এসি’র খরচ , স্যানিটাইজেশন, কর্মচারীদের মাইনে মিটিয়ে লাভের ব্য়াপারে সন্দিহান সিনেমা হলের মালিকরা
খুলছে সিনেমা হল। অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে মাত্র ৫০ জন দর্শক নিয়ে দেখানো যাবে ছবি। দীর্ঘ ছয় মাসের নিরন্তর অপেক্ষার পর রাজ্য সরকারের তরফে সম্মতি মিলেছে অবশেষে। পরিচালক থেকে প্রযোজক, অভিনেতা থেকে হল মালিক— স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন প্রত্যেকেই। তবে এই সঙ্গেই ইন্ডাস্ট্রির একাংশের প্রশ্ন, সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, মাত্র ৫০ জন দর্শক নিয়ে সিনেমা দেখালে খরচ উঠে আসবে তো? পাল্টা উত্তরও এসেছে ইন্ডাস্ট্রির অন্দর থেকেই। “আগে শুরু তো হোক, এর পর না হয়, খরচের কথা ভাবা যাবে”, বলছেন অনেকেই।
পুজোতে ‘নেই’ কাকাবাবু
সামনে পুজো, খান চল্লিশেক বাংলা ছবি হাতে রয়েছে ইন্ডাস্ট্রির। কিন্তু প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ-এর কর্ণধার মহেন্দ্র সোনির প্রশ্ন, রাজ্যের পাশপাশি যদি কেন্দ্রীয় সরকারেরও হল খোলার এই সিদ্ধান্তে সম্মতি না থাকে সে ক্ষেত্রে আদপে সিনেমা হলে নতুন ছবি মুক্তি পাবে তো? তাঁর কথায়, "হল খোলার ব্যাপারে কেন্দ্র থেকেও ইতিবাচক নির্দেশের আশায় রয়েছি।" যদিও রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত এই মুহূর্তে ওই প্রযোজনার সংস্থার হাতে মুক্তির জন্য রয়েছে চার-চারটে আনকোরা ছবি। এঁদের মধ্যে অন্যতম পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। হল খুললে সেই ছবি কি মুক্তি পাবে? সৃজিত জানালেন, “এই মুহূর্তে এত কম সংখ্যক (৫০ জন) দর্শক নিয়ে বড় বাজেটের ছবি হলে নিয়ে আসা কিছুটা চাপের। তাই আমার মনে হয় ‘কাকাবাবু...’ এখনই বড় পর্দায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। যদিও প্রযোজক ভাল বলতে পারবেন।” ছোট বাজেটের ছবি মুক্তি পেলেও এত কম সংখ্যক দর্শক নিয়ে বড় বাজেটের ছবির মুক্তি যে বেশ অসুবিধের, সে কথা মেনে নিয়েছেন পরিচালক অরিন্দম শীলও। কেন অসুবিধে, তার একটি হিসেবও দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “একটি বিগ বাজেটের ছবির মাল্টিপ্লেক্সে টিকিটের দাম ২০০ টাকা। ৫০ জন টিকিট কাটলে প্রথম দিনের ব্যবসা ১০ হাজার। এই অঙ্ক ফিফটি ফিটটি ভাগ হয় প্রযোজক এবং হল মালিকের মধ্যে। এক সপ্তাহের জন্য। সাত দিনে ১০০টি স্ক্রিন থেকে প্রযোজকের মোট আয় ৫ লাখ। প্রতি সপ্তাহে এই অঙ্ক কমতে কমতে হয় ৪৫, ৩০ শতাংশ। আড়াই কোটির ছবি থেকে তা হলে প্রযোজকের কতখানি লক্ষ্মীলাভ হবে?”
মার্চ মাসের শেষের থেকেই করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সিনেমা হল। ঠিক যেমন বন্ধ রাখা হয়েছিল শপিং মল, রেস্তরাঁ-সহ বিনোদনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি। বন্ধ ছিল শুটিংও। আনলক পর্বে একে একে মল, রেস্তরাঁ, জিম খুলে গেলেও, শুটিংয়ের সম্মতি মিললেও, সিনেমা হল খোলেনি। যেখানে খান চল্লিশেক বাংলা ছবি মুক্তির অপেক্ষায়, সেইখানে হল না খোলায় ক্রমশই অসন্তোষ বাড়ছিল হল মালিকদের মধ্যে। এই অবস্থায় গতকালের ঘোষণায় হাসছে শিল্পীমহল। রাজ চক্রবর্তী থেকে শ্রাবন্তী, পরমব্রত থেকে অনির্বাণ, খুশি সকলেই। উচ্ছাস মাখা গলায় শ্রাবন্তী বললেন, “আমি নিজেই সিনেমা দেখতে এত ভালবাসি। কী আনন্দ হচ্ছে। আমার নিজেরই কতগুলো ছবি মুক্তির অপেক্ষায়! রোশনকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব। নিজেরও, অন্যদেররও... উফফফফ। কতদিন পর...।”
‘কাকাবাবু’-কে এখনই বড় পর্দায় নিয়ে আসা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
হল খুলছে ঠিকই, কিন্তু ওই পঞ্চাশ জন দর্শক নিয়ে হল খোলার ঘটনায় কিছুটা বিভ্রান্ত শিল্পীমহল। যে কয়েকটি প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা হল, “কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজ্যের এই নির্দেশ খারিজ করে দেয় তা হলে?”, “অন্য রাজ্যে যেহেতু হল খুলছে না, সেহেতু শুধুমাত্র বাংলা ছবির কনটেন্টের উপর নির্ভর করে কতটা লক্ষীলাভ হবে ইন্ডাস্ট্রির?” ও দিকে আবার এই ‘পঞ্চাশ কিসসায়’ বিগ বাজেট ছবিগুলো যে এখনই বাজারে আসছে না, সে ইঙ্গিত মোটামুটি দিয়েই রেখেছেন পরিচালক-প্রযোজকরা। সে ক্ষেত্রে ‘গৌরি সেন’টি কে হবেন?
আরও পড়ুন: ১০০ পর্বে ‘রান্নাবান্না’! সুপারহিট ‘মাম্মি’ অপরাজিতা
একেবারে কিছু না হওয়ার থেকে কিছু হওয়া তো ভাল
অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন। হল খোলার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে থিয়েটারের কথাও মাথায় রেখে তাঁর বক্তব্য, “ইতিবাচক পদক্ষেপ। সত্যিই ভাল লাগছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা শুনে। কিন্তু একটা জায়গার ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। ৫০ জন পার্টিসিপেন্ট বলতে মুখ্যমন্ত্রী কী বোঝাতে চেয়েছেন? দর্শক, অভিনেতা নিয়ে ৫০ জন? তাহলে ব্যবসার কী হবে? টিকিটের দাম কত হবে? ২০০ টাকার টিকিট ৪০০ টাকা? দর্শক আসবেন তো দেখতে? সিনেমা হলেও যদি ৩৫০-র সিটে ৫০ জন বসেন, বাজেট উঠবে? মনে হচ্ছে, এই দিকটি আরেক বার মুখ্যমন্ত্রী বিবেচনা করলে ভাল হয়।” যদিও পরিচালক অরিন্দম শীল এ ব্যাপারে বলছেন, “একেবারে কিছু না হওয়ার থেকে কিছু হওয়া তো ভাল।” হল খোলার আনন্দে ইতিমধ্যেই নিজের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে একটি ভিডিয়োও পোস্ট করেছেন তিনি। অন্য দিকে ইন্ডাস্ট্রির আর এক প্রযোজনা সংস্থা সুরিন্দর ফিল্মসের কর্ণধার নিসপাল সিংহ রানে জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন তিনি এবং তাঁর সংস্থা। আগামিকাল ডিস্ট্রিবিউটর, এগজিবিটরদের নিয়ে মিটিং রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক হবে পরবর্তী পদক্ষেপ। প্রসঙ্গত সুরিন্দরের প্রযোজনায় সৌকর্য ঘোষালের পরিচালনায় ‘রক্তরহস্য’ ১০ এপ্রিল মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও তা করোনার কারণে পিছিয়ে যায়। রানে জানালেন, পুজোতে হলে দেখা যেতে পারে সেই ছবিও।
পুজোয় মুক্তি পেতে পারে কোয়েল মল্লিক অভিনীত ‘রক্তরহস্য’
৫০ জনের জায়গায় ৫০ শতাংশর অনুমতি কেন নয়?
যদিও প্রেক্ষাগৃহ খোলার ঘোষণা হলেও তা করোনাকালে সতর্কতাবিধি মেনে চালানোর গাইডলাইন এখনও হাতে আসেনি হলকর্তাদের। তবু কাল মুখ্যমন্ত্রীর টুইটের পর থেকেই হলমালিকেরা ময়দানে নেমে পড়েছেন। জয়া সিনেমার কর্ণধার মনোজিৎ বণিক যেমন বলছিলেন, “লকডাউনে স্টাফেরা সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের সবাইকে একে একে খবর দিচ্ছি।” অন্য দিকে অশোকা সিনেমা হলের মালিক প্রবীর রায় জানালেন, “ সরকারি গাইডলাউইন না পাওয়া গেলেও আমরা আমাদের মতো করে ইতিমধ্যেই হল পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে দিয়েছি। এত দিন বন্ধ ছিল। আবার খুলবে। সবাই আসবেন। এর চেয়ে ভাল খবর আর কী-ই বা হতে পারে?” যদিও ওই দুই হলমালিককেই যে চিন্তা বারে বারে ভোগাচ্ছে তা হল, ওই ‘পঞ্চাশ’ জনের ব্যাপারটি। লেকটাউন জয়ায় দুই স্ক্রিনে আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৭৭২ এবং ৪৪২। সে জায়গায় ৫০ জনকে নিয়ে একটা শো চালানো যে ক্ষতি তা মেনে নিচ্ছেন মনোজিৎ। তাঁর কথায়, “শুধু সিনেমা চালিয়ে দিলাম, তা তো নয়। এসি’র খরচ আছে, স্যানিটাইজেশনে খরচ আছে, কর্মচারীদের মাইনে আছে। ৫০ জনের জায়গায় যদি ৫০ শতাংশর অনুমতি দেওয়া হয়, তবে বড্ড ভাল হয়।”
আরও পড়ুন: একসঙ্গে না থাকলেও বাবা-ই সঙ্গীতজীবনের অনুপ্রেরণা, কুমার শানুর ছেলে এ বার বিগ বস-এ
হলে বসে পুরনো ছবি!
এত সবের মধ্যেই যে প্রশ্নটি বার বার আসছে তা হল, অন্যান্য রাজ্য ছাড়া যদি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই সিনেমা হল খোলার অনুমতি মেলে সেক্ষেত্রে বলিউড এবং হলিউড ছবির মুক্তি কি আদৌ হবে এই রাজ্যে? কোনও প্রযোজক কি বাকি রাজ্য ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে তাঁর ছবি মুক্তির ব্যবস্থা করবেন? হলমালিকদের একাংশ বলছেন, “সে ক্ষেত্রে পুরনো ছবিই চালাতে হবে।” পাশপাশি তাঁদের আশঙ্কা, পুরনো ছবি চালালে পয়সা খরচ করে দর্শক দেখবেনই বা কেন? প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত যদিও এই বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি জানালেন “কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সম্মতি না পাওয়া গেলে এই মুহূর্তে এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা করে লাভ নেই। সব ঠিকঠাক হলে তখন সে নিয়ে আলোচনা করা যাবে।১ অক্টোবর থেকেই হল খুলে দেওয়া সহজ নয়। শুনছি, কিছু হল ৯ অক্টোবর খুলবে, কয়েকটি তারও পরে, ১৬ তারিখ। ”
পঞ্চাশ জন দর্শক নিয়ে হল খোলার ঘটনায় কিছুটা বিভ্রান্ত শিল্পীমহল।
প্রথম পদক্ষেপই বড় নিয়ে নিলে আগামী দিন কতটা সুরক্ষিত?
’৫০ প্রসঙ্গে' ইন্ডাস্ট্রিতে যখন নানা মত, তখন অভিনেতা-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবছেন। তাঁর সোজাসাপটা উত্তর, “একদম সব বন্ধ ছিল অতিমারির কারণে। সেখান থেকে একটু একটু করে আবার স্বাভাবিক হওয়ার পথে সবাই। আমি বলি কি, একটু একটু করেই না হয় সামনের দিকে এগোই? তাহলে আনন্দ বজায় থাকবে। প্রথম পদক্ষেপই বড় নিয়ে নিলে আগামী দিন কতটা সুরক্ষিত থাকবে, সেটাও কিন্তু ভাবনার বিষয়।” একই কথা বললেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রযোজনা সংস্থা ‘উইন্ডোজ’-এর ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন’ মুক্তির মাত্র দশ দিন পরেই করোনার কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। অথচ ঋতাভরী-সোহম অভিনীত ওই ছবি কিন্তু বক্স অফিসে বেশ ভালই ব্যবসা করছিল মুক্তির পর থেকে। শিবপ্রসাদ জানালেন, “এই মুহূর্তে বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে আমাদের খানিক অন্য ভাবে ভাবতে হবে। যেখানে একজন লোকও আসতেন না সেখানে ৫০জন লোক আসবেন... এটাই তো একটা বড় ব্যাপার। সেখান থেকে হয়তো ১০০জন হবে। আরও বেশি... আরও বেশি... আমার মনে হয় খুব ধীরে ভাবনাচিন্তা করে এগনো উচিত।”
মাঝে মাত্র চার দিন নানা প্রশ্নের মধ্যেই আপাতত হল খোলার সিদ্ধান্তে খুশি সবাই। চার দিনের প্রস্তুতিতে যে হল খোলা সম্ভব নয় সে কথা জানিয়েই হল মালিকেরা আশ্বাস দিয়েছেন পরের সপ্তাহের মধ্যেই হল খুলবেন তাঁরা। পাশপাশি তাঁদের অনুরোধ, দর্শক সংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা যেন আরও খানিক বিবেচনা করা হয়, বাড়ানো হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy