‘‘আজ মেরে পাস বিল্ডিং হ্যায়, প্রপার্টি হ্যায়, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হ্যায়, বাংলা হ্যায়, গাড়ি হ্যায়— ক্যায়া হ্যায় তুমহারে পাস?’ বিজয়রূপী অমিতাভ বচ্চনের এই সংলাপকে টেক্কা দিয়ে শশী কপূরের ঠোঁটে অমর হয়ে আছে সেই উত্তর, ‘‘মেরে পাস মা হ্যায়’।
শশী কপূর মানেই ‘দিওয়ার’ ছবির সেই স্মরণীয় মুহূর্ত, যা কিনা গত চল্লিশ বছর ধরে আপামর ভারতবাসীকে কাঁদিয়েছে, আবেগে ভাসিয়েছে, ভাবাপ্লুত করেছে।
শশী কপূর মানে উদ্দাম যৌনতায় ভরা কনরাড রুকস-এর ‘সিদ্ধার্থ’। জিনাত আমন থাকলেও ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ মানে কিন্তু শশী কপূরও।
প্রথাগত ধারার চেনা পথের বাইরে হাঁটা এক মানুষ মানে যেমন শশী কপূর, তেমনি অন্য দিকে ভারতীয় চকোলেট বয় হিরোর প্রথম ইমেজটা যেন তিনিই স্থির করে দিয়েছিলেন। এক সময় কোনও অষ্টাদশীর বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছবির মুখ মানেই শশী কপূর। কিন্তু সেই ইমেজকে বারবার টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অন্য এক শশী কপূরও। কখনও আর্মি অফিসার, কখনও পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে অভিনয় করে প্রমাণ করেছেন তাঁর দাপট। সেই অভিনয়ে পাওয়া যেত হলিউডি ঘরানার ছোঁয়া।
‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’, ‘নিউ দিল্লি টাইমস’, পৃথ্বী থিয়েটার, জেনিফার কেন্ডাল এক দিকে তো অন্য দিকে শশী কপুর মানে রোম্যান্সের মিষ্টি হাসি।
মুখভঙ্গিতে দেখা দিত সততা, স্বচ্ছতার সারল্য। বিভ্রান্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁর অভিনীত পুলিশ অফিসার চরিত্র মানুষের মনে জাগিয়ে তুলত প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাস। ফলে সহজ বিশ্বাস আর ভালবাসা আদায় করে নিত শশী কপূরের অভিনয়।
শোনা যায় ‘আনন্দ’ ছবিতে রাজেশ খন্নার চরিত্র তাঁরই করার কথা ছিল। অসাধারণ সুপুরুষ শশী কপূরই ছিলেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পছন্দ। কিন্তু রাতারাতি বদলে যায় সিদ্ধান্ত। ‘‘প্রথম দিন শ্যুটিং করতে গিয়ে শুনি রাজেশ খন্নাকে আমার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সই করানো হয়েছে। আমাকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে দিই। হৃষীকেশের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ ছিল না। এর আগেও এই রকম অনেক ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। তাই আমি দুঃখ পাই না।’’ কিছু বছর আগে সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন শশী।
শশী কপূর ওরফে বলবীর রাজ পৃথ্বীরাজ কপূরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৮ মার্চ এই কলকাতা শহরেই। জন্মের এই বন্ধন যেন চিরকালের। এই শহরেই নাটক করার সুবাদে দেখা হয় ভাবী স্ত্রী জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে ছিল তাঁর দীর্ঘকালের আসা যাওয়া। এ প্রসঙ্গে পরিচালক সন্দীপ রায় বললেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে সস্ত্রীক আসতেন শশী কপূর। বাবার সঙ্গে খুব ভাব ছিল ওঁর। বাবা যখন অসুস্থ, মনে পড়ে উনি নার্সিং হোমে দেখতেও গিয়েছিলেন। ‘চারুলতা’ যে বার ভেনিসে যায় সেই বছর ভেনিসে আমন্ত্রিত হয় শশী অভিনীত ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’। ওখানে বাবার সঙ্গে শশীর খুব আড্ডা হত বলে শুনেছি। তা ছাড়া আমার পরিচালনায় ফেলুদা সিরিজে অভিনয় করেছিলেন শশীজি। ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ করার সময় দেখেছি প্রচণ্ড পেশাদার অভিনেতা আর এক শশী কপূরকে। যে ক’দিন শুটিং ছিল দারুণ মজা হয়েছিল এখনও মনে আছে।’’
রবি-বিজয়
তখন এখন
কেমন আছেন আজ সেই শশী কপূর?
শোনা যায় শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে ভুগছেন। তা সত্ত্বেও আড্ডায় খামতি নেই। লন্ডন থেকে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার এলে শশীর বাড়িতে যাবেনই। সেখানে দু’জনের আড্ডা হবেই। আজও ‘দিওয়ার’য়ের বিজয় ওরফে অমিতাভ চলে যান মাঝে মাঝেই তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিতে।
আভিজাত্য আর বনেদিয়ানায় শশী বরাবরই তাঁর সমসাময়িক অভিনেতা ও কপূর খানদানের আর সব সদস্যদের থেকে আলাদা। সেই কারণেই তাঁর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া নিয়ে গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আজ উচ্ছ্বসিত। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, প্রযোজনার কাজে তাঁর প্যাশন ধরা পড়ে প্রতিটা স্তরে। ব্যতিক্রমী ভাবনাচিন্তা ছিল বলেই ‘জুনুন’ কিংবা ‘উৎসব’য়ের মতো ছবি প্রযোজনা করেছেন। ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ বলেই ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মানের পালক আজ তাঁর মুকুটে।
কপূর পরিবারের প্রথিতযশা তিন ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শশী হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজগুণেই আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁদের বাবা পৃথ্বীরাজ কপূরও ছিলেন ভারতীয় সিনেমা ও থিয়েটারের এক কিংবদন্তি। থিয়েটার আর সিনেমা কপূর পরিবারের রক্তে, মজ্জায়। সেই ঐতিহ্যকেই বয়ে নিয়ে গিয়েছেন শশী কপূর। শশী যখন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকেন তখন তাঁর দুই ভাই রাজ কপূর ও শাম্মি কপূর সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। তাঁদের রাজকীয় জুতোতে পা গলানো শশীর পক্ষে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শশী ক্যামেরার সামনে প্রথম আসেন শিশুশিল্পী হিসেবে। ‘আগ’ এবং ‘আওয়ারা’ ছবিতে তিনি রাজ কপূরের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম আবির্ভাব ‘ধরমপুত্র’ ছবিতে ১৯৬১ সালে। দেশভাগের পটভূমিতে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সেই ছবির গল্প। এই সাফল্যর পর শশী এগিয়ে যান বাণিজ্যিক ছবির সফলতার দিকে। অভিনয় করেন ‘যব যব ফুল খিলে’ তে। কেরিয়ারের প্রথম বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন নন্দা। নন্দার সঙ্গে আটটি ছবিতে অভিনয় করেন শশী। তাঁর আর নন্দার অন স্ক্রিন রেমিস্ট্রি তখন তুঙ্গে। শশী প্রায়ই নন্দার অভিনয়ের প্রশংসা করতেন।
কভি কভি
‘সিলসিলা’ ‘আ গলে লগ যা’
‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ‘যব যব ফুল খিলে’
রোম্যান্টিক নায়ক শশী তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। পাশাপাশি আলো ছড়াচ্ছেন আন্তর্জাতিক সিনেমা দুনিয়াতেও। করে ফেলেছেন ‘হাউসহোল্ডার’ আর ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’র মতো আন্তর্জাতিক ছবি। ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে তিনিই প্রথম হলিউড থেকে ডাক পান। শুধু অভিনয় করেন বললে কম বলা হয়, অর্জন করেন চূড়ান্ত সাফল্য।
সত্তরের দশকে মাল্টি স্টারার ছবির ঢল নামল যখন, সেখানেও শশী কপূর আলাদা করে নজর কাড়ছিলেন। বহু তারকাখচিত ছবিতে তিনি দেখা দিতেন মুখ্যচরিত্রে। ‘কভি কভি’, হোক কী ‘দিওয়ার’ ‘ত্রিশূল’ হোক কী ‘শান’, ‘দো অউর দো পাঁচ’ হোক কী ‘সিলসিলা’ বা ‘নমক হালাল’ সব ছবিতেই উজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁর। অমিতাভ বচ্চনের মতো সুপারস্টারের মুখোমুখি অভিনয় করেও তাঁর অভিনয়সত্তা কোথাও খর্ব হয়নি। অমিতাভের সঙ্গে অভিনয়ের সময় তাঁর পরিমিত অভিনয় বোধ প্রতিটা ছবিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
অভিনয় করতে করতেই ঢুকে পড়েন প্রযোজনার জগতে। রাসকিন বন্ডের লেখা ‘এ ফ্লাইট অফ পিজিয়ন’ অবলম্বনে প্রযোজনা করেন ‘জুনুন’। উচ্ছ্বসিত প্রশংসার পাশাপাশি সে ছবি পায় জাতীয় পুরস্কার-সহ আরও নানা উচ্চমানের সম্মান। উল্লেখ্য ‘জুনুন’য়ে নিজের অভিনয় নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট না-থাকায় সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ঘটনাক্রমে জাতীয় পুরস্কাটি দেওয়া হয় নাসিরউদ্দিন শাহকে। ‘স্পর্শ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য। এর পর ১৯৮৫ সালে শশী কপূর সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান ‘নিউ দিল্লি টাইমস’য়ের জন্য। শশী কপূর প্রযোজিত ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’, ‘উৎসব’, ‘কলযুগ’— এই সব ছবি সমালোচকদের প্রশংসাধন্য হলেও বক্স অফিস সাফল্য সে
ভাবে পায়নি। ‘উৎসব’ প্রযোজনার পর শশী তো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। পৃথ্বীরাজ কপূর যদি ভারতীয় নাট্যজগতের অগ্রপথিক হন, তা হলে শশী কপূর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। পৃথ্বী থিয়েটারের মাধ্যমে শশীর পরিবার তাঁর বাবার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আজও।
তারকা হয়েও নিজের ব্যক্তিত্বকে মাটির কাছাকাছি রাখতে জানেন শশী। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আদৌ আমি ভারতীয় সিনেমায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি কিনা জানি না।’’ শাম্মি কপূর ছিলেন রোম্যান্টিক হিরো। অন্য দিকে রাজ কপূর ছিলেন অনন্য পরিচালক। শশী কপূরের মধ্যে এই দুই মেধার সমন্বয় ঘটেছিল।
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রির মত একটাই, এত দিনে শিল্পী তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy