‘প্রধান’ ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে দেব, অতনু (বাঁ দিকে) এবং অভিজিৎ। ছবি: সংগৃহীত।
প্রযোজক হিসেবে এক জন তাঁর শেষ চারটে ছবিতেই দেবকে নিয়েছেন। তার মধ্যে তিনটে ছবি আবার পরিচালনা করেছেন একই ব্যক্তি। প্রথম জন টলিপাড়ার প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী। দ্বিতীয় জন পরিচালক অভিজিৎ সেন। দু’জনেই মনে করেন, দেবকে ছাড়া তাঁরা অসম্পূর্ণ। টলিপাড়ার অন্যতম সফল জুটির ছবি ‘প্রধান’-এর মুক্তি আসন্ন। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার এক কাফেতে তাঁদের জুটির সাফল্যের নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটন করলেন অতনু এবং অভিজিৎ।
প্রশ্ন: ‘প্রধান’ মুক্তি পাচ্ছে। কী মনে হচ্ছে, ‘সুপারহিট’-এর হ্যাটট্রিক হবে?
অতনু: আমি বিষয়টাকে অন্য ভাবে দেখি। আমার কাছে এটা ছবির গুণগত মানের উত্তরণ। ‘টনিক’-এর পর ‘প্রজাপতি’ নিয়ে দর্শকের উৎসাহ বেশি ছিল। আমরা আশা করছি, ‘প্রধান’-এ হয়তো সেটা আরও একটু বাড়বে।
অভিজিৎ: আমরা যখন ছ’নম্বর ছবি করব, তখনও হয়তো এই বিশ্বাস থেকেই করব। ছবি তো সন্তানের মতো। তাই আমাদের কাছে প্রত্যেকটা ছবিই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: তার মানে, ষষ্ঠ ছবির পরিকল্পনাও মাথায় রয়েছে।
অভিজিৎ: অবশ্যই। কারণ আজকে যেখানে পৌঁছেছি, সেটা তো অতনুদার জন্যই। ফিল্ম স্কুল থেকে পড়াশোনা করার পর রাজকুমার হিরানির সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। ২০০৯ সাল থেকে ছোট পর্দায় কাজ করছি। কিন্তু তার পরেও কেউ সুযোগ দেয়নি। এত জনের মধ্যে থেকেও অতনুদা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। তাই ওঁকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।
প্রশ্ন: আপনাদের প্রথম আলাপ কী ভাবে হয়?
অতনু: একটা রিয়্যালিটি শোয়ে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তার পর একদিন আমার সঙ্গে এসে দেখা করেন। বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়। তার পরে ওঁর সঙ্গে মাঝে যোগাযোগ ছিল না। তার পর আবার সাক্ষাৎ। সেই যে আলোচনা শুরু হল, সেখান থেকেই ‘টনিক’ হল।
প্রশ্ন: অভিজিৎ আপনি রাজকুমার হিরানির কথা বললেন। এই প্রথম ওঁর ছবির (ডাঙ্কি) সঙ্গেই আপনার ছবি মুক্তি পাচ্ছে। ওঁর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
অভিজিৎ: হ্যাঁ। মাঝেমধ্যেই কথা হয়। কী ছবি তৈরি করছি, তার সবটাই উনি জানেন। ‘প্রধান’-এর জন্যও আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সত্যি বলছি, কোনও দিন ভাবিনি যে গুরু এবং শিষ্যর ছবি একই সঙ্গে মুক্তি পাবে। এক দিকে ভয়ও করছে, আবার তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ভাল লাগাও রয়েছে। যেন বাবা এবং ছেলে একই সঙ্গে খেলতে নেমেছে। মনে হচ্ছে, বক্স অফিসে আমরা দু’জনেই জমিয়ে খেলব (হাসি)।
প্রশ্ন: ‘ডাঙ্কি’ দেখবেন না?
অভিজিৎ: আপাতত ‘প্রধান’ নিয়েই ব্যস্ত থাকব। তার পর সময় করে ‘ডাঙ্কি’ দেখব।
প্রশ্ন: ‘সাঁঝবাতি’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। দেবের সঙ্গে পর পর চারটে ছবি। প্রযোজক হিসেবে এই বিষয়টাকে কী ভাবে দেখেন?
অতনু: আমরা একটা টিম হিসেবে কাজ করি। আমাদের তিন জনেরই একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। নতুন ছবি নিয়ে ভাবনাও দেব জানে। তবে আমাদের গল্পে দেব কিন্তু অনায়াসে ফিট করে যায়। তাই পর পর ওর সঙ্গে কাজ করি।
অভিজিৎ: নিয়ে পর পর তিনটে ছবিতে দেব কিন্তু সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই এসেছে। ছবিগুলোতেও ওর অভিনয়ে কোনও খামতি নেই। দেবকে বাদ দিয়ে গল্প ভাবছি, সেটাও কিন্তু নয়।
প্রশ্ন: কিন্তু প্রত্যেক বার দেবকে মাথায় রেখে ছবি ভাবলে, সেটা কি শৈল্পিক স্বাধীনতায় বাধা দিতে পারে?
অভিজিৎ: না। তার কারণ, দেব যে কোনও চরিত্রে মিশে যেতে পারে। গুড় ভাল হলে সেটা যে ছাঁচেই ঢালা হবে, সেই আকারের মিষ্টি তৈরি হবে। অভিনেতা হিসেবে দেবও কিন্তু সে রকম।
প্রশ্ন: দেব ছাড়া আপনার এই চারটে ছবি কি সমান জনপ্রিয় হত বলে মনে হয়?
অতনু: অন্য কেউ থাকলে কী হত, সেটা আমি জানি না। আমার মতে, এই মুহূর্তে বাংলায় দেবের মতো ভাল অভিনেতা এবং সুপারস্টার আর নেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা মাথায় রেখেই বলছি, আমাদের দেখা শেষ সুপারস্টার উত্তমকুমার। তার পর কেউ থাকলে সেটা দেব। কাউকে অসম্মান না করেই বলছি, যত দিন যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার, উপস্থিতি, অভিনয়— সব দিক থেকে দেব কিন্তু উত্তমকুমারকেও ধীরে ধীরে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একজন সম্পূর্ণ সুপারস্টার। আগামী প্রজন্মের কাছে দেব একটা দৃষ্টান্ত।
প্রশ্ন: আপনাদের কী মনে হয়, সিনেমায় ‘টিম’ বড়, না কি তারকা?
অতনু: একটা সময় তারকার মুখ দেখে দর্শক ছবি দেখতে আসতেন। কিন্তু এখন সবার থেকে বড় কনটেন্ট। বিষয় ভাল হলে, সেখানে তার পরে অভিনেতারা চলে আসেন। ইন্ডাস্ট্রির অন্য ‘সুপারস্টার’দের দেখছি, তাঁরাও তো ছবি চালাতে পারছেন না!
অভিজিৎ: দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবার আগে গল্পে দম থাকতে হবে। অমিতাভ বচ্চনের সব ছবি তো সুপারহিট হয়নি! তার মানে কি, তিনি খারাপ অভিনেতা? তার মানে, নিশ্চয়ই গল্পে কোনও গলদ ছিল। তার পরে টিম ওয়ার্ক থাকে।
প্রশ্ন: ‘প্রধান’-এ ট্রেলার দর্শক পছন্দ করেছেন। কিন্তু এ রকম বক্তব্যও উঠে আসছে যে, ছবিটা চরিত্রের ভিড়ে জর্জরিত।
অতনু: দেখুন, অভিনেতারা এসেছেন গল্পের প্রয়োজনে। ছবিটা দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে।
অভিজিৎ: ছবির অভিনেতারা জনপ্রিয় মুখ বলেই হয়তো এটা মনে হচ্ছে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে বলছি, প্রতিটা চরিত্রকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে ছবি ঠিক দুর্গাপুজোর মতো। বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে পরিবারের প্রত্যেকে এসে একসঙ্গে কয়েকটা দিন সময় কাটাচ্ছেন। সেখানে কার চরিত্র ছোট বা বড়, সে প্রশ্নও কেউ করেন না। ফলে সময়ের সঙ্গে আমাদের এই পরিবারটা বাড়ছে। আজকে ‘প্রধান’-এ এঁরা অভিনয় না করলে অন্য কেউ করতেন। তাঁরা অপরিচিত হলে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা উঠত না।
প্রশ্ন: চলতি সপ্তাহে তো হিন্দি এবং দক্ষিণী বড় ছবি মুক্তি পাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা’। শো পাওয়া নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
অতনু: ‘টনিক’-এর সঙ্গে ‘এইট্টি থ্রি’ ছিল। ‘প্রজাপতি’-র সঙ্গে ছিল ‘সার্কাস’। তার পরেও ফলাফল কী হয়েছিল, সেটা সকলেরই জানা। আমি আমার ছবি নিয়ে কনফিডেন্ট। এখনও পর্যন্ত জানি, ১২০টিরও বেশি পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে ‘প্রধান’। সেটা ‘টনিক’-এর থেকে অনেকটাই বেশি। আমি খুব খুশি।
প্রশ্ন: পারিবারিক গল্পে পুরনো অভিনেতাদের ফিরিয়ে আনা— শুরু থেকেই কি ছবি তৈরির ক্ষেত্রে দু’জনে এই ভাবনা নিয়েই এগিয়েছিলেন?
অভিজিৎ: মানুষ তো এখনও তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, অজয় কর বা প্রভাত রায়, অঞ্জন চৌধুরী এবং হরনাথ চক্রবর্তীর ছবি দেখতে পছন্দ করেন। সিনেমা যেন মানুষ উপভোগ করেন, সেটাই আমার মাথায় কাজ করে। কারণ, দিনের শেষে ছবি দর্শককে বিনোদন দেয়।
অতনু: আমার কাছে সিনেমা সবার আগে বিনোদনের মাধ্যম। তাই দর্শক যেন সেটা পায়, সে দিকে নজর বেশি থাকে। সেখানে বাস্তব জীবনের ছবি প্রতিফলিত হলে, সেই ছবির সঙ্গে দর্শক আরও বেশি রিলেট করতে পারবেন।
প্রশ্ন: টলিপাড়ার প্রথম সারির অভিনেতারা নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য ফোন করেন।
(অতনু হাসতে শুরু করলেন)
অভিজিৎ: অনেকেই ফোন করেন। আমিও সেটা জানি। শুধু অভিনেতারা নন, বহু পরিচালকেরও ফোন আসে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে অতনু অন্য পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলে আপনি কি খুশি হবেন?
অভিজিৎ: পর পর কেউ ভাল ছবি করলে, তাঁর সঙ্গে যে বাকিরা কাজ করতে চাইবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। শুধু আমি কেন, বাকিদের সঙ্গেও দাদা কাজ করতে পারেন। তা ছাড়া শুধুই আমি ছবি করব, আর কেউ করতে পারবে না, এ রকম কোনও মানসিকতা আমার নেই। ভাল ছবি কেউ পরিচালনা করলে তো আমিও তার থেকে শিখতে পারব!
প্রশ্ন: দেবের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের অবনতি নিয়েও ইন্ডাস্ট্রিতে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এটা কি সত্যি?
অতনু: (হেসে) আমরা তিন জনেই এই ধরনের গুজব উপভোগ করি। এই তো সে দিন দেবকে বললাম যে, এ বার আমরা রাস্তায় মারপিট করে একটা ভিডিয়ো রেকর্ড করে পোস্ট করি। সেটা শুনে দেবও রাজি। খুব ভাল একটা আইডিয়া। আসলে আমাদের তিন জনের মধ্যে মতামত আদানপ্রদানের জায়গাটা খুবই স্পষ্ট। একে অন্যের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিই। এটা তো একটা পরিবার।
প্রশ্ন: আপনার সাফল্য দেখে ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার সঙ্গে দেবের সম্পর্ক নিয়ে কেউ গুজব ছড়াচ্ছে বলে মনে হয়?
অতনু: দেখুন, এমন অনেক পরিচালক রয়েছেন, যাঁদের ছবির পোস্টারের আঠা শুকনোর আগেই ছবি হল থেকে উঠে যায়। পোস্টারেই ‘সুপারহিট’! হলে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ছবি আদপে কত জন দেখছেন। এ সব নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না। ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার ভাল সম্পর্ক। তাই আমার বিশেষ শত্রুও নেই বলেই মনে হয়।
প্রশ্ন: নতুন নায়িকাদের সুযোগ দিচ্ছেন। বাংলায় কিন্তু দীর্ঘ দিন নতুন কোনও নায়ককে লঞ্চ করা হয়নি। আপনার কোনও ভাবনা নেই?
অতনু: এটা ঠিকই। আমার তো ইচ্ছে করেই। কিন্তু এখন ছবি গল্পই তারকা। সুপারস্টারের থেকে অভিনেতার কদর বেশি। সেখানে যদি কখনও প্রতিভাবান নতুন কোনও অভিনেতা থাকেন, তাঁকে নিশ্চয়ই সুযোগ দেব। আর নতুন সুপারস্টার তৈরি করতে হলে মশলা বাণিজ্যিক ছবিকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আমি আর অভিজিৎ যে ছবি তৈরি করছি, সেটাকে ‘নিউ এজ পপুলার ফিল্ম’ বলা যায়। আগামী পাঁচ-সাত বছর মনে হয় এই ধারাটা চলবে। আমার বিশ্বাস, বাকিরাও ধীরে ধীরে আমাদের এই ভাবনা গ্রহণ করবেনই।
প্রশ্ন: পরের ছবিতেও তা হলে দেব থাকছেন তো?
অতনু: (মুচকি হেসে) অবশ্যই।
অভিজিৎ: আমাদের এখানে দেব সশরীরে উপস্থিত না থেকেও কিন্তু উপস্থিত (হাসি)। তাই দেবকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই ভাবি না।
অতনু: আমরা অনেকটা ওই ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের মতো (হাসি)।
প্রশ্ন: নতুন ছবির ঘোষণা কবে?
অতনু: আগামী ১লা জানুয়ারি (হাসি)।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy