ভর দুপুরবেলা কুয়ালা লামপুরের বিখ্যাত বুকিত বিনাটাং অঞ্চলে ‘এইচআর’ লেখা কালো বিএমডব্লিউ থেকে নেমে পড়লেন হৃতিক রোশন।
কথা ছিল কোনও শপিং মলে গিয়ে শপিং করবেন, কিন্তু কোথায় কী? হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হল রাস্তার ধারে ফুটপাথের জিনিস কিনবেন। তিন জন বডিগার্ড নিয়ে ফুটপাথেই কেনাকাটা শুরু করলেন সুপারস্টার।
শহরের অন্য প্রান্তে তখন বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন আজকের বলিউডের অন্যতম বড় স্টার রণবীর সিংহ। রিহার্সালে ঢোকার আগে তখন লাঞ্চ সারছেন ভিয়েতনামিজ রেস্টুরেন্টে। তাঁর গার্লফ্রেন্ড দীপিকা পাড়ুকোনকে যিনি কথায় কথায় ‘কুইন অব হার্টস’ বলে সম্বোধন করেন, সেই রণবীরকে নিয়ে তখন সমানে মজা করে চলেছেন তার প্রাণের বন্ধু অর্জুন কপূর।
দীপিকা পাড়ুকোনের বয়ফ্রেন্ডকে যে তিনি কতটা হিংসে করেন সেই গল্প করছেন অর্জুন।
এ সবের মাঝে অনুষ্কা শর্মা, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, ফারহান আখতাররা অবশ্য শপিং বা আড্ডা নিয়ে তত ব্যস্ত নন। তাঁরা ব্যস্ত তাঁদের ছবির প্রিমিয়ার শো নিয়ে।
‘‘কুয়ালা লামপুরের সূর্য মলে ছবির প্রিমিয়ার। ‘দিল ধড়কনে দো’ আমার খুব প্রিয় ছবি। আজকে প্রিমিয়ারে লোকজনের কেমন লাগবে ছবিটা এটা ভেবে একটু টেনশন হচ্ছে,’’ প্রিমিয়ারের দিন সকালে বলছেন ফারহান আখতার।
এক দিকে চূড়ান্ত বিনোদন অন্য দিকে টেনশন।
এক দিকে অ্যাওয়ার্ড শো, অন্য দিকে দেশ থেকে অনেক দূরে এসে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে স্টারদের নির্ভেজাল আড্ডা। এক দিকে রাস্তায় নেমে সুপার স্টারের শপিং, তো অন্য দিকে ডায়েট না মেনে বলিউডের প্রথম সারির নায়িকাদের চিজ অমলেট আর সল্টেড ক্যারামেল আইসক্রিম খাওয়া। এটাই আইফা। যার ষোলোতম সংষ্করণ গত উইকএন্ডে ঘটে গেল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুরে।
আইফা ২০১৫।
দেশের বাইরে বলিউডের ক্ষমতাটা দেখায় আইফা
এক সময় অমিতাভ বচ্চন এবং তাঁর গোটা পরিবার ছিল আইফার অন্যতম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডারস।
কিন্তু ২০১০এ আইফা কর্তাদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির পর তাঁরা আর কেউ আসেন না আইফাতে।
সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে সেই ফাঁকা জায়গাটা নিজের করে নিয়েছেন অনিল কপূর।
সকালে মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং হোক কী বিজনেস ফোরামে প্রধান বক্তা, আইফার সর্বত্র অনিল কপূর।
‘‘আইফা এমন একটা অ্যাওয়ার্ড শো যা দেশের বাইরে বলিউডের ক্ষমতা কতটা বৃহৎ সেটা দেখায়। প্রায় তিরিশ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পর বুঝেছি আরও নতুন নতুন মার্কেটে আমাদের হিন্দি ছবিকে নিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এগোতে পারব। সেটার জন্যই আমি এতটা ইনভল্ভড হয়ে পড়েছি আইফার সঙ্গে,’’ প্রথম দিনের প্রেস কনফারেন্সের আগে বলছিলেন অনিল।
একই বক্তব্য হৃতিক রোশনেরও।
“দেশের বাইরে বলিউডের ক্ষমতা কতটা বৃহৎ সেটা আইফা দেখায়।” —অনিল কপূর।
‘‘আইফা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যার একটা গ্লোবাল অ্যাপিল আছে। আজকের এই যে এত স্পনসর রয়েছে আইফার, সেটা দেখেই বোঝা যায় এটা কত বড় একটা প্রপার্টি। এ রকম একটা অ্যাওয়ার্ড শোয়ের জন্য আমি সব ডেট অ্যাডজাস্ট করতে পারি,’’ নিজের বোনের লেখা বইয়ের উদ্বোধনের কিছুক্ষণ পরে বলছিলেন হৃতিক রোশন।
শেষ মুহূর্তে হেরে যায় তুরস্ক
আসলে হৃতিক, অনিল কপূর একা নন। আইফা নিয়ে হইচই বলিউডের সর্বত্রই। এই মাতামাতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে প্রায় আট-ন’মাস আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের প্রথম সারির আমলা এবং মন্ত্রীরা পৌঁছে যান মুম্বইতে। আইফার সংগঠক উইজক্রাফ্ট-এর অফিস।
‘‘এমনও হয়েছে একজন মন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দেশে আইফা করুন, না হলে আমার চাকরি চলে যাবে। আবার এমনও হয়েছে আইফা না করতে পেরে আমাদের অফিসে বসে একটি দেশের কর্তা হাপুস নয়নে কেঁদেছেন,’’ বলছিলেন আইফার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী।
এত লবিং ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল কী ক্রিকেট নিয়ে নিয়মিত হয়, সেই সম্পর্কে নানা গল্প মিডিয়ার শিরোনামও হয়, কিন্তু আইফা নিয়েও যে এত লবিং হতে পারে সেটা মালয়েশিয়াতে আইফা কর্তার সঙ্গে কথা না বললে জানতে পারতাম না।
এবং এ বছরেও নাকি মালয়েশিয়া আর তুরস্ক শেষ মুহূর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছে।
এটাও শোনা গেল, ২০১৫-র ভেন্যু হিসেবে প্রথম দিকে তুরস্ক এগিয়েওছিল। কিন্তু মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স এমএইচ ৩৭০-এর ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার পরে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করতে মালয়েশিয়ার সরকার এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠে যে তারা অভূতপূর্ব ডিসকাউন্ট দেয় আইফা কর্তাদের। সেই সুবাদেই তুরস্ককে শেষমেশ পিছনে ফেলে দেয় মালয়েশিয়া।
‘‘লবিংটা ইম্পর্ট্যান্ট কারণ, একবার আইফা করলে সে দেশের পর্যটন শিল্পের বিরাট লাভ হয়। প্রচুর ভারতীয় এখন বিদেশ যায় বেড়াতে। যেখানে আইফা হচ্ছে সেখানে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায় পর্যটকদের মধ্যে। সে জন্যই আইফার ভেন্যু নিয়ে এত লবিং,’’ বলছিলেন মুম্বইয়ের প্রথম সারির এক ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্তা।
আইফা হল রিইউনিয়ন
এ সব নিয়ে অবশ্য বিশেষ ভাবতে চান না রিতেশ দেশমুখ, বোমান ইরানিরা।
‘‘কোথায় হচ্ছে সেটা বড় কথা নয়। আইফার আসল মজা হচ্ছে আমাদের রিইউনিয়নটা। মুম্বইতে আমরা সবাই এত ব্যস্ত যে প্রায় দেখাই হয় না। এখানে তিন দিন দারুণ আড্ডা হয়। আমি তো সকাল থেকে হোটেলের ঘরে রিতেশ (দেশমুখ) আর রাজু (হিরানি)র সঙ্গে আড্ডা মেরে চলেছি। এটা আইফার কাছে আমার সবচেয়ে বড় পাওনা,’’ বলছিলেন বোমান ইরানি। বোমান যদি আড্ডা মেরে কাটালেন আইফাতে, তা হলে শপিং করেই প্রায় দু’দিন কাটালেন সোনাক্ষী।
‘‘প্রচুর লম্বা শপিং লিস্ট আমার। সবার জন্য জিনিস নিয়ে যেতে হবে,’’ শপিংয়ে বেরোনোর আগে বলছিলেন শত্রুঘ্ন-কন্যা। সোনাক্ষীর শপিং পার্টনার রিতেশ দেশমুখের স্ত্রী জেনেলিয়া ডি’সুজা ও মালাইকা অরোরা খান।
পরের বছর হয়তো টলিউডও
আড্ডা, শপিংয়ের পাশাপাশি কুয়ালা লামপুরে আইফা আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কুয়ালা লামপুরের আইফা থেকেই বোধহয় অ্যাওয়ার্ড শোগুলোতে বলিউডের ‘চেঞ্জ অব গার্ড’ শুরু হয়ে গেল। শাহরুখ, সলমন নয়, এ বার রণবীর-অর্জুন-বরুণ যুগ।
‘‘আমাদের এবারের থিম হল নতুনদের চান্স দেওয়া। সে জন্যই এ বছর আইফা হোস্ট করল রণবীর সিংহ ও অর্জুন কপূর। ধীরে ধীরে এই নতুন ছেলেরাই যে বলিউডের মুখ হয়ে উঠছে সেটা মাথায় রেখেই আমরা নতুনদের চান্স দিচ্ছি,’’ বলছিলেন উইজক্রাফ্টের বড় কর্তা সাবাস জোসেফ। রণবীর, অর্জুনরা যদি হোস্ট হয়ে থাকেন তা হলে স্টেজ মাতালেন এক ঝাঁক নতুন তারকা। আর মঞ্চেও মাধুরী দীক্ষিত কী রানি মুখোপাধ্যায়ের নস্টালজিয়া নেই।
রয়েছেন সোনাক্ষী, শ্রদ্ধা কপূর, অনুষ্কারা। থাকলেন শাহিদ কপূর এবং ক্লাইম্যাক্সে হৃতিক রোশন।
এ দিকে এ বছর থেকেই আইফা এমন একটা সেগমেন্টও তৈরি করেছে যেখানে পরের বছর আমাদের টলিউডও আইফার মঞ্চে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ বছর আইফা বেস্ট রিজিওনাল ফিল্মের ক্যাটাগরিও শুরু করল। রিতেশ দেশমুখ প্রয়োজিত মরাঠি ছবি পুরস্কার পেয়েছে। কে জানে পরের বছর সৃজিত-কৌশিক-শিবপ্রসাদকে দেখা যাবে কিনা আইফার মঞ্চে?
রাত তখন তিনটে। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার অনুষ্ঠান তখন প্রায় শেষ লগ্নে।
এমন সময়ই অনুরাগ কাশ্যপের হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন শাহিদ। ‘‘উই হ্যাভ টু পার্টি টুগেদার,’’ বলে তাঁরা ঢুকে পড়লেন গাড়িতে। অন্য দিকে অ্যাওয়ার্ড শোয়ের শেষ পারফর্ম্যান্স হৃতিকের নাচ— তখনও হা করে ব্যাকস্টেজ থেকে দেখছেন দীপিকা পাড়ুকোন। হৃতিকের নাচ দেখে ‘‘হোয়াট আ ডান্সার,’’ নিজের মনেই বলে ওঠেন ‘পিকু’।
হৃতিকের নাচ দিয়ে এ বছরের মতো আইফা শেষ।
পরের বছর কোথায় হবে কেউ এখনও জানে না। ‘‘ডিসেম্বরের মধ্যে জেনে যাবেন কোথায় হচ্ছে। কিন্তু যেখানেই হোক আইফা থাকবে আইফাতেই। এক্কেবারে ঝক্কাসসসস,’’ নিজের ভঙ্গিতে বলে বেরিয়ে গেলেন অনিল কপূর।
এখন এক বছরের অপেক্ষা।
তারপর পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে আবার ব্রেকফাস্ট টেবিলে চিজ-অমলেট খেতে খেতে নায়িকাদের গসিপ। ফুটপাথে হয়তো হৃতিকের শপিং। সম্পর্ক তত দিন টিকে থাকলে দীপিকাকে নিয়ে রণবীর সিংহকে খ্যাপানো।
বিদেশে বলিউডের বার্ষিক রিইউনিয়ন।
পোশাকি নাম আইফা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy