‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’ ছবির একটি দৃশ্যে কানি কুস্রুতি। ছবি: সংগৃহীত।
আজ দেশ জুড়ে মুক্তি পাচ্ছে এ বছরের কান চলচ্চিত্রোৎসবে ‘গ্রাঁ প্রি’ পুরস্কারে ভূষিত পায়েল কাপাডিয়া পরিচালিত ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’ ছবিটি। যে হেতু একটি ভারতীয় ছবি সাহেবদের দেশে গিয়ে খ্যাতনামা চলচ্চিত্রোৎসবে প্রথম প্রদর্শনেই সেরার সম্মান ছিনিয়ে এনেছে, এবং বিশেষত তার জন্যই বিদেশের সমালোচকেরাও প্রায় নালে-ঝোলে হয়ে পড়ছেন ছবিটি দেখে, সে হেতু খুব স্বাভাবিক ভাবেই এ দেশেও বহু আশা নিয়ে ছবিটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন দর্শক।
তাই একটি প্রয়োজনীয় বিষয় শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক। এমন ছবি কিন্তু এ দেশের নানা ভাষায় আকছার হয়ে থাকে এবং প্রশংসিতও হয় দর্শকমহলে। অবশ্যই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে থাকে। তাই মুক্তির পর বেশি দিন প্রেক্ষাগৃহে টিকে থাকতে পারে না। কম সংখ্যক দর্শকই দেখতে পান, তাই এমন ছবিগুলির তেমন প্রচার হয় না। আর বাঙালি তো এমন ছবি সেই ১৯৬২ থেকে দেখে আসছে। হ্যাঁ, আমি সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিটির কথা বলছি। তার পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১), ‘জন অরণ্য’(১৯৭৬)। এর মধ্যেই চলে আসবে মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১)। হালে ২০১৪ সালে আমাদের ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ দেখিয়েছেন আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত অথবা এই চলতি বছরেই অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মানিকবাবুর মেঘ’। যেটা বলতে চাইছি, তা হল, এই সব ক’টা ছবিরই শুরু হচ্ছে বড় শহর এবং সব ক’টা ছবিতেই সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য জুড়ে চরিত্রগুলির কোনও এক ধরনের মানসিক উত্তরণ ঘটে। পুরো ছবি জুড়েই যে সমস্যাটি তাদের কুরে কুরে খায় ভিতর-ভিতর, তার একটি সমাধানের সূত্র তারা নিজেদের মতো করে খুঁজে পায় ছবির শেষ ভাগে এসে। যদিও পরিপ্রেক্ষিত আলাদা প্রতিটি ছবিরই, সমস্যাগুলিও আলাদা। না হলে সেগুলি আলাদা ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছবি হয়ে উঠত না কখনওই। কিন্তু প্রেক্ষাপটটি এক এবং তার কোনও ব্যতিক্রম নেই পায়েলের ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’-এও। সুতরাং ভারতীয় দর্শক এই ছবিতে আলাদা কিছুই পাবেন না, হলফ করে বলে দেওয়া যায়।
‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’-এর প্রেক্ষাপট হল মুম্বই শহর। মুম্বইয়ে কেন আসেন পুরো দেশের মানুষ? বাঁচতে। বেঁচে থাকতে। কেউ স্বপ্নপূরণের খোঁজে। কেউ নিজের চেনা জীবনকে বদলাতে, কেউ কোনও এক অস্বস্তিকর স্মৃতি ভুলে থাকতে। ছবিতে একটি সংলাপ আছে পটভূমিতে, যেটি শোনা যায় বাংলা ভাষায়। “সবাই বলে মুম্বই স্বপ্নের শহর। কিন্তু আমার মনে হয়, এ শহরে লোকে আসে বাঁচতে।” ছবিটি অবশ্য মূলত মালয়ালম ভাষায়। কাহিনির কয়েকটি প্রয়োজনীয় সূত্র ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন আলোচনার এই পর্যায়ে। কাহিনিতে প্রধান চরিত্র প্রভা (কানি)। সে এবং তার সহ-ভাড়াটিয়া অনু (দিব্যা) মুম্বই শহরের একটি হাসপাতালে ‘নার্সে’র কাজে যুক্ত)। প্রভা রক্ষণশীল। অনু স্বভাবে, একেবারে ঠিক তার উল্টো। সে চাকরি করে আবার প্রেমও করে। প্রথমটিতে তার মন তেমন না থাকলেও, দ্বিতীয়টিতে সে তার মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে। অনু হিন্দু, কিন্তু তার প্রেমিক মুসলিম। অনু ভাল করেই জানে, এই সম্পর্ক তার পরিবার মেনে নেবে না। তা-ও মুম্বই এসে, পরিবারের শাসনের বাইরে সে যতটা চুটিয়ে পারে নিজের জীবনটি কাটাতে চায়। অন্য দিকে, দুই সহবাসীর কথায় দর্শক ধীরে-ধীরে জানতে পারেন, প্রভা বিবাহিত হলেও, এক দিনও সে বিবাহিত জীবন কাটায়নি। তার বিবাহিত পুরুষটি বিয়ের পরপরই জার্মানি চলে যেতে বাধ্য হয়েছে চাকরির কারণে। সেখানে সেই পুরুষটি একটি কারখানায় শ্রমিক। প্রথম-প্রথম ফোনে যোগাযোগ থাকলেও, বর্তমানে একেবারেই যোগাযোগ নেই দু’জনের। তা-ও প্রভা অন্য পুরুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে, কারণ সে বিশ্বাস করে কোনও একদিন তার জীবনে তার সঙ্গীটি ফিরে আসবে। এই সূত্রে প্রভা আর অনুর কথাবার্তা থেকে দর্শক জানতে পারেন প্রভার যাপনের কাহিনি। এখানে অনু-প্রভার কথোপকথনের শেষ অংশটি লক্ষ্য করার মতো। অনু, প্রভাকে জিজ্ঞেস করে, “মাসি, বিয়ের আগে তোমাদের পরিচয় ছিল?” তাতে প্রভা উত্তর দেয়, “না, না। মা-বাবা পাত্র ঠিক করে আমাকে বাড়ি আসতে বলে।’’ উত্তরে অনু বলে, “আমি তো বাবা কোনও অচেনা ছেলেকে বিয়ে করে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই পারি না।’’ প্রভা অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, “অনেক সময় চেনা মানুষও অচেনার মতো ব্যবহার করে।’’
এর মধ্যেই প্রভা-অনুর ঠিকানায় এসে পৌঁছয় একটি বিরাট ‘পার্সেল’। সেখানে প্রাপক হিসাবে প্রভার নাম থাকলেও প্রেরকের নাম নেই। খুলে আবিষ্কার করা হয়, পাঠানো হয়েছে জার্মানিতে তৈরি একটি ভাত রাঁধার যন্ত্র। অনুর মতে, সেটি নিশ্চয় প্রভার সঙ্গী বা স্বামী পাঠিয়েছে। প্রভা অবশ্য সেই যন্ত্রটি ব্যবহার করতে খুব একটা ইচ্ছুক হয় না, কারণ এমন যন্ত্র তাদের কাছে আগে থেকেই আছে। পরে এক তুমুল বৃষ্টির রাতে, অনু যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, খোলা জানলার ফাঁক গলে আসা জলে ভিজে যাওয়া মেঝে মুছতে মুছতে প্রভা যখন সেই যন্ত্রটিকে নিজের তলপেটের মধ্যে পরম আদরে চেপে ধরে, একফোঁটা চোখের জল ফেলে, তখন একটি অসাধারণ পার্থিব মুহূর্তের সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য হয় দর্শকের। মনে হয় বহু দিনের শুকিয়ে যাওয়া মাটি যেন আকুল তৃষ্ণায় শুষে নিতে চাইছে বাইরের তুমুল জলধারা। অথচ এই স্ব-প্রণোদিত শরীরী শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে প্রভা নিজেই রাজি নয়। তার কর্মক্ষেত্রের এক সহ-চিকিৎসক যখন তাকে একটি নতুন সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, সে সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
ইতিমধ্যে প্রভার নিস্তরঙ্গ জীবনে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালে তার সহকর্মী পার্বতীর (ছায়া) প্রায় ঘরছাড়া হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। পার্বতী বিধবা। তার স্বামীর যখন জুটমিল থেকে চাকরি যায়, তখন তারা একটি মুম্বই চৌলে ঘর পেয়েছিল চাকরির ক্ষতিপূরণ হিসাবে। মারা যাওয়ার আগে সেই মানুষটির খেয়াল থাকেনি, স্ত্রীর মাথা গোঁজার জন্য একটি অবলম্বন প্রয়োজন। সুতরাং ঘরের মালিকানার প্রমাণ এত দিনে হারিয়ে গিয়েছে। যার ফলে চৌলের সেই ঘরে নজর পড়েছে এক জমি-হাঙরের। অবস্থা এমনই যে প্রভার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও পার্বতীর চৌলের ঘর খালি করা ছাড়া উপায় থাকে না। পার্বতী অগত্যা শহরের চাকরি ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়াই স্থির করে। অন্তত সেই বাড়িটা তো তার মা-বাবার। সেখান থেকে তো কেউ আর তাকে তাড়াতে পারবে না। তা পার্বতীর সেই গ্রাম নির্জন এক সমুদ্রতীরে। সেখানে বেশির ভাগ গ্রামবাসীই সমুদ্রে মাছ ধরে গ্রাসাচ্ছাদন করে। পার্বতীকে গ্রামে পৌঁছে দিতে তার সঙ্গী হয়ে গেল প্রভা-অনুও। এ বার অনুর প্রেমিক প্রবর শিয়াজ়ও (হৃদু) সম্ভবত অনুর কাছ থেকে জানতে পেরেই, তাদের পিছু-পিছু হাজির হয় সেই একই গ্রামে। কারণ সমুদ্রতীরে সেখানে আছে গাছপালার আড়াল। মানুষজন কম। তাই শিয়াজ়-অনুর শারীরিক মিলনে সেখানে কোনও সামাজিক বাধা আসবে না, তারা স্বাভাবিক ভাবেই আশা করে। তেমন ঘটেও। সেটি আবার আড়াল থেকে দেখে ফেলে প্রভা। সে দিন বিকেলের দিকে জেলেদের জালে জড়িয়ে একটি ডুবে যাওয়া প্রৌঢ় মানুষ উদ্ধার হয়। প্রায় মৃত সেই মানুষটিকে প্রভাই মুখে মুখ লাগিয়ে খানিকটা সুস্থ করে, শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করায়। তার পর গ্রামবাসীদের সাহায্যে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। সেখানে এই লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে প্রভা।
চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে তার সাহায্যকারী বৃদ্ধা প্রভাকেই মানুষটির স্ত্রী হিসাবে ধরে নেয়। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরার পর মানুষটির সঙ্গে টুকরো কথা শুরু হয় প্রভার। আর এর মধ্যেই সৃষ্টি হয় এক জাদু-বাস্তব পরিস্থিতির। প্রভা আর সেই ডুবে যাওয়া মানুষটি স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে কথা বলতে শুরু করে। মানুষটি জানায়, সে ঘরে ফিরতে চায়। কারখানায় কাজ করতে করতে অনেক দিন লম্বা সময় কাটাতে বাধ্য হয়। সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে চায় বাড়ি ফিরে আসতে। সেই বাড়ি, যেখানে সে জানে তার স্ত্রী তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।
শেষে প্রভা বাড়ি ফিরে আসে নির্জন সমুদ্রতীরে একমাত্র ছ্যাঁচাবেড়ার আস্তানাটিতে। উথল হাওয়ায় মাতোয়ারা সেই রাতে তার পাশে তখন পার্বতী। মিলনসুখে পরিপূর্ণ অনুও ফেরে। প্রভা তাকে বলে সিয়াজ়কেও নিয়ে আসতে। সিয়াজ়ও যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। এর মধ্যে প্রভার মনে এক অনুচ্চারিত উত্তরণ ঘটে গিয়েছে। বড় শহরের শীর্ণ মানসিকতায় যে প্রভা নানা শৃঙ্খলে নিজেকে এত দিন বেঁধে রেখেছিল, সে হঠাৎ তার মনের সব দরজা খুলে দেয় আগামীর প্রগল্ভতার খোলা হওয়ার জন্য। এই হল মোটামুটি গল্প। এর মধ্যে কী এমন নতুন আছে? তবে এই কাহিনিতে অনেকগুলি পরত আছে। একই ঘটনায় পুরুষ-নারীর ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত, সমাজে নারীর জন্য পুরুষের সামগ্রিক অনুভূতিহীনতা, শহর এবং গ্রামের চিন্তাভাবনার ভিন্নতা, কংক্রিট এবং প্রকৃতির ভিন্ন প্রভাব। কিন্তু তা কি এতটাই মৌলিক, যে সাহেবরাও কাত হয়ে যাবে? আসলে কান বা এই ধরনের প্রথম শ্রেণির উৎসবগুলিতে এক ধরনের দর্শক আছেন যাঁরা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের যাপনচিত্রটি আসলে ঠিক কেমন, তা জানতে সর্বদাই উদ্গ্রীব। উন্নত দেশের শহরবাসী তো, ভারতীয় শহরের এই বৈপরীত্য যাপন, এই বিষয়টি তাঁদের বড় ছুঁয়ে যায়। এই যে ভীষণ শৃঙ্খলের চাপ, সারা ক্ষণের টানাপড়েন, এগুলিকে আরাম-স্বস্তির যাপনে দেখতে তাঁদের বোধ হয় এক ধরনের রতিসুখ অনুভূত হয়। সুতরাং এমন বিষয় নিয়ে তৈরি ছবি নিয়ে তাঁরা স্বভাবতই নালে-ঝোলে হয়ে পড়েন। এই আর কি!
ছবিতে কোনও তারকার উপস্থিতি নেই। দেখে মনে হয় ছবি তৈরি করতে তেমন খরচও হয়নি। কোনও দৃশ্যেই বিদেশের ছোঁয়াছুঁয়ি নেই। তা হলে এত জন আন্তর্জাতিক প্রযোজকের কী এমন প্রয়োজন ছিল পায়েলের? আসলে মনে হয় ভদ্রমহিলা বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবের আগাপাশতলা গুলে খেয়ে নিয়েছেন। কোন অস্ত্রে বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারকদের কাবু করা যায়, তা পায়েল ছবি বানানোর আগেই বুঝে নিয়েছেন। এ সব জায়গায় বিচারকদের অর্ধেকের বেশি ছবি দেখে ওঠারই সময় হয় না। এই সব প্রযোজকদের প্রতিনিধিরা সেই পথ অনেকটা মসৃণ করে দেন। সারা ক্ষণ নিজেদের ছবির বিষয়ে দরবার করাটাই তাঁদের পেশা। এর ফলও পাচ্ছেন পায়েল। কান হয়েছে। তার পর অস্কারের জন্য ফ্রান্সের সরকারি ছবি হিসাবে মনোনীত হয়েছিল পায়েলের ছবি। যদিও শেষ পর্যন্ত অন্য ছবির কাছে হার স্বীকার করতে হয়। আসলে তো হল ফল। ফলে, তার পরে কেউ পথ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। সাফল্য বাকি সব কিছুকেই মুছে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy