Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment News

‘তৃণমূলের সভায় না গেলে আমি বামপন্থী, বামফ্রন্টের সভায় না গেলে তৃণমূল’

ধারাবাহিক, সিনেমা, থিয়েটরের আনাচকানাচ তাঁর চেনা। যে বৃত্তে অর্থ কম, সেই পরিসরকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচেন তিনি। কেন?

কৌশিক সেন।

কৌশিক সেন।

স্রবম্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ ১৪:২৩
Share: Save:

নেওয়ার কথা ছিল সাক্ষাৎকার। শব্দ, ভাবনা আর লড়াইয়ের কথা শুনতে শুনতে তা নিছক প্রশ্ন-উত্তর সাজানো সাক্ষাৎকার রইল না। কৌশিক সেন। অনিশ্চয়তার রাস্তা পেরিয়ে এক জন মানুষ, অভিনেতা, পরিচালক কেমন করে নিজের বোধি আর সত্তা নিয়ে প্রায় তিরিশ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেন? বেরিয়ে এল সেই জীবন।

মৃণাল সেনের পছন্দ হল আমায়

১৯৭৯-এ ফুটবল মাঠ থেকে অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় তাঁকে মৃণাল সেনের কাছে হাজির করেন। মৃণাল সেনের পছন্দ হয়ে যায় তাঁকে। সেখান থেকে চলা শুরু। 'আমি তো পেশাদার। যে রকম কাজ এসেছে করেছি। অনেক নিম্নমানের কাজও করতে হয় আমায় পয়সার জন্য। শুধু থিয়েটার করে তো আর রোজগারের জায়গা মজবুত করা যায় না,’’ বলে ওঠেন কৌশিক।

ফেসবুক থেকে সংসার— আমরা একা!

ধারাবাহিক, সিনেমা, থিয়েটরের আনাচকানাচ তাঁর চেনা। যে বৃত্তে অর্থ কম, সেই পরিসরকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচেন তিনি। কেন?
‘‘সংসারে, রাস্তায়, কাজে, ফেসবুকে আমরা সব্বাই একা। এই একাকিত্ব থিয়েটর মুছে দিতে পারে। ইন্ডিভিজ্যুয়ালিস্টিক জগতে থিয়েটরের মতো কমিউনিটি আর্ট ফর্মের খুব দরকার,’’ অভিজ্ঞতা থেকে বলে ওঠেন কৌশিক। তাঁর ‘স্বপ্নসন্ধানী’ শুধুমাত্র মঞ্চে নাটক করার জন্য সপ্তাহে তিন দিন মিলিত হয়। দলের ছেলেমেয়ে কার ভাবনায় মনখারাপ? কার বাবা অসুস্থ? বাঙালির এক মুঠো পাড়া সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে ‘স্বপ্নসন্ধানী’-তে।
কেউ কেউ ইদানীং ‘স্বপ্নসন্ধানী’-তে যোগ দেন কৌশিক সেনের সঙ্গে কাজ করবেন, তাঁর দলের মাধ্যমে সিনেমায় পৌঁছে যাবেন। বিষয়টা শুনেই সম্মতির সুরে বলেন কৌশিক, ‘‘জানি। তবে আমার বলা আছে, ধারাবাহিক বা সিনেমার জন্য স্বপ্নসন্ধানী-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে লাভ নেই। থিয়েটার শুধুমাত্র ধারাবাহিক বা সিনেমায় অভিনেতাদের যোগান দেওয়ার জন্য তো তৈরি হয়নি।’’
নিজের পছন্দ হলে দলের অভিনেতাদের কাজের কথা তিনি নিজেই বলেন। তাঁর দলের প্রায় সত্তর শতাংশ ছেলেমেয়ে এখন ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন।

আরও পড়ুন, টানা ১৪ ঘণ্টা ধরে মেকআপ, নাম্বি নারায়ণনের ভূমিকায় কে এই অভিনেতা?

রজতাভ দত্তকে চাইলেন তপন সিংহ

এই প্রসঙ্গে বেশ কিছু দিন পিছিয়ে যান কৌশিক। ‘‘আমার মনে আছে তেইশ পল্লিতে আমাদের দলের মহলা চলছে। এক দিন ওই সময়ে সবুজ একটা গাড়ি এসে থামল। পরিচালক তপন সিংহ বললেন, ‘‘তোমার দলের তাপস চক্রবর্তী আর রজতাভ দত্তকে আমার চাই।’’ পরিচালক নিজে এসে তাঁর অভিনেতাকে নিয়ে গেলেন। এখন ভাবতেই পারব না। এখন পুরোটাই কনট্যাক্টস্!’’
নাম বলে চলেছেন তিনি। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, রাজেশ শর্মা, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়...এক সময়ের এক ঝাঁক অভিনেতার হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রির অভিনয়ের ধারা বদল হতে শুরু করেছিল। আজ সেই ধারাতেই হিরো বা স্টার নয়। অভিনেতাদের জয়জয়কার।


জাতীয় পুরস্কার নেওয়ার আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঋদ্ধি।

শাশ্বত ভাল পরিচালক হতে পারে

নিজে হিরো হতে চাননি?
‘‘একেবারেই না। আমার চেহারা সে রকম নয়। অভিনয়কেই ধারালো করার চেষ্টা করেছি। তখন যেমন ভাবিনি বুম্বাদা বা অভিষেক আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। আজও মনে হয়, দেব বা আবীরের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চেহারা আমার নয়।’’
তিনি বলেন, তিনি খুব খুশি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কেমন দেখিয়ে দিল, ছোট চরিত্রে অভিনয় দিয়ে কী ভাবে নিজের জায়গা করে নেওয়া যায়। ‘‘জানেন, শাশ্বত কিন্তু পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে। ‘এক আকাশের নীচে’-র কয়েকটা এপিসোড রবি ওঝা ওকে আর আমাকে দায়িত্ব দিয়ে মুম্বই চলে গিয়েছিলেন।’’ পুরনো কথায় ফিরছেন কৌশিক। জোর গলায় বলে দিলেন, ‘‘আমি সিনেমা পরিচালনা করব না। আমার থিয়েটর ভাল। আমার মনে হয় ঋদ্ধি পরিচালনায় আসবে।’’

ঋদ্ধির ভাল না লাগায় ওকে স্কুল ছাড়িয়ে দিই

এত দিনে ঋদ্ধির জাতীয় পুরস্কারের মানপত্র বাঁধাই করতে দিয়েছেন। ঋদ্ধি যে দিন ওই পুরস্কারটা হাতে নেয়, বাবা হিসেবে কী মনে হয়েছিল?
‘‘রেশমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। একটা সময় আমরা ঠিক করি, ঋদ্ধির যখন প্রথাগত পড়াশোনা ভাল লাগছে না, আমরা ওকে কষ্ট দেব না। রেশমির মনের জোরে এই সিদ্ধান্তে আসি আমরা। আমার ছেলে কত ভাল জগৎকে সেটা দেখানোর জন্য আমরা ছেলের জন্ম দিইনি তো! ও ছোট থেকে পিটার ব্রুক-কে জানে। ওর ছবি দেখা, বই পড়া, গিটার বাজানো, এগুলো নিয়েই ঋদ্ধি। হি ইজ আ ফ্যান্টাস্টিক অ্যাক্টর। ব্যস! সব নিজের মতো করে চলেছে।’’ জোর দিয়ে বিশ্বাসের কথা জানালেন কৌশিক।
মনের জোর, চাপিয়ে না দেওয়ার বিশ্বাস তাঁকেও পরোক্ষ ভাবে জাতীয় পুরস্কার দিয়েছে! ঋদ্ধির বাবা তাই ছুটি পেয়ে সবার আগে সম্মানপত্রের বাঁধাইয়ের দিকে মন দিয়েছেন। তবে এই উৎসাহের মাঝেই বলে দিলেন, ‘‘আমার স্বাধীন মতামত ঋদ্ধিকে মানুষ করার সময় রেশমির ক্ষেত্রে খাটেনি। এটা হয়তো আমার জন্য লজ্জার। রেশমি ওকে মানুষ করার জন্য যা স্যাক্রিফাইস করেছে ভাবা যায় না।’’
কাজলের সঙ্গে ছেলেকে এক ফ্রেমে দেখতে কেমন লেগেছিল?

আরও পড়ুন, ফোন হ্যাক, নায়িকার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ফাঁস!

‘‘বলেছিলাম স্টার। দূরে দূরে থাকবি। তবে কাজটা হওয়ার পরে কাজলের একটা কথা খুব ভাল লেগেছিল। কাজল বলেছিল, ‘‘অভিনয় তো ও ভাল করেই, তা ছাড়াও এত ‘ওয়েল ব্রট আপ’ ছেলে আমি কম দেখেছি।’’

থিয়েটারে ছোট বড় চরিত্র হয় না

স্বপ্নসন্ধানী করছে উৎপল দত্তের নাটক ‘একলা চল রে’। দেবশংকর হালদার করছেন বল্লভ ভাই পটেল, কৌশিক সেন জিন্না, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নেহরু। রেশমি সেন কস্তুরবা গাঁধী। অশোক মুখোপাধ্যায় মহাত্মা গাঁধী। আর ঋদ্ধি হরিলাল-এর চরিত্রে। ‘‘ঋদ্ধিকে বলেছিলাম, এত ছোট চরিত্র করবি? ও বলেছিল, প্লিজ আমায় বাদ দিও না। যত দিন এই মনটা ওর থাকবে ওকে নিয়ে আমাদের ভাবার দরকার হবে না।’’ আত্মবিশ্বাসী কৌশিক।

ঋদ্ধি প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে ‘প্রগ্রেসিভ’ কৌশিক সেনের দিকে খানিক আলোকপাত করি।


নাটকের মঞ্চে অঞ্জন দত্তর সঙ্গে কৌশিক।

কোনও শাসক দল আমায় পছন্দ করে না

বরাবর নিজস্ব রাজনৈতিক ঘরানায় বিশ্বাসী কৌশিক। তাঁকে নন্দীগ্রামের বামবিরোধী আন্দোলনে যেমন দেখা গিয়েছে, তেমনই কামদুনি বা ভাঙড়েও তিনি প্রতিবাদের মুখ হয়ে ফিরেছেন। ‘‘আসলে কোনও শাসক দল আমায় পছন্দ করে না। কেউ বিদ্বজ্জন বলে খোঁটা দেয়। কিন্তু কিছু করার নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাজ্ঞতা বেড়েছে। ধরুন, সৃজিতের ছবি কারওর পছন্দ হল না। সেটা বললেই তো হয়। তা না করে দেখি, লোকজন গালাগালি দেয়। পুরোটা পার্সোনাল লেভেলে চলে যাচ্ছে। ফ্রাস্ট্রেশন থেকে বাঙালি খোঁটা দেয়।’’
নিজস্ব লবি, শাসকদলের মুখ তিনি নন। তবুও দেখেছেন, কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধে হয়নি। ‘‘টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি এখনও আটপৌরে। নয়তো অরিন্দম শীলের সঙ্গে আমার কাজ হতই না। কনসাসলি আমরা কাজের সময় পলিটিকাল আলোচনা করি না। কারণ, ও আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। তবে পশ্চিমবঙ্গে আজ আর রাজনৈতিক দলের বাইরে পরিসর নেই। তৃণমূলের সভায় না গেলেই আমি বামপন্থী বা বামপন্থীর সভায় না গেলেই আমি তৃণমূল! আরে, আমি তো কোনও নীতিকে সমর্থন করতে পারি। সিঙ্গুরে শঙ্খ ঘোষ থেকে ব্রাত্য বসু একটা ফোরাম তৈরি হয়েছিল। পরে দেখলাম শঙ্খ ঘোষ, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া সবাই তো নেতা বা বড় ক্ষমতায় চলে গেলেন!’’ সাফ কথা কৌশিকের।

আরও পড়ুন, ‘ঠাম্মা বলল, মেয়েটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে’

আমাদের দলের পোস্টার নামিয়ে নেওয়া হল

নিজের আদর্শে তিনি অনড়। সরকারি থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে তিনি যান না। অ্যাকাডেমিতে বহু বার পলিটিকাল স্লোগানের বোর্ড নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আদর্শের পথে কঠিন মুখে ‘না’ বলতে শিখিয়েছে তাঁকে জীবন। ছোটবেলার বন্ধু ব্রাত্য বসু। ‘‘ও ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে চায়। যেটা আমি সমর্থন করি না। কিন্তু এই সময়ের বেস্ট প্লে রাইটার ব্রাত্য। এটাকে কোনও দিন অস্বীকার করিনি।’’
আদর্শ, পরিবার, কাজ, এই জায়গার স্থিতি তাঁকে লড়াইয়ের শক্তি দিয়েছে। অনীক দত্ত ভীষণ সচেতন মানুষ। ‘ভবিষ্যতের ভূত’-এ ভিন্ন এক চরিত্রে দেখা যাবে তাঁকে। ‘‘আজকের সময় বলে নয়। রাজনীতিকেও বুদ্ধিদীপ্ত জায়গায় নিয়ে আসছে এই ছবি। সব ক্ষেত্রে রাজনীতিকে বাদ দেওয়া হয়। আর এন্টারটেনমেন্টের ভ্যালুও দর্শকের পছন্দ হবে।’’
নাসিরুদ্দিন শাহ আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শৈবাল মিত্রর ‘দেবতার গ্রাস’ ছবিতে কাজ করবেন। ‘গুপ্তধনের সন্ধান’-এর পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের ছবিতেও কাজ করছেন। এখন ব্যস্ত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ছাদ’ অবলম্বনে ‘বরুণবাবুর বন্ধু’-র ছবি নিয়ে। এই ছবির পরিচালকও অনীক দত্ত।

ছুটলেন কৌশিক। আদরের ‘বাবিয়া’ ওরফে ঋদ্ধির জাতীয় পুরস্কারের সম্মানপত্রের বাঁধাই আনতে।

মনে এল একটা পংক্তি, ‘এক হাতে ওর কৃপাণ আছে আর-এক হাতে হার.../আসে নি ও ভিক্ষা নিতে না না না/লড়াই করে নেবে জিতে পরানটি তোমার...’

(সেলেব্রিটি ইন্টারভিউ, সেলেব্রিটিদের লাভস্টোরি, তারকাদের বিয়ে, তারকাদের জন্মদিন থেকে স্টার কিডসদের খবর - সমস্ত সেলেব্রিটি গসিপ পড়তে চোখ রাখুন আমাদের বিনোদন বিভাগে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy