‘প্রিয়া’: তনুশ্রী, ‘অরুণকুমার’: প্রসেনজিৎ, ‘সুচরিতা সেন’: পাওলি
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ সবাই আগেই দিয়ে দিচ্ছে - ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। কিন্তু কারও বুঝতে বাকি থাকছে না কিছুই।
সুচিত্রা সেনের ড্রয়িং রুমের পাশে উত্তমকুমারের বেডরুম। সুচিত্রা সেনের বেডরুমের বাইরে উত্তমবাবুর ভবানীপুরের বাড়ির ঠাকুরদালান। আর সুচিত্রা সেনের ড্রেসিং রুমের পাশে গৌরীদেবীর বড় ছবি।
গল্প নয় কিন্তু, ঘোর বাস্তব। টেলিভিশনের বাস্তব, যা সিরিয়ালের রূপে দেখা যাবে। এখনও অবধি যা খবর, টিভিতে এই সিরিয়াল শুরু হবে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। এবং সেই সিরিয়াল সংক্রান্ত এ রকমই আশ্চর্য এই ঘটনাটা ঘটছে টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয়।
কী কী ঘটছে ? ঘটছে ‘স্বর্ণযুগ’য়ের বাংলা সিনেমার নানা অজানা নেপথ্য কাহিনি।
যেমন?
সুচিত্রা সেনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে উত্তমকুমার চলে যাচ্ছেন ডায়মন্ড হারবারে।
অন্য দিকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করে মহানায়ক বলছেন, ‘‘আজকে একটু আলু পোস্ত খাব কিন্তু।’’ মনে হতেই পারে, আলু পোস্ত খাওয়ার মধ্যে বিশেষত্ব কী? আসলে ওটাই যে রাতে নায়িকার বাড়িতে থেকে যাওয়ার পাসওয়ার্ড!
এর মধ্যেই স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে চলছে সুচিত্রা সেনের দাম্পত্য কলহ। যে সুচিত্রা সেনকে তিনি সিনেমায় নামতে এক প্রকার বাধ্য করেছিলেন, সেই মানুষটিই স্ত্রীর খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা দেখে হয়ে উঠেছিলেন সন্দিগ্ধ। নিয়মিত চলত মারামারি।
টিভির পর্দায় দর্শক এটাও দেখবেন যে গৌরীদেবী ছিলেন এক আটপৌরে ঘরোয়া গৃহবধূ, সেই মহিলা ভবানীপুরের বাড়ি ছেড়ে মহানায়কের চলে যাওয়ার পর কেমন ভাবে হয়ে উঠেছিলেন ‘অ্যালকোহলিক’।
এমনকী যে-দিন রাতে দিবানাথ সেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন, সে দিন তিনি সোজা গিয়ে উঠেছিলেন কাননদেবীর বাড়িতে, সেটাও রয়েছে গল্পে।
যে সুপ্রিয়াদেবী মহানায়ককে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে, সেই সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গেও নাকি পরের দিকে বিস্তর ঝামেলা হত মহানায়কের। এমনই এক মারামারির পর ভালরকম জখম হয়েছিল সুপ্রিয়াদেবীর হাঁটু, এমনটাও রয়েছে স্ক্রিপ্টে।
এ ছাড়াও দেখা যাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উত্তমকুমারের ভুল বোঝাবুঝির গল্প। যে হেমন্ত-উত্তম ছিলেন ঘনিষ্ঠতম দুই বন্ধু, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হঠাৎ করে ‘বিশ সাল বাদ’য়ে অন্য নায়ককে নেওয়াতে কী সাঙ্ঘাতিক ভেঙে পড়েছিলেন মহানায়ক সেটাও দেখা যাবে টিভির পর্দায়।
শুধু ফিল্মের গল্পতেই শেষ নয় কিন্তু। নেপথ্যের কাহিনির পরতে পরতে রয়েছে এক আটপৌরে, আমুদে, নিখাদ বাঙালি মানুষের গল্প। যিনি পাড়ায় পাড়ায় প্রভাতফেরি করে টাকা তুলেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর আইএনএ-র জন্য। যিনি ১৯৪৩-য়ের দুর্ভিক্ষে পাড়ায় খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াতেন গরিবদের, যাঁর বাড়িতে মদের আসরে মদ কখনও শেষ হত না, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও যিনি প্রায় রোজ ভবানীপুরে যেতেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
সবই দেখা যাবে, কিন্তু সঙ্গে রয়েছে সেই সতর্কীকরণ: সব চরিত্র কাল্পনিক।
পুরো ব্যাপারটা যেহেতু উত্তমকুমারের জীবন অবলম্বনে, তাই নামও বদল করা হয়েছে চরিত্রদের, যাতে পরে কোনও বিতর্ক দানা না বাঁধে। কী রকম?
যেমন, উত্তমকুমারের নাম এখানে ‘অরুণকুমার’। সুচিত্রা সেন হলেন ‘সুচরিতা সেন’। সুপ্রিয়াদেবী ‘প্রিয়া’, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হলেন ‘গায়েত্রী’ এবং গৌরীদেবী ‘উমা’। এ রকমই অন্য নামে রয়েছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বিশ্বাস তরুণকুমার-রা। সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে রয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে আছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
কিন্তু এত সব ঘটছে কেন হঠাৎ?
ঘটছে উত্তমকুমারকে নিয়ে তৈরি ১০০ এপিসোডের সিরিয়াল ‘মহানায়ক’য়ের জন্য। যার প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। দেখানো হবে স্টার জলসা চ্যানেলে। পুরো সিরিজটার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। মূলত, গল্পের আইডিয়া, রিসার্চ এবং কনসেপ্টও তাঁর। তবে এই ১০০টি এপিসোড পরিচালনা করছেন বিরসা দাশগুপ্ত। সিরিয়ালের প্রোডাকশন ডিজাইনার দেবালয় ভট্টাচার্য।
কিন্তু চমক শুধু নেপথ্যের কাহিনিতে নয়, রয়েছে কাস্টিংয়েও।
উত্তমকুমারের চরিত্রে অভিনয় করছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা সেন হয়েছেন পাওলি। সুপ্রিয়া দেবীর চরিত্রে তনুশ্রী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের রোলে প্রিয়াঙ্কা।
এই প্রথম একমাত্র আনন্দplus-এই মুখ্য চরিত্রদের ‘লুক’ উন্মোচিত হল।
ছোট পর্দার জন্য হলে কী হবে, সিনেমার থেকে কম নয় এই টেলিভিশন সিরিজ। এতটাই বড় স্কেলে ভাবা হয়েছে গল্পটা যে গোটা ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো নতুন করে রং করা হয়েছে ৫০-৬০য়ের দশককে সিনেমাটোগ্রাফার শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরায় ধরার জন্য।
এ রকম একটি চরিত্র, যার পরতে পরতে এত ‘শেডস’, সেটা ফুটিয়ে তুলতে উদগ্রীব প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও।
‘‘আমি এমন একজন মানুষের রোলে অভিনয় করছি যাঁর জীবনটাই অসম্ভব বর্ণময়। তিনি ছিলেন একজন ঘরোয়া, বনেদি, আদ্যোপান্ত বাঙালি ভদ্রলোক যাঁর পেশা ছিল সিনেমা। আর সেটায় তিনি সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছিলেন শুধু নিজের কাজের জোরে। সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা কাহিনি। তাই রোলটা অভিনয়ের দিক থেকে অসম্ভব চ্যালে়ঞ্জিং। অ্যান্ড আই অ্যাম রিয়েলি এনজয়িং ইট,’’ বুধবার সকালে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বলছিলেন প্রসেনজিৎ। কিন্তু উত্তমকুমারের সঙ্গে আপনার যে একটা স্বাভাবিক তুলনা হবে দর্শকদের মনে, সেটা নিয়ে আপনি চিন্তিত নন?
‘‘একেবারেই না। আমি কেন, কেউই কোনও দিন উত্তমকুমার হতে পারবে না। আমি তো ‘মহানায়ক’ সিরিয়ালে টাইটেল চরিত্রে অভিনয় করছি শুধু। ‘অটোগ্রাফ’ দেখে কি কারও মনে হয়েছিল এটা ‘নায়ক’য়ের রিমেক? নাকি মনে হয়েছিল আমি উত্তমকুমারকে অনুসরণ করেছি? মনে হয়নি তো! এখানেও হবে না তুলনাটা। ওটা ছিল প্রসেনজিতের ছবি। এটা প্রসেনজিতের সিরিয়াল, যেখানে প্রসেনজিৎ এমন একজন মানুষের রোলে অভিনয় করছে যাঁর জীবনটা উত্তমকুমারের মতো। খুব সিম্পল,’’ নিজস্ব মেজাজে বলেন বুম্বা।
কিন্তু তিনি তো প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। টেলিভিশনে আগে কাজ করলেও, আজকে তাঁর উচ্চতা অন্য মাত্রায়, সেখানে হঠাৎ টিভিতে প্রত্যাবর্তন কেন?
‘‘এটার পিছনে তিনটে কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটা উত্তম জেঠুকে নিয়ে কাজ। তার জন্য। আর জেঠুকে নিয়ে সেই রকম কোনও ডকুমেন্টেশন আজ অবধি হয়নি। সেটাও একটা বড় কারণ। এখনও পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে সেটা শুধু খবরের কাগজে লেখালিখি। আর তৃতীয়ত, অমিতাভ বচ্চন। ওঁকে দেখে বুঝেছি, টেলিভিশনে নিজের উপস্থিতি কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়,’’ নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেন প্রসেনজিৎ।
এই সিরিয়ালের পুরো রিসার্চের দায়িত্বে ছিলেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। এই মুহূর্তে তিনি ব্রাজিলে ‘চাঁদের পাহাড় ২’য়ের রেকি করছেন। সেখান থেকেই কমলেশ্বর বলেন, ‘‘এই পুরো রিসার্চটা হয়েছে প্রায় আট মাস ধরে। ওঁকে নিয়ে সে রকম কোনও বায়োগ্রাফিকাল কাজ আজ অবধি হয়নি। আমরা সেটা মাথায় রেখেই এগিয়েছি।’’
এখানে অবশ্যই জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, পুরো ‘মহানায়ক’য়ের গল্পটাই উত্তমকুমারের পরিবারের অনুমতি নিয়েই হচ্ছে। ‘‘আমরা ওঁদের সঙ্গে সব ব্যাপারে কথা বলেই শ্যুটিং শুরু করেছি,’’ বলেন সিরিয়ালের পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত।
আর সুপ্রিয়া দেবী? তাঁর সঙ্গে কি কথা হয়েছে? ‘‘না, সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে কথা হয়নি আমাদের। তবে তাঁর নিজের লেখা বই থেকেই অনেক ঘটনা আমরা রেফারেন্স হিসেবে রেখেছি,’’ জানাচ্ছেন বিরসা।
অন্য দিকে পাওলি একাধারে নার্ভাস এবং এক্সাইটেড সুচিত্রা সেনের জীবন অবলম্বনে তৈরি চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে।
‘‘এক্সাইটমেন্ট তো হচ্ছেই। নার্ভাসও লাগছে। আমি ইচ্ছে করে সুচিত্রা সেনের কোনও ছবি শ্যুটিংয়ের আগে দেখিনি। কিছু ম্যানারিজম রেখেছি এপিসোড ডিরেক্টর বিরসার সঙ্গে কথা বলে। আর অনেক দিন পর টিভিতে কাজ করছি। এনজয় করছি খুব কিন্তু প্রচুর ডায়লগ বলতে হচ্ছে। আর সত্যি বলতে এত কমপ্লেক্স একটা চরিত্র ‘সুচরিতা সেন’য়ের। সেটা ঠিক করে করাটা আমার কাছেও দারুণ চ্যালে়ঞ্জিং,’’ বলেন পাওলি।
অন্য দিকে শ্যুটিংয়ের পাশাপাশি বাড়িতে নিয়মিত সুপ্রিয়া দেবীর ছবি দেখছেন তনুশ্রী চক্রবর্তী।
‘‘রোজ সুপ্রিয়া দেবীর ছবি দেখছি ওঁর সূক্ষ্ম ম্যানারিজমগুলোর জন্য। একবার ভেবেছিলাম, ওঁর বাড়িতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করে টিপস নেব। কিন্তু শুনেছি উনি অসুস্থ। তাই ওঁর সিনেমাই আমার কাছে রেফারেন্স পয়েন্ট,’’ বলছেন তনুশ্রী।
সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে গোটা টালিগঞ্জের চোখ ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে। স্টুডিয়োর ঠিক বাইরে আজও উত্তম-সুচিত্রার ছবি জ্বলজ্বল করছে।
স্টুডিয়োর ভিতরে যে উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয়তা আজও কেউ ‘টাচ’ করতে পারেনি, সেটারও প্রমাণ ‘মহানায়ক’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy