Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

শাড়ির সেঞ্চুরি

গুনে গুনে একশোটা শাড়ি পরুন। আর সেই ছবি পোস্ট করুন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটাই ট্রেন্ড। লিখছেন পরমা দাশগুপ্তজিন্‌স-টপ-কুর্তির ভিড় ঠেলে ফের শাড়ির তাকে চোখ। ঠিক সেটাই তো চেয়েছিল ‘১০০ শাড়ি প্যাক্ট’। আর চেয়েছিল, ফিরে আসুক শাড়ির ঐতিহ্য, ফিরে আসুক হারাতে বসা নানা প্রদেশের শাড়ি। বাঙালিয়ানার দিনগুলো ছাড়া যাঁদের রোজকার জীবনে শাড়ির নামগন্ধই হারিয়ে যাচ্ছিল প্রায়, বা যাঁরা ইচ্ছে থাকলেও ঠিক শাড়িটা পরে উঠতে পারেন না, আলমারিতে শুধু জমতে থাকে নতুন শাড়ির পাহাড়— তাঁদের জন্যই আচমকা এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন অঞ্জু মুদগল কদম এবং অ্যালি ম্যাথান।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

‘বাঃ, দারুণ দেখাচ্ছে তো তোকে আজ! শাড়ি পরলেই পারিস, বেশ দেখায় কিন্তু।’

‘তাই? তা হলে ছবি তুলে দে একটা, ফেসবুকে দিই!’

পথেঘাটে একটু চোখ রাখুন। শাড়িতে ঝলমলে বাঙালি কন্যের ভিড়টা কি একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছে ইদানীং? বেড়েছে। সৌজন্যে সোশ্যাল মিডিয়া।

কেন এমন, কবে হঠাৎ...

জিন্‌স-টপ-কুর্তির ভিড় ঠেলে ফের শাড়ির তাকে চোখ। ঠিক সেটাই তো চেয়েছিল ‘১০০ শাড়ি প্যাক্ট’। আর চেয়েছিল, ফিরে আসুক শাড়ির ঐতিহ্য, ফিরে আসুক হারাতে বসা নানা প্রদেশের শাড়ি।

বাঙালিয়ানার দিনগুলো ছাড়া যাঁদের রোজকার জীবনে শাড়ির নামগন্ধই হারিয়ে যাচ্ছিল প্রায়, বা যাঁরা ইচ্ছে থাকলেও ঠিক শাড়িটা পরে উঠতে পারেন না, আলমারিতে শুধু জমতে থাকে নতুন শাড়ির পাহাড়— তাঁদের জন্যই আচমকা এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন অঞ্জু মুদগল কদম এবং অ্যালি ম্যাথান।

২০১৫-র শুরুর দিক। দক্ষিণী দুই বন্ধু গল্প করতেই করতেই এক দিন খেয়াল করলেন, দু’জনের ওয়ার্ড্রোবেই অসংখ্য ভাল-লাগা শাড়ির ভিড়, যার বেশির ভাগই শেষ কবে পরেছেন মনেই পড়ে না। দুঃখই হল খানিক। সেই আড্ডাতেই ঠিক করে ফেললেন, এই ২০১৫-তেই ১০০ দিন শাড়ি পরবেন। ফিরে দেখবেন প্রতিটা শাড়িতে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলোও। কিন্তু শুধু তাঁরাই বা কেন? দেশজোড়া মেয়েদেরই তো এমন গল্প আছে।

ব্যস! দুই কন্যের উদ্যোগেই নেট দুনিয়ায় হাজির 100sareepact। এই বিপ্লবের অংশীদার হতে গেলে বছরে ১০০ দিন পরতে হবে নানা ধরনের শাড়ি। একই শাড়ি একাধিক বার পরাও চলবে। আর প্রতিটা শাড়ি পরা ছবি দিতে হবে ফেসবুক বা ইনস্ট্যাগ্রামে। সঙ্গে সেই শাড়িতে জড়িয়ে থাকা গল্প, স্মৃতি বা ভাল-লাগা। এবং শাড়ি-চুক্তির এই হ্যাশট্যাগ। যাতে গোটা দুনিয়া একসঙ্গেই খুঁজে পায় শাড়ি-বিপ্লবের নারীদের।

১০০ দিনের শাড়ি

সেই শুরু। অঞ্জু-অ্যালির ইচ্ছেপূরণ হতে সময় লাগেনি তেমন। হুড়মুড়িয়ে ১০০ দিনের শাড়ি-বিপ্লবে ঢুকে পড়তে লাগলেন অচেনা-অজানা নারীরা। বাংলা তো বটেই, সাড়া মিলল গোটা দক্ষিণ ভারত, মহারাষ্ট্র, বিহার, রাজস্থান, সর্বত্রই। পথেঘাটে স্বচ্ছন্দে চলা যায় না, পরাটা বড্ড গোলমেলে, এর চেয়ে অন্য পোশাক পরা সহজ— সব যুক্তিকে স্রেফ দশ গোল দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সদর্পে ফিরে এল শাড়ি। ফের শাড়ি পরার জন্যই এখন রোজ তৈরি হয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট উপলক্ষ। সাক্ষী ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম।

এবং বঙ্গনারী

‘‘কিছু দিন হল ফেসবুক খুললেই দেখছিলাম, হান্ড্রেড শাড়ি প্যাক্ট-এর ছবি। রোজই কেউ না কেউ নতুন যোগ দিচ্ছেন। মনে হল, আমিই বা পরব না কেন? শাড়ি তো বাঙালির ঐতিহ্যই, যা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের কল্যাণে। সেটা ফিরে এলে তো ভালই। গত সপ্তাহে তাই আমিও নাম লিখিয়েছি এই প্যাক্টে,’’ সাতাশের রোহিণীর গলায় উচ্ছ্বাসের সুরটা স্পষ্ট।

সুযোগ পেলেই শাড়ি কিনে ফেলেন পঁয়ত্রিশের অরুন্ধতী। শাড়ি পরতে ভালওবাসেন যথেষ্টই। তবু পরা হয়ে ওঠে কই? ‘‘শাড়িগুলোও পরা হচ্ছে, নিজেদের সংস্কৃতিকে গোটা দুনিয়ার কাছে তুলে ধরার সুযোগও মিলছে। সারা দেশের অনেকের সঙ্গে এই বিপ্লবে আমিও আছি, ভাবতেও তো ভাল লাগছে।’’

আশার আলো

ডিজাইনার অভিষেক দত্ত যেমন বলছেন, ‘‘ভারতীয় মেয়েদের শাড়িতেই সবচেয়ে ভাল দেখায়। আজকালকার মেয়েরা যে কারণেই শাড়িকে দূরে ঠেলে রাখুক, ফেসবুকে ট্রেন্ড হয়ে যাওয়ায় সেটাতে পা মেলাতে তারাও পছন্দ করছে। আর উদ্দেশ্য যখন আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা, কমবয়সিদের মধ্যে ফের শাড়ির সাজ ফিরিয়ে আনা, হারিয়ে যাওয়া নানা ধরনের শাড়িকে ফ্যাশনে ফিরিয়ে আনা—এই উদ্যোগটাকে সাধুবাদ দিতেই হয়।’’

আশাবাদী শাড়ি ব্যুটিকের কর্ত্রী মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ‘‘শাড়ি না পরাটা আসলে একটা ভিশ্যাস সার্কেলের ফলাফল। আপনি ভাবছেন শাড়িতে স্বচ্ছন্দ হবেন না, তাই পরেন না। আর পরেন না বলেই স্বচ্ছন্দ হওয়াটা শেখা হয়ে ওঠে না। আর এটা তো শুধু কমবয়সিদের শাড়িতে ফিরিয়ে আনা নয়, বড়দেরও আলমারি ঘেঁটে শাড়িগুলোকে ফের আলোয় ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টাও বটে। কিনে ফেলে রাখা শাড়িগুলোর সদ্ব্যবহার হবে, এটা ভাবতেও কিন্তু দারুণ লাগছে।’’

চলো শাড়ি কিনি

দেশ জুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া শাড়ি-বিপ্লবের রেশ কিছুটা পৌঁছে গিয়েছে কেনাকাটাতেও। অন্তত তেমনটাই আঁচ পাচ্ছে কলকাতার শাড়ি বিপণিগুলোও। ক্রাফ্টস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার এক শাড়ি বিপণি-কর্ত্রী কস্তুরী গুপ্ত মেনন যেমন জানালেন, তাঁদের বিপণিতে নানা প্রদেশের শাড়ি কেনার চাহিদা বেড়ে গিয়েছে ইদানীং। নানাবয়সিদের ভিড়ে এ প্রজন্মের মেয়েরাও আছে যথেষ্টই।

ভিন্নমত যাঁরা

ভাবছেন তবে এ বিপ্লবে পুরোটাই জিতে যাওয়ার গল্প?

তেমনটা কিন্তু নয়। অন্য রকম ভাবার দলেও আছেন কেউ কেউ। যেমন, বছর আটত্রিশের জয়িতা। ফেসবুকে নেই।
তবে খবরাখবর রাখেন সোশ্যাল মিডিয়ার সব কিছুরই। বললেন, ‘‘এ ভাবে কি শাড়িকে ফেরানো যায়? ফেসবুকে ট্রেন্ড, তাই হুজুগে মেতে শাড়ি পরা চলছে। হুজুগ ফুরোলেই আবার স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাকে ফিরে যাবে অনেকেই। সেটাই দস্তুর। আর সংস্কৃতি তো স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে তাল মেলানোর কথাও বলে। বিয়েবাড়িতে-পুজোয় সেজেগুজে শাড়ি পরতে ভালই লাগে, কিন্তু রোজকার কাজেকর্মে যে পোশাকে স্বচ্ছন্দ, সেটা পরাই তো ভাল।’’

পঁচিশের তৃণা আরও সোজাসাপ্টা। ‘‘উদ্দেশ্যটা যা-ই হোক, ফেসবুকে এত মাতামাতির কিন্তু অন্য একটা কারণও আছে। শাড়ি পরা ছবিতে সুন্দর দেখাবেই। আর তার মানে লাইক-কমেন্টের বন্যা। প্রশংসা পেতে কার না ভাল লাগে? ছবি দেওয়ার কনসেপ্টটা না থাকলে এত হইচই হত কি?’’

তবু...

সাফল্য আছে। বিতর্কও। তবু বিপ্লব চলে তার নিজের গতিতেই।

আর তাই, আবার সে এসেছে ফিরিয়া। শাড়ি এবং নারীর সেই আদি অকৃত্রিম সম্পর্ক।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE