পুরনো চাল নাকি ভাতে বাড়ে। আর সেই পুরনো চাল যদি নতুন হাঁড়িতে রান্না হয়? আপাতত এমন ঘটনাই ঘটছে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির রান্নাঘরে। নতুন বছরে টলিপাড়ায় একাধিক বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে। সেই নতুন বাংলা ছবিতে পুরনো মুখেরাই কেন্দ্রীয় চরিত্রে। মুখ্য চরিত্রে বর্ষীয়ান অভিনেতারাই কেন? তাঁদের নিয়ে কাজ করলে কি আখেরে ছবির কোনও বাড়তি লাভ? নির্মাতাদের কাছে এ রকমই কিছু প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার ডট কম।
প্রায় ১৬ বছর পর ‘পুরাতন’-এর মাধ্যমে বাংলা ছবিতে ফিরছেন শর্মিলা ঠাকুর। অন্য দিকে প্রায় এক যুগ পর বাংলা ছবি ‘আড়ি’তে অভিনয় করেছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। এখানেই শেষ নয়। গত কয়েক বছরে বাংলা ছবির সংখ্যা বাড়িয়েছেন মিঠুন চক্রবর্তী। মুক্তি পাবে তাঁর নতুন ছবি ‘শ্রীমান ভার্সেস শ্রীমতী’। আবার মে মাসে আসছে রাখী গুলজ়ার অভিনীত ছবি ‘আমার বস’। এই মুহূর্তে শহরে চলছে ‘রক্তবীজ ২’ ছবির শুটিং। সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। অপর্ণা সেন অভিনয়ে ফিরেছেন। অঞ্জন দত্ত, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় বা অনসূয়া মজুমদার এখনও নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন।

বহু বছর পর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের ‘পুরাতন’ ছবির মাধ্যমে বাংলা ছবিতে ফিরছেন শর্মিলা ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত।
ছবির অন্যতম অভিনেত্রী তথা প্রযোজক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অবশ্য বিষয়টিকে তাঁর ‘প্রাপ্তি’ এবং দর্শকের জন্য নতুন বছরের ‘উপহার’ হিসেবেই দেখতে চাইছেন। বললেন, ‘‘বর্ষীয়ান অভিনেতারা তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করা বা তাঁদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার সুযোগ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’ ঋতুপর্ণা বিশ্বাস করেন, পুরনো দিনের অভিনেতাদের খুঁজছেন বাংলা ছবির দর্শক। তাঁরা সেই প্রিয় অভিনেতাদের পর্দায় দেখতে পছন্দ করেন। অভিনেত্রীর যুক্তি, ‘‘ শর্মিলাজির অল্প বয়সের ছবি দর্শকের মনে গেঁথে আছে। কিন্তু আজ বয়সে এসে তিনি অভিনয় করলে তা দেখার আগ্রহ দর্শকদের মধ্যে অবশ্যই থাকবে। তাঁর চেহারার পরিবর্তন, অভিনয়ের ধার— সবটাই উপভোগ করতে চান দর্শক।’’
উল্লেখ্য, ঋতুপর্ণা অতীতে ভিক্টর, মিঠুন এবং মৌসুমীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে কাজের এই উদ্যোগ ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন কোনও ‘ধারা’ শুরু করতে পারে কি না, সে প্রসঙ্গে এখনও নিশ্চিত নন ঋতুপর্ণা। কিন্তু নববর্ষের প্রেক্ষিতে জানালেন, তিনি উদ্যোগ নেওয়ার পরে একে একে আরও ছবি ঘোষণা করা হয়েছে। ঋতুপর্ণার কথায়, ‘‘শর্মিলাজির পর ভবিষ্যতে আরও বয়স্ক শিল্পীদের সঙ্গে কাজের ইচ্ছে রয়েছে। যাঁরা বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের আমি সাধুবাদ জানাতে চাই।’’

বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে ছবি প্রসঙ্গে কী বললেন রাজ চক্রবর্তী ও মিঠুন চক্রবর্তী? ছবি: সংগৃহীত।
তবে বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে ছবি প্রসঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তীর বক্তব্য কিছুটা অন্য রকম। বললেন, ‘‘ইন্ডাস্ট্রিতে পুরনো অভিনেতাদের নিয়ে কাজের ট্রেন্ড তো আমিই শুরু করেছি। ছবিতে যখন বাকিরা আমাকে বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করতে দেখলেন, তখন তাঁরাও বললেন, ‘মিঠুনদা করছে মানে আমরাও করতে পারি।’’’ এখন কেন বয়স্ক অভিনেতাদের ফিরিয়ে আনতে চাইছেন নির্মাতারা, তা নিয়েও মিঠুনের নিজস্ব বিশ্লেষণ তাৎপর্যপূর্ণ। জানালেন, তাঁর ঠিক পরের প্রজন্মের অভিনেতা যাঁদের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়, তাঁরা নাকি বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করতে নারাজ। তাই টলিপাড়ায় এখন পুরনো মুখেদের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। মিঠুনের কথায়, ‘‘এমন অনেক অভিনেতা রয়েছেন, যাঁদের রং করা কালো চুলের পিছনে ভর্তি সাদা চুল। অথচ তাঁরা বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করবেন না!’’
নুসরত জাহান এবং যশ দাশগুপ্ত প্রযোজিত ‘আড়ি’ ছবিতে রয়েছেন মৌসুমী। বাংলা ছবিতে বর্ষীয়ান অভিনেতাদের উপস্থিতি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করলেন নুসরত। তাঁর মতে, বাঙালি অভিনেতা, যাঁরা জাতীয় পর্যায়ে এক সময় বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন, বর্তমান সময়ে বাংলা ছবিতে তাঁরা কী চমক হাজির করবেন তা নিয়ে দর্শকের মধ্যে কৌতূহল থাকে। নুসরত বললেন, ‘‘আমাদের ছবিতে মায়ের চরিত্রে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের একমাত্র পছন্দ। চিত্রনাট্য শুনে তিনি যে আমাদের ছবিতে অভিনয় করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’’ নুসরতের বিশ্বাস, মৌসুমী এই ছবিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। দীর্ঘ দিন পর দর্শকের কাছেও সেটা বাড়তি প্রাপ্তি হতে চলেছে।

নুসরত জাহান এবং যশ দাশগুপ্ত প্রযোজিত ‘আড়ি’ ছবিতে রয়েছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
গত বছরের শেষে মিঠুনকে নিয়েই মুক্তি পায় পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর ছবি ‘সন্তান’। বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে কাজকে ইতিবাচক দিক থেকেই দেখতে চাইছেন রাজ। তবে আগামী দু’মাসে ছবিমুক্তির ধারাকে কোনও ‘ট্রেন্ড’-এর পরিবর্তে ‘কাকতালীয়’ ঘটনা হিসেবেই দেখতে চাইছেন তিনি। রাজের কথায়, ‘‘এই বড় মাপের তারকাদের রাজি করানো আমাদের মতো পরিচালকের কাছে স্বপ্নের মতো। কারণ তাঁরা তো সব চিত্রনাট্যে রাজি হবেন না। তাই পরিচালকদেরও সেই ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। যে অভিনেতাদের প্রসঙ্গ উঠে আসছে, আমি তো সুযোগ পেলে তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করতে চাই।’’
বর্ষীয়ান তারকারা কি পর্দায় নতুনদের কোণঠাসা করে দেন? রাজ এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে নারাজ। বরং তাঁর দাবি, মিঠুনের সঙ্গে শট দেবেন জানলে, একজন নবাগত অভিনেতাও বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে ফ্লোরে আসেন। রাজ বললেন, ‘‘মিঠুনদা তো ফ্লোরে বার বার ঋত্বিক, শুভশ্রী এবং অহনার প্রশংসা করতেন। সেটা অভিনেতা হিসেবেও প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত করত এবং তার ফলে সামগ্রিক অভিনয়ের মানও উন্নত হত।’’
আরও পড়ুন:
পরিচালক অভিজিৎ সেন কেরিয়ারে শুরু থেকেই বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ‘টনিক’ ও ‘প্রধান’ ছবিতে দেবের সঙ্গেই পরান বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েছিলেন। অন্য দিকে ‘প্রজাপতি’ ছবিতে ছিলেন মিঠুন। অভিজিতের মতে, গল্পের প্রয়োজনেই চরিত্রাভিনেতা নির্বাচন করা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘পুরনো দিনের শিল্পীর সঙ্গে আজকের শিল্পীদের মিশ্রণ— এই ভাবে বিষয়টাকে দেখা উচিত নয়। গল্পই তো ঠিক করে দেয় সব কিছু।’’
অভিজিতের মতে, বর্তমান প্রজন্মের কোনও অভিনেতার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির বর্ষীয়ান অভিনেতার জুটি দর্শকের কাছে নতুন আকর্ষণ তৈরি করতে পারে। অভিজিতের কথায়, ‘‘‘টনিক’-এর ক্ষেত্রে পরানদা এবং দেবের জুটি তো সেই কারণেই দর্শকের মন ছুঁয়ে ছিল। এই ছবিতে শকুন্তলা বড়ুয়াও তো ছিলেন। তিনিও তো এক সময় বাংলার নামকরা অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন।’’
অভিজিতের মতোই কিছুটা একই সুর ‘শ্রীমান ভার্সেস শ্রীমতী’ ছবির পরিচালক পথিকৃতের কণ্ঠে। তাঁর মতে, ছবির গল্পই তার অভিনেতাদের খুঁজে নেয়। বর্ষীয়ান অভিনেতাদের নিয়ে ছবি করলে ছবির যে আলাদা একটা দর্শকবৃত্ত তৈরি হয়, সে কথা মেনে নিচ্ছেন পথিকৃৎ। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আমার ছবিতে ২৭ বছরের দীর্ঘ একটি বিবাহবিচ্ছেদ মামলার প্রেক্ষাপটে প্রেম রয়েছে। সেখানে দম্পতির চরিত্রে বয়স্ক অভিনেতাদের নির্বাচন করাটাই স্বাভাবিক নয় কি?’’ গল্পের প্রয়োজনে বর্ষীয়ান ‘তারকা’ অভিনেতা ছবির আকর্ষণ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় বলেই মনে করেন পথিকৃৎ। তবে ছবির ‘বিশেষ আকর্ষণ’ তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালকেরা বর্ষীয়ান তারকাদের ছবিতে নির্বাচন করছেন, এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে রাজি নন পথিকৃৎ।

‘শ্রীমান ভার্সেস শ্রীমতী’ ছবিতে অঞ্জন দত্ত ও মিঠুন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
পোস্টারে বর্ষীয়ান তারকাদের মুখের উপস্থিতি বক্স অফিসে ছবিকে কোনও বাড়তি সাহায্য করে? বারুইপুর শো হাউসের কর্ণধার শান্তনু রায়চৌধুরীর মতে, বর্ষীয়ান অভিনেতার মুখ থাকলেই যে দর্শক বেশি সেই ছবির প্রতি আকৃষ্ট হবেন, তেমনটা নয়। বললেন, ‘‘এখনকার পরিস্থিতিতে পরিচালক এবং কোন প্রযোজনা সংস্থা ছবি করছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পর আসে তারকা। সেখানে কোনও বর্ষীয়ান অভিনেতা থাকতেই পারেন।’’
বর্ষীয়ান তারকাদের দিকে কেন ঝুঁকেছে টলিপাড়া? দেব এবং জিতের পর নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও সুপারস্টার তৈরি হয়নি। প্রথম সারির তারকারা এখন মূলত নিজের প্রযোজনায় ছবি করতে ইচ্ছুক। টলিপাড়ার এক সূত্রের কথায়, ‘‘বাকি প্রযোজক বা পরিচালকদের তো ছবি তৈরি করতে হবে। টিকে তো থাকতে হবে। তারকারা সরে গেলে তাই পুরনোদের উপরেই বাজি ধরছেন অনেকে।’’
অপর এক সূত্রের কথায়, ‘‘মিঠুন, শর্মিলা, রাখী, ভিক্টর, মৌসুমী— প্রত্যেকে জাতীয় মুখ। ছবি থেকে মুনাফার (জাতীয় পর্যায়ে ছবি মুক্তি, ওটিটি, সঙ্গীত, স্যাটেলাইট স্বত্ব) ভবিষ্যৎ মাধ্যমগুলোয় সেটা অনেকটাই সাহায্য করে।’’

‘আমার বস’ ছবিতে রাখী গুলজ়ার। ছবি: সংগৃহীত।
কারও মতে, গল্প খুঁজে নেয় অভিনেতাকে। কেউ আবার মনে করেন, বর্ষীয়ান অভিনেতাদের ফিরিয়ে আনার অর্থ বাংলা ছবি তথা ইন্ডাস্ট্রির সমৃদ্ধি। পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট হল জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি রয়েছে, এ রকম বর্ষীয়ান অভিনেতারা ছবির ‘মূল্য’ নানা দিক থেকে বাড়িয়ে তোলেন। তবে কি বছরভর টলিপাড়ায় নতুন ছবির ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান অভিনেতাদের উপস্থিতি আরও বাড়বে?