঘ। সাম্প্রতিক উদাহরণ ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’। আতঙ্কের বিষয়, একপক্ষকে গ্লোরিফাই করতে গিয়ে আমরা পাশের ঘরের মানুষটাকেই হয়তো নিশানা করে ফেলছি।
সম্প্রতি শহরে এসে পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ বলেছিলেন, ‘‘প্রোপাগান্ডা ছবি আগেও হয়েছে। সেখানে হয়তো এত উগ্রতা ছিল না। এখন এগুলোকে মদত দেওয়া হচ্ছে।’’ হালফিলের ছবিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রদর্শন নিয়ে কবীরের বক্তব্য, ‘‘এই ছবিগুলো তৈরি হচ্ছে, কারণ তা আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে। ইসলামোফোবিয়ার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে... রাইট উইং ন্যারেটিভ ইজ় বিয়িং পুশড। ছবিতে তাই প্রতিফলিত হচ্ছে।’’ অক্ষয়কুমারের ‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’, ‘মিশন মঙ্গল’ কেন্দ্রীয় সরকারের জয়গাথা মূলক ছবি। এই ধরনের ছবিতে হয়তো উগ্র মতাদর্শ ফুটে উঠছে না, কিন্তু জনমত প্রভাবিত করার ক্ষমতা অবশ্যই রাখে।
দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনা কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যত আমরা মেরুকরণকে প্রশ্রয় দেব, তত নিজেদেরই কোণঠাসা করতে থাকব। এখন বলিউড তার কক্ষপথ বদলাবে কি না, সে জবাব ভবিষ্যৎ দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy