Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Sex Worker

Women's Day Special: যৌনকর্মীদের মতো স্বাধীন নারী ‘ভদ্র’ সমাজে বিরল, নারী দিবসে লিখলেন এক যৌনকর্মী

নারী দিবসে আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য কলম ধরলেন এক যৌনকর্মী। তাঁর ইচ্ছে অনুসারে এই লেখায় তাঁর নাম প্রকাশ করা হল না।

‘এত যে নারীদিবসের আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে, আমাদের ঘরে কিন্তু আজও অন্ধকার ঘুচল না।’

‘এত যে নারীদিবসের আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে, আমাদের ঘরে কিন্তু আজও অন্ধকার ঘুচল না।’

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ১০:৫৮
Share: Save:

আমার কথা কেউ বা কারা জানতে চাইছে! সেই আমি, যৌনপল্লির অন্ধকারে জন্ম যার। সেই আমি, যে অবশেষে মায়ের পেশা বেছে নিয়েছিলাম মেয়ের দুধ জোগাড় করব বলে। সেই আমি, যে ঘর না পেয়ে রাতের পর রাত রাস্তায় ঠোক্কর খেয়েছে। সেই আমি, যার ঘরে সমাজের বড় মাথারা হাজির হয়েছেন। অথচ সমাজ যাকে মেনে নেয়নি।

আপনারা কি মেনেছেন আমায়? এত যে নারীদিবসের আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে, আমাদের ঘরে কিন্তু আজও অন্ধকার ঘুচল না। সব আলোর দেশের মানুষেরা আসলে অন্ধকারে আমাদের ঘরে আসেন। তাই তাঁরা সকলেই ‘সাধু’। আর আমরা তো আলোর মতো পরিষ্কার। আমাদের কাজে কোনও লুকোছাপা নেই। তাই যত ঘেন্না আর কালি আমাদের ঘিরে।

তবে বদলের দিনও আসছে। এখন আর সেই ৮০-৯০ দশকের দিন নেই। মেয়েরা এক জোট হয়ে নিজেদের চাওয়ার কথা বলতে পারে। সমাজের অনেক মানুষ আমাদের মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। তাও, আমি যখন লিখছি, সেই তো বলছি ‘আমাদের মতো মানুষ’। আমরাও কি নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে পেরেছি? পারিনি তো!

আনন্দবাজার অনলাইন যখন নারীদিবসে আমার জীবন নিয়ে লিখতে বলল, তাদেরও তো বললাম, নিজের নামে লিখব না। নিজের ছবি ব্যবহার করতে দেব না। এত বছর পরেও নিজেকে নিয়ে এত সঙ্কোচ আমার। এই সঙ্কোচের কারণ পিছুটান। আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ।

আমার মা যৌনকর্মী ছিলেন। যৌনপল্লির জীবন থেকে আমায় দূরে রাখতে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সব দায়িত্ব ছিল মায়ের। ফলে আমিও মায়ের রোজগারের টাকায় ‘ভদ্র’ সমাজে বড় হতে থাকি। মনে আছে, মায়ের কাছে ছুটে ছুটে গেলে মা ভীষণ বিরক্ত হত। আমার কষ্ট হত। মা কেন কাছে টেনে নিচ্ছে না আমায়! বড় হয়ে বুঝেছি, মা ওই পরিবেশে রাখতে চাইত না আমায়। অথচ বিধাতার তৈরি করা নিয়মে আমিই যৌনপল্লির সেই মরচে-ধরা ইটপাথরের পাঁজরেই নিজেকে সঁপে দিলাম।

‘আমি জানি, আমার ছেলেমেয়ে না দেখলেও আমার মেয়েরা আমার মুখে আগুন দিয়ে দেহটা পুড়িয়ে দেবে।’

‘আমি জানি, আমার ছেলেমেয়ে না দেখলেও আমার মেয়েরা আমার মুখে আগুন দিয়ে দেহটা পুড়িয়ে দেবে।’

প্রেম। প্রেমেই সর্বনাশ! ১৩ বছর বয়সে আমার প্রেম। তার পরেই বিয়ে। সন্তান। স্বামী প্রথমে ভালবাসলেও পরে মুখ ফিরিয়ে নিল। যৌনপল্লিতেই যাতায়াত শুরু করল। ছোট্ট মেয়ের মুখের খাবার যোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্ববোধও তৈরি হল না ওর। অগত্যা এক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হলাম। কিছু কাজও করতে শুরু করলাম। নির্দিষ্ট অঞ্চলে আমাদের মতো মেয়েদের নানা বিষয় নিয়ে সচেতন করতাম। সেই আমার ঘর থেকে বেরোনো শুরু হল।

বিয়েটা ভাঙলাম। মা শরীর বিক্রি করে আমার সংসার টানতে শুরু করল। কত করবে মা? মায়ের ওখানকার মাসিরা সবাই আমায় বলল, চলে আসতে!

সত্যি কথাই লিখছি। আমার একটুও খারাপ লাগেনি। ছোটবেলা থেকেই এই এলাকার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি। শরীর বিক্রিও এক ধরনের পেশা। যেমন শিক্ষক বা চিকিৎসক। আমি মায়ের ওখানেই ঘর নিলাম। কাজ শুরু করলাম। কোথায় খারাপ? দেখলাম, এ তো সোজা পথেই টাকা রোজগার! এখন তো কলেজে পড়া মেয়ের দলও দেখি এই পেশায় আসছে। দেখেছি যৌন খিদে মেটাতে বড় ঘরের মহিলারা স্বামীকে লুকিয়ে টাকা দিয়ে আমাদের পাড়ায় ঘরভাড়া করে অন্য পুরুষ নিয়ে রাত কাটায়। আবার রাতেই ফিরে যায়। ওরা তো ‘ভদ্র’ সমাজের। তাই লুকিয়ে কাজ করে। আমাদের ‘ভদ্র’ হওয়ার দায় নেই। লজ্জাও নেই। আর তাই আমি কিন্তু আমার মায়ের মতো আমার মেয়েকে আমার থেকে আলাদা করে রাখিনি। ওখানেই বড় করেছি। স্কুলেও পড়িয়েছি।

‘বিধাতার তৈরি করা নিয়মে আমিই যৌনপল্লির সেই মরচে-ধরা ইটপাথরের পাঁজরেই নিজেকে সঁপে দিলাম।’

‘বিধাতার তৈরি করা নিয়মে আমিই যৌনপল্লির সেই মরচে-ধরা ইটপাথরের পাঁজরেই নিজেকে সঁপে দিলাম।’

তবে ঠকেছি। একবার নয়। অজস্র বার ঠকেছি। শরীর পুড়লেও তখনও মন পোড়েনি আমার। আবার এক পুরুষের প্রেমে পড়ি। আবার ঠকি। এই ঠকে যাওয়ার মাঝে জন্ম নেয় আমার ছেলে। জীবন চলতে থাকে।

২০২২-এ এসে মনে হচ্ছে, মেয়েরা কেন বিয়ে করে? ভালবেসে একসঙ্গে থাকুক না! মা হতে চাইলে দত্তক নিয়ে নিক। বিয়ে কেন? ঘেন্না ধরে গিয়েছে!

এ ভাবেই মেয়েকে মানুষ করেছি। সে এখন সরকারি চাকরি করে। ছেলে অ্যাপ বানায়। সে-ও চাকরি খুঁজছে। আমিও পেশা ছেড়েছি। বয়স তো হল। মোটা হয়ে গেলাম। এখন আর কে শরীরের কদর করবে? মা সঙ্গে আছে। আমরা নুন-ভাত খেয়েও বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। তবে কিছু মানুষ আমার চলার পথকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দিনী’দি ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার। রংগন চক্রবর্তী, অমিতাভ মালাকার — এই মানুষগুলো না থাকলে আমি এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেতাম না।

দিব্যি আছি এখন। আমাদের মতো স্বনির্ভর, স্বাধীন জীবন কাটানো কতজন নারী আছেন? আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি খুব কম।

মেয়ে-জামাই-ছেলে, সকলের সঙ্গেই খুব ভাল সম্পর্ক আমার। বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করি যেমন ইচ্ছে তেমন। মাঝে মাঝে পুরনো কিছু চেনা মানুষ বা পুরুষ— যে নামেই ডাকুন না কেন, আমায় ভিডিয়ো কল করেন। আমি মজা করে বলি, “আগে অনলাইনে টাকা পাঠাও, তার পরে গল্প হবে।” মজা লাগে। হাওয়া খেলে যায়। আনন্দ পাই। মনের আনন্দই সব।

মৃত্যুর ভয় নেই কিন্তু আমার। জানেন তো, মৃত্যুর পরেও যৌনকর্মীরা একা হয় না! তাদের দেহ গলেপচে পড়ে থাকে না। আমি জানি, আমার ছেলেমেয়ে না দেখলেও আমার মেয়েরা আমার মুখে আগুন দিয়ে দেহটা পুড়িয়ে দেবে।

‘ভদ্র’ সমাজ শুনছেন? ‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’, ‘যৌনকর্মী’— যে নামেই ডাকুন আমাদের, লড়াইয়ে আমরা প্রথম থেকেই জিতে আছি। আমরা একা নই।

(নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মী)

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE