Advertisement
০৭ জুলাই ২০২৪
Manikbabur Megh

মনগুলোকে প্রায় শেষ করেছি, সব বিষয়ে মতামত, এই বিশৃঙ্খলতার মাঝে ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছায়ার মতো

‘মানিকবাবুর মেঘ’ কিন্তু কোনও কঠিন ছবি নয়। আমিও কিছু বিরাট বোদ্ধা নই। এই ছবি একেবারে জলবৎ তরলং।

Image of Chandan Sen

মানিকবাবুর মেঘ ছবিতে চন্দন সেন। ছবি: সংগৃহীত।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ ১০:৫৭
Share: Save:

আমি নাকি বাংলা ছবির উপস্থাপক হব! সঙ্গে সেই ছবির জন্য আমায় একটা গানও গাইতে হবে, এক সকালে এমনই এক প্রস্তাব এসেছিল বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। বৌদ্ধায়নদাকে খুবই পছন্দ করি আমি মানুষ হিসেবে, পরিচালক হিসেবে। আমি ওঁর সঙ্গে কাজও করেছি ‘২৫১’ নামের এক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে। বৌদ্ধায়নদার ‘তিন কাহন’, ‘ভায়োলিন প্লেয়ার’ দেখেছি। ওঁর পরিচালনার প্রতি আমার একটা ভাল লাগা আগে থেকেই ছিল। আর গান গাইতে আমি সব সময় রাজি, তাই গান গাওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ভালই লেগেছিল। কিন্তু এরই সঙ্গে আমি ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিটা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি।

এখানে বলে রাখা ভাল, আমি ছবিটা দেখে তবেই যে ছবির উপস্থাপক হিসেবে নিজের নাম জড়াব, এমন ভাবনা থেকে কিন্তু ছবি দেখতে চাইনি। আমার কাছে আগে থেকেই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ নিয়ে খবরাখবর ছিল। যখন এই ছবির পরিচালক অভিনন্দন ট্যালিন ব্ল্যাক নাইটস চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটা নিয়ে যায়, তার আগে আমি পঞ্চাশ দিন ওখানেই ছিলাম, ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবির কাজের জন্য। ফলে আমি ছবি সম্পর্কে টুকটাক লেখা পড়তে থাকি। চন্দনদা (সেন) যখন ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর জন্য মস্কোয় পুরস্কার পান তখন সেই খবরও আসে আমার কাছে। এই পুরস্কার একজন বাঙালি অভিনেতার জন্য অনেক দিন পরে একটা আন্তর্জাতিক গর্বের বিষয়। গল্পটা সম্পর্কেও আমার একটা ধারণা ছিল, সেটা চন্দনদাই আমায় বলেছিল।

ছবি দেখতে চাওয়ায় বৌদ্ধায়নদা আমায় পাঠিয়ে তো দিল। কিন্তু আমাদের তো চাষার জীবন, আমি শুটিং করেই চলেছি। ছবি দেখার সময় পাচ্ছি না। অবশেষে একদিন দেখলাম। আমাকে ছবিটা খুবই প্রভাবিত করল। এমনই প্রভাবিত করল যে, ছবি দেখার পরে পরে বৌদ্ধায়নদাকে কিছু জানাতেও পারিনি। পরে জানালাম ছবিটা অসম্ভব ভাল লেগেছে। যখন মুম্বইতে গান রেকর্ড করতে গেলাম, বুঝেছিলাম ছবির পরিচালক অভিনন্দন খুব উন্মুখ হয়েছিল আমার ছবি কেমন লাগল সে বিষয় নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু আমি ওকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি, ছবি কোন ক্যামেরায় শুট করলে, সাদাকালো কেন রাখলে? ওটা কেন এ রকম করলে? পারিনি…

যে সময় এই ছবি দেখলাম, সেই সময়টা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভারতের ছবি এখন মানুষের গল্প থেকে অনেক সরে গিয়েছে। আগেও ছিল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ছবি। এখনও তাই। বাংলা ছবিও যেমন গোয়েন্দা, থ্রিলার, রমকম সব নিয়ে শুধু মানুষের গল্প থেকে সরে যাচ্ছে। তবে আমি এটাও মানি, প্রতি বছর যে বিভিন্ন ধারা নিয়ে একের পর এক বাংলা ছবি হাজির হয়, সেটা বৈচিত্রময়। এই যে ধারা চলছে তার ‘অ্যাড্রিনালিন অ্যাপিল’ একটু বেশি। গতিময়তা বেশি। সেখানে ‘মানিকবাবুর মেঘ’ আমার কাছে গাছের ছায়ার মতো। মনে হল, অনেক রোদের পর আমি গ্রামে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছি। ফিনফিন করে হাওয়া দিচ্ছে। পাতাগুলো নড়ছে। মানুষ, মানুষের গল্প দেখছি। আমি মনে করি সিনেমা হচ্ছে মানুষের শিল্প। বহুদিন আগে চঞ্চল চৌধুরী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ছবিতে অনেক দিন পরে একটা সুযোগ এসছে যখন মানুষের গল্প বলা যাচ্ছে। সেই সুযোগ অবশ্য ভোগবাদী দুনিয়ায় সর্বদা টলমল করে!

তবে একটা কথা বলে রাখি, ‘মানিকবাবুর মেঘ’ কিন্তু কোনও কঠিন ছবি নয়। আমিও কিছু বিরাট বোদ্ধা নই। এই ছবি একেবারে জলবৎ তরলং। মাথা খাটিয়ে, ‘কী হল?’ এই ভাবনা কিন্তু ছবি দেখে আসবে না। সিনেমার শর্তে যদি আমার মনকে সঁপে দিই, তা হলে এই ছবি প্রভাব ফেলবে। কী প্রভাব? এক এক মানুষের কাছে এক এক রকম হবে। এই ছবিতে চন্দন সেন, ক্যামেরা, শব্দ, আলো, লয় সব একসঙ্গে লেগে আছে। কেউ আলাদা নয়।

আমাদের এখন ছবি নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। ক্যামেরা নিয়ে আলাদা কথা, আলো নিয়ে আলাদা কথা, অভিনয় নিয়ে আলাদা… আসলে ইউটিউবে, খবরের কাগজে ছবি নিয়ে বলতে বা লিখতে গেলে জায়গা তো ভরাতে হবে। এই করতে করতে আমরা আমাদের মনগুলোকে প্রায় শেষ করে ফেলেছি। ফলে সহজ, খোলা জানলার মতো মন নিয়ে কিছু দেখতে যেতে পারিই না আর। শুধু সিনেমা নয়, সব বিষয়ে কথা বলা, বক্তব্য রাখা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সব কিছু নিয়ে একটা ‘বনাম’ চলতে থাকে। সম্প্রতি যেমন বাঙালি-অবাঙালি নিয়ে চলছে। এই যে সারা ক্ষণের বিশৃঙ্খল জীবন, তার মাঝেই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ মুক্তি পাচ্ছে। এটা দেখে কারও কান্না পেতে পারে, কেউ হেসে উঠতে পারে, কেউ চুপ করে যেতে পারে। কারও মনে হতে পারে আমি লম্বা রাস্তা ধরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি।

সদ্যই দু’জন পরিচালকের কাছে একটা শব্দ শুনলাম ‘ফ্লক’, মানে, একমুখিতা। আমাদের দেশে রাজনীতি, সংস্কৃতিতে যা চলেছে। আমাদের ভিতরে ছোট ছোট একনায়ক আছে, যে বলে, ‘এটাই একটা, আর কিছু নয়’। একটা সময়, মানে আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন কলকাতায় সব ধারার দর্শক ছিল। মানে বড় কিছু হলে সেই ছবির যেমন দর্শক ছিল, তেমনই ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এরও দর্শক ছিল। আমি বিশ্বাস রাখি, সেই দর্শক কলকাতা শহরে আজও আছেন, যাঁরা এই ছবি দেখতে যাবেন। আর যদি তাঁরা দেখতে যান, আমরা জানতে পারব এই ছবি দেখার দর্শক কলকাতায় আছেন, তাঁদের সংখ্যা কত।

আমি বিশ্বাস করি শুধু ‘মানিকবাবুর মেঘ’ নয়, এই ধারার ছবি, মানুষের গল্প এ ভাবে বলার, এই গতিময়তার ছবি আরও হতে হবে। না হলে কিন্তু আর কখনওই হবে না, আর কখনওই হবে না। আর সেটা না হলে, আমরা কিন্তু সেই একমুখিতায় ছুটতে ছুটতে মুখ থুবড়ে পড়ব! আমাদের একঘেয়েমি আসবে। তখন অন্য কিছু খুঁজে বেড়াব, দেরি হয়ে যাবে। তখন বাংলা ছবি আর কিছুই পাবে না।

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anirban Bhattacharya Chandan Sen Bengali Movie
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE