গত ছ’মাসে হোয়াটসঅ্যাপ কী বিবিএম-এ মেসেজ করলে উত্তর আসত তিন দিন পরে। ফোনও প্রায় ধরতেন না। দেখা যেত না পার্টিতেও। সবাইকে অবাক করে হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।
কোথায় ছিলেন তিনি? কী হয়েছিল তাঁর? সব নিয়ে শুক্রবার দুপুরে মুখ খুললেন তাঁর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে।
আর এমন সব কথা বললেন যা এর আগে কখনও বলেননি...
দুষ্টু লোক যেমন ভ্যানিশ, তেমনই সবাই বলছিল রাইমা সেনও ভ্যানিশ...
হ্যাঁ, ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে শুধু বাংলা ছবি থেকে। হিন্দি ছবি করছি। চারটে ছবি সাইন করেছি। বিনয় পাঠকের সঙ্গে ‘কাগজ কে ফুল’ বলে একটা ছবি শুরু করেছি...
হিন্দি ছবি-টবি সব ঠিক আছে, আগে বলুন কী হয়েছিল রাইমার?
নিজেকে বদলেছে রাইমা। আজকের আমি অনেক অনেক শান্ত। রেস্টলেস ভাবটা চলে গিয়েছে। নিয়মিত জিম করছি। বেসিক্যালি জীবন নিয়ে ফাইনালি সিরিয়াস হয়েছি...
বিশ্বাস হচ্ছে না...
বিশ্বাস করুন তা হলে। এত দিন আমার কাছে সব কিছুই হাসিঠাট্টা ছিল। আজকে আর সে ভাবে দেখতে চাই না জীবনটা।
আমার একটা নাম আছে। সেই নামটা ভাল কাজে ব্যবহার করতে চাই। সে দিন রাজ মহতানি আর অনামিকা খন্না আমাকে উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে বলল।
রাজের সঙ্গে মিটিং করলাম। নেট থেকে পড়াশোনা করলাম। শুধু পার্টি, মিনিংলেস হাসিঠাট্টা তো অনেক হল। শুধু শুধু ও সব আর কত করা যায়? কেরিয়ার নিয়ে সিরিয়াস হয়েছি ফাইনালি...
কী রকম?
জীবনে কোনও দিন কোনও স্ক্রিন টেস্টে যাই নি। কিন্তু সে দিন এমন একটা ছবির অফার পেলাম, যেখানে স্ক্রিন টেস্টে যাওয়ার দরকার ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গেলাম।
এ বার থেকে এটাও ঠিক করেছি সেই ছবিই করব, যেটা মন থেকে করতে চাই। ও আমার বন্ধু, ওকে আমি চিনি, কেউ অনুরোধ করল— ও ভাবে আর ছবি সাইন করব না।
এত পরিবর্তন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতেই হচ্ছে...
(হেসে) কী বলুন?
গত ছ’মাস ধরে শুনছি আপনি একটা সম্পর্কে আছেন। নতুন সেই সম্পর্কের জেরেই কি এই পরিবর্তন?
(হেসে) একদমই তাই। হি ইজ ভেরি ম্যাচিওর্ড। আমার যে পরিবর্তন সেটা ওর জন্যই। এই মুহূর্তে আমি নামটা নিতে পারছি না, কিন্তু এই প্রথম কোনও ইন্টারভিউতে স্বীকার করছি, আই অ্যাম ইন আ রিলেশনশিপ।
আর...
আর আমি খুব খুশি। বহু দিন ধরে আমি লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করছিলাম। ফাইনালি, ও আমার জীবনে আসার পর থেকে আমি অনেক শান্ত হয়েছি। বুঝতে শিখেছি ছোট ছোট অনুভূতিগুলো।
আমাকে ও বারবার বলত, কত দিন আর ওই হাসিঠাট্টা, পার্টি করবে! প্রথম প্রথম বুঝিনি কী বলছে। আজ যখন বুঝেছি, জীবনের মানেটা পাল্টে গিয়েছে। সে দিন বাবা আর আমি বাড়িতে ছিলাম। বাবা আমাকে বলল, বিকেলের কী প্ল্যান? আমি বললাম, ‘বেরোতে পারি। কিন্তু তুমি কী চাও?’ বাবা বলল, ‘আমি চাই তুমি বাড়িতে থাকো।’
আগে হলে ঘর বন্ধ করে বন্ধুদের ফোন করে কমপ্লেন করতাম। আজ হাসতে হাসতে থেকে গেলাম।
যাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তিনি তো বাঙালি নন?
না, বাঙালি নন...
বিয়ে করবেন ?
বিয়ে করব কি না জানি না। ভাবিনি এখনও। যদি কপালে থাকে তা হলে নিশ্চয় ওকেই বিয়ে করতে চাইব।
কিন্তু বিয়ের থেকেও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, আমার পার্সোনালিটিতে একটা পরিবর্তন এনেছে ও। ওর সঙ্গে থাকার পর আমার ধৈর্য বেড়েছে। এই নতুন রাইমাকে ভাল লাগছে আমার।
আর, আগে না আমি আইডিয়া অব ম্যারেজ নিয়েই খুশি হতাম। মনে হত, বন্ধুরা বিয়ে করছে, আমারও তা হলে বিয়েটা করা উচিত। আজকে ও রকম বোকা বোকা চিন্তাগুলো মাথায় আসে না।
মনে হয় বিয়ে যদি করতেই হয় তা হলে আমাকেও তো শ্বশুরবাড়ির জন্য কিছু কন্ট্রিবিউট করতে হবে। শুধু সুন্দরী বৌমা কেউই চাইবে না। চাইবে সেন্সিবল বৌমা। এখন সেই সেন্সিবল ডটার-ইন-ল’ হওয়ারই চেষ্টা করছি। (হাসি)
এর আগেও তো আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিল। এ বারের সঙ্গে আগের সম্পর্কগুলোর ফারাক কোথায়?
ছিল তো। কিন্তু দোজ ওয়ার রাবিশ। একজনের সঙ্গে পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল। আর একজনের সঙ্গে এক বছরের। সেই সম্পর্কগুলোতে আমি যা বলতাম তারা সেটাই করত। আমি তাদের পাপেট বানিয়ে ফেলেছিলাম।
কিন্তু আজ বুঝতে পারি, পাপেট বানিয়ে আমি খুশি তো ছিলাম কিন্তু ওই পাপেটদের কোনও সম্মান আমি করতাম না। এই সম্পর্কে আমি এমন একজনকে পেয়েছি যে, আমার মুখের উপর বলে আমার এটা করা ঠিক না। আর আজকে আমি নিজেও চাই কেউ আমাকে কন্ট্রোলকরুক। আই লাইক টু বি কনট্রোল্ড টুডে।
এই নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ইচ্ছে কি এটার জন্য হয়েছিল যে, বহু দিন ধরে আপনাকে বড্ড বেশি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আপনার বাবা-মা?
ইয়েস। বড্ড বেশি ফ্রিডম পেয়েছিলাম। তাও কী আশ্চর্য! খালি ফ্রিডম নেই, ফ্রিডম নেই বলে কমপ্লেন করতাম। এই ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বাবা-মাকেও আমি সরি বলতে চাই। ওদের ফ্রিডম দেওয়াটা সম্মান করিনি তখন।
কোনও কারণ ছাড়া পার্টি করেছি। কোনও কারণ নেই তাও নাইটক্লাবে গিয়েছি। আজ তো আমি বাড়িতে একা। খালি মনে হচ্ছে বাবা-মা থাকলে কী ভালই না হত। আগে হলে বন্ধুদের ফোন করে বলতাম, ‘ওয়াও, সো গ্ল্যাড আই অ্যাম অ্যালোন!’ আজ বুঝতে পারি ওটা ভুল ছিল। ভুল বুঝতে পারি বলে, আরও বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে চাই।
মুনদি (মুনমুন সেন) বা আপনার বাবা এই সম্পর্ক নিয়ে খুশি?
হ্যাঁ, দে আর ভেরি হ্যাপি। বললাম না, ও ভীষণ সেন্সিবল। মা-বাবা দু’জনেই খুব খুশি।
রাইমা, ভাবিনি এ রকম আড্ডা হবে আপনার সঙ্গে...
(হাসি) আমিও ভাবিনি। আর যেটা বলতে চাইছি আজকে কেরিয়ার নিয়েও নতুন করে সিরিয়াস হয়েছি। গত পাঁচ বছর ধরে সেই একই জিনিস করছিলাম। রাইমা মানে হাসিঠাট্টা, ইয়ার্কি, পার্টি— তখন আমারও ভাল লাগত এ সব জিনিস। কিন্তু বুঝিনি কোথাও লোকজন আমার উপরেই হাসত। দ্য জোক ওয়াজ অন মি। আজ আমি আর সেই সব দিন রিপিট করতে চাই না।
গত পাঁচ বছরে যে সব ছবি করেছেন তার মধ্যে কিছু ছবি রিগ্রেট করেন?
অর্ধেক ছবি রিগ্রেট করি। আর কী বলুন তো, শুনতাম লোকে বলছে, রাইমার এত পোটেনশিয়াল। আমি ভাবতাম কীসের পোটেনশিয়ালের কথা বলছে। সব সময় মনে করতাম আমি ফ্লুক, আমি লাকি।
কোনও পোটেনশিয়াল আমি নিজের মধ্যে দেখতে পেতাম না। আজ এই সম্পর্ক আমাকে আমার পোটেনশিয়াল দেখতে শিখিয়েছে। এবং কী আশ্চর্য, যে মুহূর্তে অল্প অল্প করে নিজের ভ্যালু বুঝেছি, ঠিক সেই সময়েই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছবির অফার পেলাম।
মানে, আজকে আউটডোর শ্যুটিংয়ে প্যাক আপের পর আর রাইমা সেনকে আড্ডা মারতে দেখা যাবে না?
তা নয়, নিশ্চয়ই আড্ডা মারব। কিন্তু রাত বারোটা অবধি আর মারব না। রাত হলে ঘরে গিয়ে পরের দিনের ডায়লগ মুখস্থ করব। আগে তো শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে মেকঅ্যাপ করতে করতে ডায়লগ মুখস্থ করতাম।
এত ক্যাজুয়ালি আর আমি কেরিয়ারটা নিতে চাই না। আগের বছর অতনু ঘোষের ছবির ডাবিং করেছিলাম। কোনও রকমে করে দিয়েছিলাম। সেটা আবার নতুন করে সে দিন করলাম। আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন কতটা তফাত ওই দু’টোর মধ্যে। হয়তো আমার কনসেনট্রেশন পাওয়ারটাও আগের থেকে বেড়েছে।
তা হলে এই নতুন রাইমাকে এককথায় বর্ণনা করুন...
(হেসে) রাইমা সেন আগে ট্যাকিলা শট ছিল। আজ সিঙ্গল মল্ট।
আপনার বন্ধুবান্ধবরা কী বলছে?
ওরা তখনও আমাকে নিয়ে খুশি ছিল, আজও খুশি। তবে এই সম্পর্কের পর বুঝেছি আগে আমি ঘ্যানঘ্যানে এক গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। স্করপিও তো। তাই সব সময় সবাইকে সন্দেহ করতাম। মাঝে মধ্যে নিজেই বিরক্ত হতাম নিজের উপর এই সন্দিগ্ধ মনের জন্য। আজকে আই অ্যাম ট্রাইং টু চেঞ্জ।
আজকে যে এতটা বদল হয়েছে আপনার মধ্যে, কখনও মনে হয়, ইস্, আর একটু আগে হলে দিম্মা দেখে যেতে পারতেন?
হ্যাঁ, মনে হয়। রোজ মনে হয়।
দিম্মা আমাকে বলত ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস করো। পুজো করো।
আজকে আমি ধ্যান করি। অনেক স্পিরিচুয়াল হয়েছি। এ ছাড়াও দিম্মা আমাকে প্রায়ই বলত, ‘রাইমা তুমি খুব ভাল অভিনেত্রী, আর একটু মন দিয়ে কাজ করা উচিত তোমার।’
আজকে যখন বুঝতে পারছি আমি শুধু ফ্লুক নই, নিশ্চয়ই মন দিয়ে কাজ করলে আমি আরও ভাল অভিনেত্রী হতে পারব, তখন দিম্মার কথাগুলো কানে বাজে। খুব আপসোস হয়, দিম্মা এই রাইমাকে দেখে যেতে পারল না।
এই রাইমাকেই তো দেখতে চেয়েছিল দিম্মা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy