বাংলাটা অবাঙালিদের মতো। বরং ইংরেজি উচ্চারণে খাঁটি সাহেবিয়ানা। ৫ ফুট সাড়ে ৯ ইঞ্চি লম্বা, ঘাড় ছাঁটা চুল, ছিপছিপে মেয়েটির ভাত, মাছ, মিষ্টিতে প্রবল আপত্তি। কিন্তু মা বিরিয়ানি রেঁধে দিলে সাপটে খান! এখনও সুযোগ পেলে চুরমুরে ডুব দেন। লেকটাউনের মেয়ে। পড়াশোনা কলকাতার একাধিক প্রথম সারির ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে। সেই সময় বিষয় ছিল সাংবাদিকতা।
কিন্তু বিষয় হিসাবে কেন বাছলেন সাংবাদিকতা? অমিতাভ বচ্চনের সাক্ষাৎকার নেবেন বলে! পরে অবশ্য নিউ ইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমি থেকে অভিনয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি কঙ্কনা চক্রবর্তী। তাঁর মেয়ের নামে নাম হলেও দূর-দূরান্তে অপর্ণা সেনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই কঙ্কনার। উল্টে ‘পরমা’ পরিচালকের ‘দ্য রেপিস্ট’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ তাঁর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে। তাই নিয়ে তাঁর খুব আফসোস।
এই কঙ্কনা এখন অভিনয়ের পাশাপাশি ছোট ছোট ছবিও বানান। যেমন, সদ্য বানিয়ে উঠলেন ‘রি রুটিং’। সেই ছবির ট্রেলার প্রথম প্রকাশ করেছেন অমিতাভ, তাঁর স্বপ্নের পুরুষ! ছবির গল্প, চিত্রনাট্য কঙ্কনার। তাঁর সঙ্গে ছবিতে অভিনয় করেছেন বরুণ চন্দ, প্রদীপ ভট্টাচার্য। দুই মানুষের একটি নিশিযাপনের গল্প। যাঁরা পরস্পরের সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত। কঙ্কনার এই ছবিটি আসলে ‘সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার’। তাই এর থেকে বেশি বলা নিষেধ। এই যাঁর জীবনীপঞ্জি তিনি রবিবারের পড়ন্ত বিকেলে ফোনে চুটিয়ে আড্ডা দিলেন আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে।
ডাবিং চলছিল পরিচালক-অভিনেতার। তাই ফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারেননি। তার জন্য বার চারেক দুঃখপ্রকাশ করতেই প্রথম প্রশ্ন, কঙ্কনা কি মেমসাহেব? চলনে, বলনে, চেহারায় তো বটেই। ভাবনা, আচরণেও কি তথাকথিত বাঙালিয়ানা বিবর্জিত? নইলে ফোন না ধরতে পারার জন্য এত দুঃখপ্রকাশ! নিটোল গলায় মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন, “হলিউডে কাজ করি। ওখানে প্রত্যেকে ভীষণ সময়ানুবর্তী। ফলে, যে কোনও কাজ ১০ মিনিট আগে করার চেষ্টা করি। ১০ মিনিট পরে নয়। ওই জন্যই...।” তড়িঘড়ি যোগ করলেন, “তা বলে কলকাতার উপরে টান নেই, এমন বদনাম নিন্দকেও দেবে না। জানেন, দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ আমার খুব প্রিয়। ওখানে এখনও রাস্তার দু’পাশে গাছ। এই বসন্তে পথের দু’পাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুল ফুল ঝরে। সঙ্গে মিষ্টি হাওয়া... শহরটার প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।” হাসতে হাসতে এ সব বললেন কঙ্কনা। ব্যক্তিজীবনে তিনি বার তিনেক প্রেম ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন! আরও প্রেমে পড়ার স্বপ্ন দেখেন।
অমিতাভ আপনার ছবির ট্রেলার ভাগ করে নিচ্ছেন! বলতেই পাল্টা উচ্ছ্বাস ভেসে এল, “আমার সব কাজ স্যরকে পাঠাই। ওঁর যেটা ভাল লাগে সেটা নিজে থেকেই ভাগ করে নেন। বলতে হয় না!” কঙ্কনার অমিতাভ-প্রীতি দশম শ্রেণি থেকে। তখন তিনি ষোড়শী। ঠাকুমা ‘দো আনজানে’ দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির পুরুষালি অভিনেতার দিকে। সেই শুরু। একটানা তিন বার ‘দো আনজানে’ দেখার পর তিনি পাকাপাকি প্রেমে পড়েছিলেন। পাগল ‘বিগ বি’র জন্য। প্রতি মাসে একটি করে চিঠি। পরের মাসে তার প্রত্যুত্তর আসত! “রীতিমতো প্রশ্রয় দিতেন আমায়। স্যর প্রশ্রয় না দিলে সংবাদিকতা নিয়ে না পড়ে অর্থনীতির ছাত্রী হতাম। জানতেই পারতাম না, আমিও পরিচালনা, অভিনয় পারি। ভক্তদের পাগলামিতে অমিতাভ বচ্চন ভীষণ প্রশ্রয় দেন। এটাই হওয়া উচিত”, বক্তব্য অমিতাভের বাঙালি অনুরাগিণীর। এই কারণেই নাকি প্রতি রবিবার বলিউড ‘শাহেনশা’ দর্শন দেন অনুরাগীদের। যদিও তিনি বলেন, তাঁর ঈশ্বর দর্শন হচ্ছে।

‘রি রুটিং’ ছবির পরিচালক কঙ্কনা চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
ধীরে সেই পাগলামি বয়সের সঙ্গে স্তিমিত। কঙ্কনার কাছে অমিতাভ তাঁর পথপ্রদর্শক। এমন অনেক কথা আছে, যা তিনি বাড়িতে বলতে পারেন না অবলীলায় বর্ষীয়ান অভিনেতাকে বলেন। তাঁর প্রথম তথ্যচিত্রে অমিতাভ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।
যিনি সারা ক্ষণ অমিতাভময় পর্দায় তিনি কেন তাঁর সহ-অভিনেতা নন? কিংবা পরিচালক?
প্রশ্ন শুনে গলাটা কি নিবু নিবু? বড় শ্বাস নিয়ে কঙ্কনা বললেন, “এই ইচ্ছেটাই পূরণ হওয়া বাকি। ওঁর সঙ্গে অভিনয়, ওঁকে পরিচালনা।” পর ক্ষণেই উচ্ছ্বসিত, “তবে বাংলায় অমিতাভ স্যরের কিছু গুণ খুঁজে পেয়েছি সব্যসাচী চক্রবর্তীর মধ্যে। ওঁকে নিয়ে দু’টি ছবি করেছি। আর বরুণ স্যরের মধ্যে।” ফের থেমে নিজেকে গুছিয়ে বলেছেন, “অমিতাভ স্যরকে যতটা ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি ততটাই বরুণ স্যরকেও। ‘রি রুটিং’ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখলাম। আচরণে-ব্যবহারে দু’জনের মধ্যে অনেক মিল। আফসোস, বিনোদন দুনিয়া সে ভাবে ওঁকে আবিষ্কারও করতে পারল না। ব্যবহারও করতে পারল না।” পরিচালনার পাশাপাশি হলিউড ছাড়াও বাংলা, বলিউড, অহমিয়া ছবিতে কাজ করেছেন কঙ্কনা। তাঁর শেষ হিন্দি কাজ ‘এভরিবডি লাভস শোরাব হন্ডা’। পরিচালনায় রজত কপূর। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘প্রেম ট্রেম’ ছাড়াও ‘শব্দ জব্দ’, ‘রহস্য রোমাঞ্চ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। খুব ইচ্ছে, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রতীম ডি গুপ্তের পরিচালনায় কাজ করবেন। বিপরীতে? তাঁর মতে, “আমি মোটেই নায়িকাসুলভ দেখতে নই। ওই ছক একমাত্র ভেঙেছিলেন স্মিতা পাতিল। এখনও ইন্ডাস্ট্রি নায়িকার মধ্যে তথাকথিত সৌন্দর্য খোঁজে। আমার তাই ভাল অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছে। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে পর্দা ভাগ করতে পারলে খুব ভাল লাগবে।” সাফ জানালেন, বাংলায় এঁদের বাইরে আর কোনও অভিনেতা তাঁর মনে দাগ কাটতে পারেনি!
পেশাজীবনে অভিনয় তাঁর প্রেম। পরিচালনা নেশা। কখনও অমিতাভের সঙ্গে রেখার প্রেমের কথা শুনে ‘ব্যক্তি’ কঙ্কনার হিংসে হয়েছে?
“একেবারেই না”, জবাব দিলেন একটুও না ভেবে। তার পরেই গোপন কথা ফাঁস, “তখন আমি আর একটু বড়। অমিতাভ আমার চোখে সেরা পুরুষ। বাবাকে ওঁর মতো করে দাড়ি রাখতে বাধ্য করেছি। তখন একবার টুইট করেছিলাম, ঘর বাঁধব। চলুন পালাই!” অমিতাভ কি খুব রেগে গিয়েছিলেন? একেবারেই না। বরং কঙ্কনাকে পাল্টা লিখেছিলেন, “তোমার সব ইচ্ছে পূরণ হোক। কেবল টুইটে লেখা ইচ্ছে ছাড়া। ওটা আর সম্ভব নয়।” সে দিন কঙ্কনার জন্মদিন ছিল।
যাঁকে প্রতি মুহূর্তে ভেবে অনুপ্রাণিত পরিচালক-অভিনেত্রী সেই অভিনেতা নাকি অবসর নিতে চলেছেন?
না, এই প্রশ্ন কঙ্কনা অমিতাভকে করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর দাবি, “স্যর কাজ ছাড়া থাকতে পারেন না। অভিনয় ছেড়ে দিলে তাঁর সময় কাটবে কী করে?” এ-ও জানিয়েছেন, অভিনয়ের পাশাপাশি ‘পা’ লেখালিখি করেন, গানে সুর দেন। অভিনয় ছেড়ে দিলেও তিনি কোনও দিন চুপচাপ বসে থাকবেন না।
আরও পড়ুন:
অমিতাভের এই মন্ত্রে দীক্ষিত কঙ্কনা নিজেও। তাই আপাতত ব্যস্ত তাঁর ছোট ছবির মুক্তি নিয়ে। সম্ভবত ছবিটি আগামী মাসে নন্দনে মুক্তি পেতে পারে। ইতিমধ্যেই তাঁর ঝুলিতে ‘উইমেন প্রেড অ্যান্ড প্রাইড আপ অন’, ‘রিটেন বাই’, ‘মিরর ইমেজ’-এর মতো ছোট ছবি। “এ বার একটা বড় ছবি পরিচালনা করতে হবে। বাংলাতেই করব হয়তো”, বললেন তিনি। অমিতাভ থাকবেন? শুনেই দমকা হাসি। জানালেন, ক্রমশ প্রকাশ্য। তার পরেই আবদার জুড়লেন, “এখনও নিজে শাড়ি পরতে পারি না! কিন্তু পরতে খুব ভালবাসি। ছবিমুক্তির দিন ইচ্ছে শাড়ি পরার। এর মধ্যে শিখে উঠতে পারব? টিপ্স থাকলে দিন না!”