ফিরছি কলকাতায় গরমে তেতে, পুড়ে, সেঁকে, ভাজা ভাজা হয়ে। শ্যুটিংয়ের প্রথম পর্ব শেষ করে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর বেনারস থেকে। ফ্লাইটের স্টুয়ার্টের কাছ থেকে কিছু পাতা চেয়ে আমতা আমতা করে খুব সংকোচে শুরু করলাম আমার প্রথম ব্লগ!
কত ইতিহাস, কত বিস্ময়কর চরিত্র এই শহরের! পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক ছুটে আসে শুধুই বেনারস দেখবে বলে। পুরাণে আছে শিব-পার্বতীর বাসস্থান এই কাশী। অনেকের বিশ্বাস এখনও তাঁরা নিত্য বিরাজমান। আবার অনেকে বলে রাজা সুভদ্রর পুত্র কাশ্য এই নগর স্থাপন করেন। তার থেকেই কাশীর নামকরণ হয়। আর এক মত, বরুণা আর অসি নদী গঙ্গায় মিশেছে। এবং এই দুই নদীর মধ্যে অবস্থিত বলে কাশীর আর এক নাম বারাণসী।
এখানকার বৈশিষ্ট্য একমাত্র এখানেই গঙ্গা উত্তরবাহিনী। ফাইটের চেজ সিকোয়েন্সে বহু গলিতে উর্ধ্বশ্বাস দৌড়োতে গিয়ে বেশ কয়েকটা মন্দির নজরে পড়ল। দম নেওয়ার জন্য একটু চাতাল কিংবা দালানে বসে উঁকিঝুঁকি মেরে বুঝলাম বেশির ভাগ বাড়িতেই প্রায় মন্দির। হাজারেরও বেশি মন্দির নাকি এক সময় ছিল। তার মধ্যে প্রধান বিশ্বনাথের মন্দির—গেছিলাম একদিন আরতির সময়। কী প্রচুর তার আয়োজন। স্তোত্র আর ঘণ্টার শব্দ মুগ্ধ করেছিল আমায়। শুনলাম এক সময় ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এই মন্দির। পরবর্তী সময় রানি অহল্যাবাঈ এই মন্দির আবার মতুন করে নির্মাণ করেন। শ্যুটিংয়ের মাঝে রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জন্মস্থান দেখলাম। আর গেলাম মদন মোহন মালবীয়র প্রতিষ্ঠা করা বিখ্যাত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে।
চেতসিংহ মহলে একটা গানের দৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে জানতে পারলাম রাতে নাকি কোনও এক বাইজির ঘুঙুরের আওয়াজ এখনও শোনা যায়। মেক আপ রিটাচের মাঝে অশরীরী কেউ যেন আমায় সর্বক্ষণ দেখছে! আরে কোনও মানে হয়! শ্যুট করতে গেছি রোম্যান্টিক গান তার মধ্যে আবার ‘ওহ কৌন থি’ গোছের অনুভূতি হলে প্রেমের এক্সপ্রেশন হবে কী করে?
অসি ঘাটে বেশ কিছু দিন শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে এক সাধুর সঙ্গে চোখাচোখি হত। একটু হাসতেন, তার পর আবার তাঁর নিজের ঘোরে গম্ভীর। যেন জীবনটা সময়বদ্ধ নয়। তার চেয়ে অনেক বড়। ওখানে কত সাধু শিবের আরাধনায় মগ্ন। জীবনে কোনও মায়া নেই, মোহ নেই, পার্থিব কোনও চাহিদা নেই। শুধু ঈশ্বরের নামে কত সহজে যেন জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
বেনারসের সম্পর্কে বলতে গেলে ঘাটের কথা অবশ্যই বলতে হয়। তার সৌন্দর্যই আলাদা। যেন তিন হাজার বছর আগে সময়ের কাঁটা আটকে গেছে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় প্যাক আপের পর তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়লাম অসি ঘাট থেকে। গঙ্গাপথে সোজা চলে গেলাম দশাশ্বমেধ ঘাটে। কাশীর আশিটি ঘাটের মধ্যে এটি প্রধান ঘাট। প্রচুর নৌকোর ভিড়ে দাঁড়ালো আমাদের নৌকো। বিশাল প্রদীপের আলোর ছটায় জ্বলজ্বল করে উঠেছিল সেদিনের ঘাট। বলা হয়, ব্রহ্মা এখানে দশটা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
তার একটু দূরেই মণিকর্ণিকা ঘাট। শুনেছি পার্বতীর কুণ্ডল পড়েছিল সেখানে। চব্বিশ ঘণ্টা শবদাহ হয়। তাতে নাকি আত্মা স্বর্গবাসী হয় এমনটাই ধারণা। নৌকো থেকে আলোআঁধারির মধ্যে দূর থেকে দেখা যায় কত জ্বলন্ত চিতা। দূরের বাড়িতে মৃত্যু পথযাত্রীদের এনে রাখা হয় শেষ দিনের অপেক্ষায়। সত্যি বলতে সেখানে গিয়ে যথেষ্ট গা ছমছম করে ছিল আমার। নানা ঘাট ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছালাম তুলসী ঘাটে। তুলসীদাসজি নাকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন সেখানে বসে। নানা সময়ে এই ঘাটগুলির নানা চিত্র ভেসে ওঠে—সকালে সে যেন সদ্যোস্নাত রমণী। দুপুরে আবার লাল বেনারসি পরা নতুন বউ। ঠোঁটে তার প্রেমের হাসি। আবার সন্ধ্যাবেলায় বিষাদে ভরে ওঠে ঘাট। যেন সে তার স্বামীকে হারিয়েছে।
সত্যি তো বেনারসের গল্প শুরু করলে শেষ হয় না। দ্বারভাঙা ঘাটে শ্যুট করতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছিল মগনলাল মেঘরাজের বজরায় আসার সিনটা। আবার কোনও সময়ে ‘অপরাজিত’ ছবির বহু দৃশ্য।
‘‘আর সংসার ভাল লাগে না, আমাকে কাশীতে নিয়ে চল বাবা’’ পড়েছি কত সাহিত্যে, দেখেছি কত সিনেমায়। আমার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটল। খুব যত্ন নিয়ে সংসার করছি, দারুণ লাগছেও করতে। আবার এও বলব কাশী গিয়েই খুব ভালবেসে ফেললাম এই শহরটাকে।
এ বার আপনাদেরও বলি ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার মেজাজ যদি থাকে ঘুরে আসুন বেনারস।
হলফ করে বলতে পারি খুব আনন্দ পাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy