Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Hamlet

Hamlet: ‘হ্যামলেট’ ঋদ্ধিকে চিঠি মুগ্ধ অনির্বাণের, পড়ে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন

সম্প্রতি ‘হ্যামলেট’ নাটক দেখতে গিয়েছিলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন নামভূমিকায় অভিনেতা ঋদ্ধি সেনের অভিনয় দেখে।

ঋদ্ধিতে মুগ্ধ অনির্বাণ।

ঋদ্ধিতে মুগ্ধ অনির্বাণ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২২ ০৯:৩৯
Share: Save:

সম্প্রতি ‘হ্যামলেট’ নাটক দেখতে গিয়েছিলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন নামভূমিকায় অভিনেতা ঋদ্ধি সেনের অভিনয় দেখে। তার পরেই ঋদ্ধিকে একটি চিঠি লেখেন অনির্বাণ। যা হাতে এসেছে আনন্দবাজার অনলাইনের। সেটি সরাসরি তুলে দেওয়া হল।

‘কনিষ্ঠতম’ হ্যামলেট, ঋদ্ধি,

প্রথমেই উদাত্ত কণ্ঠে তোর অভিনয়কে সাবাশি, প্রণাম, হাততালিতে ভরিয়ে দিতে চাই।

চরিত্রের নানা অলিগলি, চড়াই উৎরাই এ সব আলোচনা দীর্ঘ ও বিস্তারিত এবং তা এমন এক গভীর অনুভব যে লিখে, বলে ‘ঠিক’ নির্যাসটুকু প্রকাশ করা আমার পক্ষে কঠিন। তবে তিন ঘণ্টা যে অক্লান্ত কায়িক দুরন্তপনা দেখা গেল, তা খুব সচরাচর দেখা যায় না এই ক্ষয়ে যেতে থাকা শহরে।

প্রথমত, তোকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর। হ্যামলেটকেও বোধকরি সুন্দর দেখতে, পিটার ব্রুকের কালো হ্যামলেটকেও সুন্দর দেখতে। কিন্তু আমি বলছি একেবারে আমাদের মধ্যবিত্ত মনের মাপকাঠিতে শতাব্দীপ্রাচীন যে সুন্দর-অসুন্দর বিভাজন,সেই মাপকাঠিতেই তোকে সুন্দর দেখতে। এই থিয়েটারে সেটা খুবই অমোঘ ও অদ্ভুত ভাবে কাজে লাগে। কী ভাবে সেটা পরে বলছি।

আমি চিরকালই অভিনয়ে স্কিল ভালবাসি, ক্রাফট ভালবাসি। আমি মনে করি সার্কাসের ট্র্যাপিজের শিল্পীদের যে দেখিয়ে দেওয়াটা আছে, ব্যালে শিল্পীদের যেটা আছে, অভিনেতাদেরও তাই। যা সে শিখেছে, পরিশ্রম করে বশ করেছে তার শরীর, কণ্ঠ এবং ছন্দকে, তা খুব পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেওয়াই তার অন্যতম বড় কাজ। যে ভাবে ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক ‘দেখায়’ ঠিক সে ভাবেই।

তোর স্কিল এবং ক্রাফট দেখা খুবই আরামের, আশ্চর্যের, আনন্দের। তুই এই নাটকে চোখ যে ভাবে ব্যবহার করেছিস (আমি দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলাম) তা অতুলনীয়। তোর ব্রিদিং-এর কন্ট্রোল ও ব্যবহারও শিক্ষণীয়। আমি হাঁ করে দেখলাম, তোর কোথাও ব্রিদ আউট হল না। খুব কড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ছাড়া এ খুব সহজ কাজ নয়। আমরা যারা সিগারেট খাই, তাদের পক্ষে তো নয়ই।

হ্যামলেটের একটি দৃশ্যে ঋদ্ধি।

হ্যামলেটের একটি দৃশ্যে ঋদ্ধি।

তুই একটা দুরন্ত হ্যামলেট হয়ে উঠেছিস।

আমার একটি সমালোচনাই তোর অভিনয় নিয়ে আছে, যা খানিক তোর, খানিক হয়তো পরিচালকের ওপর বর্তায়। কারণ, সুরঙ্গনা এবং আরও কিছু অভিনেতার ক্ষেত্রেও একই অনুভূতি হয়েছে।

আমার মনে হয়েছে, একটা বাক্যে একটু বেশি সংখ্যক শব্দে অভিনেতারা জোর দিয়েছে! তাতে এই সংলাপের যে ফল্গুধারা, তা খানিক ব্যাহত হয়েছে।লিরিক্যাল মেজাজটা হারিয়েছে মাঝেমাঝেই। কাব্যের একটা পূর্ণতা থাকে। বেশিবার থামায়, আন্ডারলাইন করায়, বোঝাতে চাওয়ায় তাতে গদ্যের মেজাজ ঢুকে আবেগ এবং অভিঘাতে বেশ খানিকটা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। যাঁর অভিনয়ে এটা কম, তিনি পোলোনিয়া (দিতিপ্রিয়াদি) এবং যাঁদের অভিনয়ে এটা নেই-ই তাঁরা গাট্রুড (রেশমী সেন) এবং ক্লডিয়াস (নির্দেশক কৌশিক সেন)।

রেশমীদির অভিনয় আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি। রেশমীদি কেবল ‘স্বপ্নসন্ধানী’ আর হয়তো সংসারের স্বার্থে টেলিভিশনের অভিনেত্রী হয়ে ইতিহাসে থেকে যাবেন। কিন্তু এত বড় মাপের এবং এই পরিমাণ ক্ষমতার অভিনেত্রী আমি খুব খুবই কম দেখেছি বাংলা মঞ্চে। ওরকম হাঁটা স্টেজের ওপর, আমি রমাপ্রসাদ বণিক ছাড়া আর কারও দেখিনি। ওফেলিয়ার সঙ্গে রাইট ডাউনে কথা বলে যখন গাট্রুড বেরিয়ে যাচ্ছেন, ওইটুক হাঁটা থেকেও চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আমার রেশমীদির অভিনয় নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ, রেশমীদি মঞ্চে থাকলে আমি এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই, যা আমার বিশ্লেষক মনকে একেবারে বস্তায় পুরে ফেলে।

এবং আমার মনে হয়, প্রথম পার্থ, তপস্বী ও তরঙ্গিনী, প্রাচ্য, দর্জিপাড়ার মর্জিনারা, ডাকঘর, মাল্যবান ইত্যাদি এবং আরও এবং এতগুলি নাটকের অভিনেতা, অধিকাংশের নির্দেশক কৌশিক সেনের কাছে আরও পাঠ নেওয়া প্রয়োজন লিরিক্যাল অভিনয়ের ব্যাপারে। অবশ্যই তাঁর সংলাপ প্রক্ষেপণ অনুকরণ করে নয়। সেই প্রক্ষেপণের উৎসস্থল, তার মন, তার ইমোশন মেমোরি ও তার স্কিলের অনুসরণের মাধ্যমে।

তোদের দলেই একেবারে উপযুক্ত লোক উপস্থিত। যিনি আবার পরিচালকও। আমাদের পোড়া দেশে সমস্ত অ্যামেচার ইনস্টিটিউশন, গুরুগৃহ উঠে গিয়েছে। লুপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছে। ফলত যা বা যাকে পেয়েছ, একেবারে নিংড়ে নাও সবাই। এ সুযোগ পাবে না আর ...।

খামতির কথা আরও বলি? বিশেষ করে ওফেলিয়া ও গিলডেসস্টার্ন এবং রোসেনক্রানজের অভিনয়ে আমার প্রেজেন্স ও অভিঘাত সৃষ্টির কিঞ্চিৎ অভাব বোধ হয়েছে। তার নোটবুকও এই প্রযোজনাতেই আছে। অভিনেতা কৌশিক সেনকে দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা, যে অভিনয়কে অভিঘাতপূর্ণ করে তুলতে গেলে চরিত্রের আধার অর্থাৎ শরীর, কণ্ঠ ও অন্তরকে কী ভাবে পাওয়ারফুল করে তুলতে হয়।

মুখোশের ব্যবহার ছাড়া ‘হ্যামলেট’ কৌশিকদার খুব অন্যরকম নির্দেশনার কাজ। আমি নাটক দেখতে দেখতে বুঝতে পারছিলাম, এই নির্দেশকের মধ্যে খুব সম্প্রতি একটা কিছু ঘটেছে, একটা বদল বা অন্য কিছু। আমি বেশকিছু তিন ঘন্টার প্রযোজনায় অভিনয় করেছি। কিন্তু কোনও নির্দেশককেই এত রিস্ক নিতে দেখিনি। এত কম শব্দ ও মিউজিকের ব্যবহার, এত নৈঃশব্দ্য, এত অন্ধকার, শব্দহীন অন্ধকার— এইগুলো সব এই প্রযোজনার রিস্ক। আবার এইগুলোই এই প্রযোজনার সম্পদ। আমি স্বীকার করতে চাই, প্রতিটি মুহূর্তের সাথে আমি একাত্ম হতে পারিনি। আমি এ-ও স্বীকার করছি যে, দ্বিতীয় অর্ধে আমি দু’বার আমার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েছি। তবু আমি এটা বুঝতে ভুল করিনি যে, এই অন্ধকার, এই গতি, এই শব্দহীনতা এই নাটকের শরীরে লেপ্টে লেগে আছে।

একমাত্র কবরখনকের দৃশ্য যার শুরু ও শেষটা আমার রাজনৈতিক ইতিহাসের নাটকীয় ব্যবহার ও গ্রোটেস্ক মুভমেন্টের কারণে সারাজীবন মনে থাকবে। কিন্তু মধ্যবর্তী দৃশ্যটুকু সর্বাধিক দুর্বল অংশ বলে মনে হয়েছে।

আরও একটি ব্যাপারে আমি পরিচালক ও অভিনেতার অভিনয়ের বিপরীতে দাঁড়াব। হোরেশিও। হোরেশিও শান্ত, সে চিন্তিত, ব্যথিত। কিন্তু কখনওই অত উত্তেজিত নয়। না হলে হ্যামলেটের মতো বুদ্ধিমান কখনও হোরেশিওকে তার গল্প বলার দায়িত্ব দিত না। তা ছাড়া হ্যামলেটের পাগলামির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকে হোরেশিও, প্রায় স্বয়ং শেক্সপিয়ারের মতো। যে জানে, যা ঘটার তা ঘটবেই। সেই ঘটনার মতোই তার ব্যাখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ এবং যার কাঁধে সেই ব্যাখ্যার দায়, সে ওই রকম ছটফট করবে না।

আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশ, আমাদের চারপাশ পচা ডেনমার্কের থেকেও অনেক বেশি পচে গিয়েছে। এই দেশ আর দ্বন্দ্বকে ভয় পায় না। দ্বন্দ্ব কী, সেটা চেনেই না। তাই স্বীকারও করে না। ভয় পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! ডেনমার্ক পচা হলেও বৈভবের কেন্দ্রস্থলে থাকা এক যুবকের দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই ভাবে দেখলে এই নাটক এই দেশে রেলিভ্যান্ট নয়। তবু আমি গর্বিত যে, কলকাতার মঞ্চে ‘হ্যামলেট’ হচ্ছে।

দ্বন্দ্ব, বিশৃঙ্খলা, পাগলামি, ঔদ্ধত্যের এই গল্প বলা হচ্ছে আমার ভাষায়। এতে আমি গর্বিত। আমার মনে হচ্ছে আমার চারপাশ এখনও শুকিয়ে মরে যায়নি। আমি জানি আমার দেশ ডেনমার্কের থেকেও বেশি পচনে আক্রান্ত। তবু আমি ‘হ্যামলেট’ দেখব বারবার। কারণ, এই পচনশীল দেশে দাঁড়িয়ে ‘হ্যামলেট’ আমার কাছে টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য ‘আন্সার’।

আরও অজস্র কথা, দর্শন, সংলাপ এই প্রযোজনা মাথার ভিতর তৈরি করে। কিন্তু সেগুলোকে অক্ষর দিতে গেলে আমায় আরেকবার দেখতে হবে। আমি আবার দেখব। তার পরে জন্ম নেবে আরও কিছু অনুভূতি। জানাব তখন।

শেষ করি সুন্দরের ব্যাপারটা দিয়ে। ‘হ্যামলেট’ হিংস্র, নৃশংস, ব্যথাতুর কিন্তু পাশবিক। সুন্দরের চেয়ে বেশি হিংস্র, নৃশংস এই অসুন্দর পরিপার্শ্বে আর কী-ই বা আছে। এই চরিত্রে তোর সৌন্দর্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভাল থাক।

অনির্বাণ’দা

অন্য বিষয়গুলি:

Hamlet Anirban Bhattacharya Riddhi Sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy