অভিনেতা হিসাবে বন্ডের চরিত্র করার প্রস্তাবটাই লোভনীয়। গ্রাফিক:তিয়াসা দাস
আচ্ছা, আপনি কখনও জেমস বন্ড করবেন না?
আমার কাছে এই প্রশ্নটা খুব কমন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শকরা নানা প্রশ্ন করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার আসে এই দুটো— আবার করে ব্যোমকেশ করবেন? আর, আপনি জেমস বন্ড করবেন না?
বন্ডের প্রশ্নটা অদ্ভুত লাগত! হেসে বলতাম, ‘‘বাব্বা, অত ইংরেজি কী করে বলব!’’ কিন্তু অনেকেই ওই জবাবে খুশি হতেন না। তাঁদের জন্য আরেকটু বেশি বলতে হত।
কিন্তু বাঙালি বন্ডকে নেওয়ার জন্য বাঙালি কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত?
আমার কাছে কোনও পরিচালক জেমস বন্ড চরিত্রের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমি প্রথমেই তাঁকে কতগুলো প্রশ্ন করব।
ফেলুদা আপাদমস্তক বাঙালি। ব্যোমকেশও। কিন্তু জেমস বন্ড লোকটা তো ব্রিটিশ! তার জীবনযাপন থেকে পোশাক-আশাক— সবটাই ভীষণ বিদেশি! সে একটা গুপ্তচর। বিভিন্ন মিশনে যায়। রহস্য উদ্ঘাটন করে। একের পর এক নারীর প্রেমে পড়ে। তাদের শয্যাসঙ্গী হয়। তার গোটা আবেগটাই ভীষণ রকমের ব্রিটিশ। বাঙালি জেমস বন্ডের ফ্যান হতে পারে। বন্ডকে নিয়ে একের পর এক ছবি দেখতে পারে। কিন্তু তার মাথায় কিন্তু বন্ডের ইমেজটাই আলাদা। বন্ড ইংরেজিতে কথা বলবে। একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় পানীয়ের অর্ডার দেবে। তার আগে বলবে, ‘‘শেক্ন। নট স্টার্ড।’’
‘বাঙালি সেক্সবিমুখ জাতি! আদৌ নয়। কিন্তু ওই একটা ‘সংস্কৃতি’ বাঙালির আছে।’ ছবি:সংগৃহীত
সেখানে বাঙালি কোনও বাঙালি অভিনেতাকে মেনে নিতে পারবে না। আবার সেই বাঙালিই যখন ফেলুদা বা ব্যোমকেশ দেখতে যাবে, তখন ওই চরিত্রগুলোর মধ্যে পাশের বাড়ির ক্রিকেটখেলিয়ে বা পাড়ার কোনও সপ্রতিভ দাদাকে খুঁজবে। বাঙালিয়ানা খুঁজবে। তাই বাঙালি বন্ড কলকাতার সঙ্গে খাপে-খাপ হবে না।
আসলে ছবি করার মূল উদ্দেশ্য তো গল্পটা বলা। তার ফলে আমাদের একটা চোখ তৈরি হয়ে যায়। একটা মনন তৈরি হয় মনে মনে। ধরুন, বন্ড একটা সুইমিং কস্টিউম পরে জল থেকে উঠে এল। হল হাততালিতে ফেটে পড়বে। কিন্তু ব্যোমকেশ যদি অন্তর্বাস পরে বাথরুম থেকে বেরোয়? বাঙালি সেটা ভাবতেই পারে না।
আরও পড়ুন: বাংলায় আগে সকলে বন্ডের মতো চুমু খাওয়াটা প্র্যাকটিস করুক
বছর কয়েক আগে বাংলা ছবিতে একটা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছিল। সংলাপে ‘স্ল্যাং’ ব্যবহারের। কিছু দর্শক বেশ মজা পেতেন। তাঁরা হাসতেন। ইংরেজি ছবিতে হরদম ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দর্শক হাসেন না। অর্থাৎ, আমাদেরটা চিত্রনাট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছিল না। আমাদের সৌভাগ্য, সেই ট্রেন্ড থেকে বেরিয়ে এসেছি।
ফেলুদার এতগুলো গল্প-উপন্যাসের মধ্যে ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ আর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’— মাত্র এই দুটোয় নারীচরিত্র আছে। ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে সত্যবতী থাকলেও সে তার স্ত্রী। সত্যান্বেষণে গিয়েই সত্যবতীর সঙ্গে তার প্রেম ও বিয়ে। বাঙালি এটা জানে। কিন্তু বন্ডের একাধিক নারীসঙ্গ। বাংলায় বন্ড দেখতে গিয়ে বাঙালি তো আগে সেটা মার্ক করবে!
সংস্কৃতির পার্থক্য আছে। যেখানকার যা! ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর প্রিমিয়ার শোয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সিনেমার গল্প অনুযায়ী, ব্রাউন সাহেবের একটা ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। ব্রাউন সাহেব তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, তার কাছে সাইমন বলে এক জন আসে। কয়েক দিন না আসায় তাঁর মন খারাপ। সেই দৃশ্যে আমার পিছনের বসা ক’জন কিশোর দর্শক বলছিল, ‘‘সাইমন নিশ্চয়ই ওর গে পার্টনার।’’ প্রথমে অস্বস্তি লেগেছিল। পরে ভেবে দেখেছি, সেটাই তো স্বাভাবিক ভাবনা।
ব্রিটিশরাও কিন্তু এই ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে খুব সচেতন। তারা কিন্তু কোনও আমেরিকান অভিনেতাকে দিয়ে বন্ড করায়নি। ছবি:সংগৃহীত
আসলে বাঙালি যখন বাংলায় ছবি দেখে, তখন ভাবে, বাঙালি নায়ক মানেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করবে। ব্যোমকেশের তো হাতজোড় করে ‘নমস্কার’ করার একটা অদ্ভুত কায়দা ছিল। ‘হর হর ব্যোমকেশ’-এ সত্যবতীকে চুমু খাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল। সেই দৃশ্যের সমালোচনায় আমার ফেসবুক পেজ ভরে গিয়েছিল! বক্তব্য— ব্যোমকেশ যদি সত্যবতীকে নিয়েই এত ব্যস্ত থাকে, তা হলে তদন্তটা কখন করবে! আবার ‘ব্যোমকেশ গোত্র’ যখন এসেছিল, বিদেশে বাঙালিরা অনেকে বলেছিলেন, তাঁদের ফেস্টিভ্যালে ওই ছবি দেখানো যাবে না। কারণ, সেখানে ‘সত্যকাম’ বলে একটা কামুক চরিত্র ছিল। বিদেশের বাঙালিরা বলেছিলেন, তাঁদের পক্ষে সপরিবারে ওই ছবি দেখাটা মুশকিলের। কিন্তু ঘটনাগুলো তো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পেই ছিল! তা হলে আমরা দেখাব না কেন? কিন্তু বাঙালি মানতে নারাজ। কমবয়সিরা কিন্তু এমন প্রশ্ন করে না। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে বাংলায় জেমস বন্ড করতে হলে হয়তো দেখা যাবে গুপ্তচর চরিত্রকে বাড়ি ফিরে ভাত-ডাল খেতে হচ্ছে। তার মানে কি বাঙালি সেক্সবিমুখ জাতি! আদৌ নয়। কিন্তু ওই একটা ‘সংস্কৃতি’ বাঙালির আছে।
আরও পড়ুন: ৯০ বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন ‘জেমস বন্ড’ শন কনারি
ব্রিটিশরাও কিন্তু এই ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে খুব সচেতন। তারা কিন্তু কোনও আমেরিকান অভিনেতাকে দিয়ে বন্ড করায়নি। নতুন বন্ডও এক ব্রিটিশ অভিনেতা বলেই শোনা যাচ্ছে। বন্ডের ফ্যানেরাও সেটা পছন্দ করেন। আসলে দর্শক একই। ছবির গঠন অনুযায়ী তাদের মানসিকতা পাল্টে যায়।
অভিনেতা হিসাবে বন্ডের চরিত্র করার প্রস্তাবটাই লোভনীয়। আর ওই চরিত্রে নিজেকে ভাবলে, সত্যিই আর কিছু ভাবার থাকে না। কিন্তু আমার কাছে কোনও পরিচালক জেমস বন্ড চরিত্রের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমি প্রথমেই এই প্রশ্নগুলো করব। এর থেকে বেরনোর কোনও উপায় তিনি বাতলাতে পারলে ‘হ্যাঁ’ করব। নইলে আমার ব্যোমকেশ, ফেলুদা, সোনাদাই ঠিক আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy