২৮তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের পোস্টার-হোর্ডিংয়ে শুধু সাদা-কালো রঙের ব্যবহার কেন? ছবি: সংগৃহীত।
চার্লি চ্যাপলিনের পাশে বসে রয়েছে ‘পথের পাঁচালী’র অপু! ফরেস্ট গাম্পের সঙ্গে একই বেঞ্চে শাল জড়িয়ে বসে ফেলুদা! আর অড্রি হেপবার্নের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন বাংলা ছবির মহানায়ক!
কলকাতা শহর জুড়ে সাদা-কালো কিছু ছবি। প্রতিটিই চেনা, আবার অচেনাও বটে। চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’ ছবির পোস্টারে বসে আছে ‘পথের পাঁচালী’র অপু। অড্রি হেপবার্নের ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’র একটি বিখ্যাত দৃশ্য মিশেছে উত্তমকুমারের ‘নায়ক’-এর আরও একটি বিখ্যাত দৃশ্যে। ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর পার্কের বেঞ্চে টম হ্যাঙ্কসের সঙ্গে গল্প করতে পৌঁছে গিয়েছেন ফেলুদাবেশী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
বাংলার ছবির আলাপ পরিচয় হচ্ছে বিশ্বসিনেমার সঙ্গে। যে ছবি বলছে, ‘বিশ্ব মেলে ছবির মেলায়’। ছবির কোন মেলা? ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এই ছবিগুলি বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ফরওয়ার্ড করে আলোচনা শুরু করেছেন। বাদ পড়েনি টলিউডও। বহু তারকাই এই বিজ্ঞাপনী প্রচারের প্রশংসা করেছেন। তরুণ অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমার বেশ মজার লেগেছে বিষয়টা। যেমন ‘গ্র্যান্ড বুডাপেস্ট হোটেল’-এর রেফ ফাইন্জ অভিনীত একটি দৃশ্যের সঙ্গে রবি ঘোষের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবির একটি দৃশ্য মেলানো হয়েছে। দারুণ ভাবনা! এটা তো এক ধরনের প্রচার। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। এই বিজ্ঞাপনী প্রচারটা দারুণ! শহরের অনেক মানুষ এখনও এই উৎসব নিয়ে সব কিছু জানেন না। তাঁদের চোখে পড়বে।’’ এক মত পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বললেন, ‘‘কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অনেক দিন পর বেশ বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া দেখলাম। চ্যাপলিনের সঙ্গে অপু, দেশি-বিদেশি নানা চরিত্রের মিলমিশ, বেশ শৈল্পিক ব্যাপার। ভাল লাগল।’’
এই প্রচারের ভাবনা ভেবেছে যে বিজ্ঞাপনী সংস্থা, সেই ‘জেনেসিস’-এর কর্ণধার উজ্জ্বল সিন্হার কথায়, ‘‘সিনেমা জিনিসটা আদতে হল জীবনের এক্সপ্রেশন। আমাদের মূল ভাবনাটা সেটাই। সহজ-সরল। সিনেমা মানুষের কথা বলে। আমরা বলতে চেয়েছি, সারা দুনিয়ার মানুষের কথা আসলে একই রকম। ভাষা পাল্টে যায়। পরিবেশ পাল্টে যায়। প্রেক্ষিত পাল্টে যায়। কিন্তু যেটা পাল্টায় না, সেটা হল আবেগ। পাল্টায় না মানুষের প্রকাশের অভিব্যক্তি। জীবনের খাতা সারা পৃথিবীতেই সমান। জীবনের নবরস নিয়েই সর্বত্র মানুষ থাকে। যেমন সাতটা সুর দিয়েই গান তৈরি হয়।’’
পরিচালক-অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ভাল লেগেছে এই ভাবনা। কারণ, তাঁর কথায়, ‘‘এই ভাবনার পিছনে এক ধরনের মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। কোথাও যেন এগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভাষা কখনওই সিনেমাকে আটকে রাখতে পারে না। সিনেমা কোনও দেশ, কোনও অঞ্চলে বাধা পড়ে না। সিনেমা মূলত একটা আর্ট ফর্ম। শুধু কত দিলাম আর কত পেলামের হিসাব মেলাতে গিয়ে সেটা যেন আমরা ভুলতে বসেছিলাম। এই পোস্টারগুলো সে কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে।’’
চ্যাপলিন আর অপুর ছবির পোস্টার-হোর্ডিংয়ে শহর ছেয়ে গিয়েছে। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচনাও হচ্ছে ওই পোস্টারটি নিয়েই। পরিচালক-অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও জানাচ্ছেন, সবচেয়ে নজর কেড়েছে ওই পোস্টারটিই। তাঁর কথায়, ‘‘হোর্ডিংগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। সবচেয়ে নজর কেড়েছে চার্লি চ্যাপলিন এবং অপুর পাশাপাশি বসে থাকা। এই বিষয়টাকে যে ভাবে তুলে ধরা হয়েছে তাতে আমার ধারণা বাংলা সিনেমার সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা পৃথিবীর সিনেমা এক জায়গায় করার উদ্দেশ্যেই তো চলচ্চিত্র উৎসব।’’
কেন চ্যাপলিন-অপু পাশাপাশি? উজ্জ্বলের জবাব, ‘‘দু’জনেই শাশ্বত নাগরিক। মেকি নয়। খুব আসল এবং বাস্তব। আবার টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ফরেস্ট গাম্পের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। এক দিকে যে তুখোড় দৌড়োয়। আবার শারাীরিক ভাবে সে খানিকটা বাধাবন্ধের মধ্যে থাকে। অন্য দিকে, ফেলুদা একটা অসম্ভব ধারালো মগজের অধিকারী। কিন্তু দু’জনকেই হঠাৎ আমরা প্রায় একই রকমের ভাবুক ভঙ্গিতে দেখি। সেটা একটা নতুন গল্প তৈরি করে। সিনেমা তো মন্তাজ। দুটো আলাদা গল্প মিলিয়ে একটা নতুন গল্প বলা। এই প্রচারে সেটাই বলা হয়েছে।’’
যা দেখে আনন্দিত অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘সেদিন দেখলাম সৌমিত্রকাকু আর টম হ্যাঙ্কস পাশাপাশি। এটাই তো মিলনবার্তা। এটা ভেবেই তো ভাল লাগে। এমন প্রচেষ্টাই তো হওয়া উচিত। সারা শহর জুড়ে প্রতিটা হোর্ডিং পৃথিবীর চলচ্চিত্রকে এক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। এ তো আনন্দের। আমাদের সকলেরই তো এই একই লক্ষ্য হওয়া উচিত।’’
কিন্তু পোস্টার-হোর্ডিংয়ে শুধু সাদা-কালো রঙের ব্যবহার কেন? উজ্জ্বল বলছেন, ‘‘যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করেছি, তার বেশির ভাগই সাদা-কালো যুগের। কিন্তু একই সঙ্গে একটা সমান জমিও তৈরি করতে চেয়েছি। যাতে সেখানে পৌঁছতে অন্য কোনও রং বাধা হয়ে না-দাঁড়ায়।’’
তবে চ্যাপলিন-অপুর পাশাপাশিই আছে অমিতাভ বচ্চন-আল পাচিনোর পোস্টারও। যা দেখে ভাল লেগেছে পরিচালক তথাগতের। যিনি বলছেন, ‘‘বিশ্বসিনেমার পাশে আমাদের সিনেমার অভিনেতাদের ছবি দেখে বেশ আনন্দ হচ্ছে। এই পোস্টারগুলোয় যে বাংলা সিনেমা অংশ হতে পেরেছে, তাতেই মনে হচ্ছে বিশ্বসিনেমার বিরাট জগৎটা যেন ছুঁয়ে ফেলা গেল! রাস্তায় যত বার পোস্টারগুলো দেখেছি, খুব আনন্দ হয়েছে।’’
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিজ্ঞাপনী প্রচার নিয়ে হইচই অবশ্য আগেও হয়েছে। কোভিডের পর ২০২১ সালে যখন আবার চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয়েছিল, তখনও বিজ্ঞাপনী প্রচার নজর কেড়েছিল শহরবাসীর। সে বছর কোভিডবিধি মেনে নিরাপদে ছবি দেখানোই ছিল আয়োজকদের অন্যতম লক্ষ্য। তাই পোস্টারের বিভিন্ন বিখ্যাত চরিত্রের মুখে ছিল মাস্ক। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানের দৃশ্যে উত্তম-সুচিত্রার মুখে মাস্ক।
এ বছর যেমন শহর ছেয়ে গিয়েছে অপু-চ্যাপলিনের ছবিতে। যা বলতে চাইছে— আসুন, বিশ্বসিনেমাকে উদ্যাপন করি। কী ভাবে? এই কথাটা বলে যে, আমরা আসলে ভিতরে ভিতরে খুব একই রকম। সে অপু-চ্যাপলিন হোক বা সৌমিত্র-টম অথবা অমিতাভ বচ্চন-আল পাচিনো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy