প্রয়াত তাপস পাল। ফাইল চিত্র।
প্রয়াত অভিনেতা ও প্রাক্তন সাংসদ তাপস পাল। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় এই অভিনেতা মঙ্গলবার ভোরে মুম্বইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।
দীর্ঘদিন ধরেই স্নায়ু এবং রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। চলছিল নিয়মিত চিকিৎসাও। সম্প্রতি মুম্বই গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে হঠাৎই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন । ভর্তি করা হয় মুম্বইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। কিছুটা সুস্থ হওয়ায় ৬ ফেব্রুয়ারি ভেন্টিলেশন থেকে বার করা হয় তাঁকে। সোমবার তাঁর কলকাতা ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু মুম্বই বিমানবন্দরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই মঙ্গলবার ভোররাত ৩.৩৫ নাগাদ মারা যান অভিনেতা।
বাংলা ছবিতে তিনি ছিলেন যেন সেই পরিচিত পাশের বাড়ির ছেলে। চন্দননগর থেকে উঠে আসা এক অপরাজেয় নায়ক। আজও বাঙালি দর্শক বার বার সেই ‘দাদার কীর্তি’র তাপসকে মনে করেন। সেই ছবিতে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর নিপাট ভালমানুষি, যাকে হয়তো আমরা ‘বোকামি’ বলে পরিহাস করে থাকি। কিন্তু তা আজও প্রেমের বার্তা দিয়ে ফেরে। এখানেই বোধহয় তাপস পালের অভিনয়ের দক্ষতা। যা দেখে চিরঞ্জিত চক্রবর্তী পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘‘তাপস পাল ‘দাদার কীর্তি’তে যে অভিনয় করেছেন তা আমি করতে পারতাম না।’’ ‘দাদার কীর্তি’র মতো ‘সাহেব’ ছবিতেও তিনি উজ্জ্বল। বার বার এমন চরিত্র নির্বাচন করছেন, যা বাংলার তথাকথিত ‘হিরোইজম’কে ভেঙে দিয়েছে। এই স্বাভাবিক, সারল্যই ছিল তাপস পালের ইউএসপি। যে কারণে তাঁর একের পর এক পারিবারিক ছবি হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বাংলার ‘কমার্শিয়াল ছবি’। এক দিকে নিপাট সারল্য অন্য দিকে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে বীরত্ব প্রদর্শন করে নায়িকাকে উদ্ধার। এমন বহু দৃশ্যে তিনি অভিনেতা থেকে স্টার হয়ে উঠেছিলেন। এই কর্মাশিয়াল স্টারকে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালক। দর্শক দেখেছে ‘উত্তরা’ বা ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছবিতে তাঁর অসামান্য অভিনয়।
শুধু কি তাই? তাঁর সহজিয়া অভিনয় তাঁকে আরব সাগরেও টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৪তে হীরেন নাগের ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত। রাখি গুলজারের সঙ্গেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু তাপস পাল পুরোদস্তুর বাংলার অভিনেতা। কলকাতায় তরুণ মজুমদারের ডাকে মুম্বই থেকে কলকাতা ফিরে এসে দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিতে। ১৯৮৫-তে এই ছবি বক্স অফিসে বিপুল সাফল্য এনে দেয়।
আরও পড়ুন: ‘অভিনয় ও রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় ক্ষতি’, তাপস পালের প্রয়াণে শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
বাংলা ছবিতে তৈরি হয় দেবশ্রী-তাপস জুটি। একে একে বাড়তে থাকে ছবির তালিকা। ‘অর্পণ’, ‘সুরের সাথী’, ‘সুরের আকাশে’, ‘নয়নমণি’, ‘চোখের আলোয়’, ‘তবু মনে রেখো’। তপন সিংহ থেকে অঞ্জন চৌধুরী, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় থেকে তরুণ মজুমদার আশি থেকে নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রেম, অভিমান, অনুরাগ এবং লড়াই— বাঙালির সমস্ত আবেগের মিশেল সেই তাপস পাল।
পরবর্তীকালে দেবশ্রী পেরিয়ে শতাব্দীর সঙ্গে জুটি বাঁধেন এই নায়ক। হরনাথ চক্রবর্তী, তরুণ মজুমদারের হাত ধরে এই জুটির ম্যাজিক ক্লিক করে বক্স অফিসে। শুধু শতাব্দী বা দেবশ্রী নয় ইন্দ্রাণী হালদার থেকে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। দেবাদিত্যের ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবিতে শেষ বারের মতো দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
রুপোলি পর্দার নায়ক থেকে প্রথমে বিধানসভা এবং পরে পরে সংসদের গণ্ডিতে পা রাখেন তাপস পাল। ২০০৯ সালে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ওই বছর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের টিকিটে কৃষ্ণনগর থেকে জিতে সাংসদ হন তাপস পাল। নানা মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে রোজভ্যালি কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁকে গ্রেফতারও করে সিবিআই। শেষ পর্যন্ত অভিনয়ের চেনা জগতেও ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতা তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল সবার অলক্ষ্যে।
আরও পড়ুন: ভেনিসের রাস্তায় নাচতে শুরু করল তাপস, মনে পড়ল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের
সামনেই দোল। বসন্তের মন কেমন করা হাওয়ায় ভরে গিয়েছে শহর। ‘দাদার কীর্তি’র ‘কেদার’ আবার পথে নামবেন রং মাখতে। কিন্তু বাস্তব ‘কেদারের’ জীবনে ইতি টেনে দিল এই বসন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy