আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি ‘ছোটলোক’-এর পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রশ্ন: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়তেন। হঠাৎ এফটিআইআই যাওয়ার কথা ভাবলেন কেন?
ইন্দ্রনীল: চুঁচুড়ার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আশির দশকে বড় হয়েছি। সে সময় রবিবার দুপুরে দূরদর্শনে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা দেখানো হত। আমি হঠাৎই এক দিন সেটা আবিষ্কার করি। মফস্সলে তো কেউ এ সব দেখতে বলবে না। আমার বাড়িতে তামিল, তেলুগু, মালয়ালি, মরাঠি ছবি দেখার চলও ছিল না। কিন্তু আমার দেখতে বেশ ভালই লাগত। শুক্রবার রাতে ওয়ার্ল্ড সিনেমা দেখানো হত। ‘ভারত এক খোঁজ’-এর মতো বেশ অন্য রকমের অনেক সিরিয়াল সে সময় হত। এগুলো দেখে আমার বেশ একটা ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল। তবে এ সব নিয়ে যে কোনও রকম কাজকর্ম করা যায়, তার কোনও ধারণা আমার ছিল না। আমি ভাবতাম, পারিবারিক সূত্রে চেনাশোনা না থাকলে এ সব নিয়ে কাজ করা যায় না। তার পর হঠাৎই জানতে পারলাম, পুণেতে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে সিনেমা বানানো শেখানো হয়। তখন থেকে আমার সিনেমা নিয়ে কিছু করার আগ্রহটা আরও দৃঢ় হল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এসে ফিল্ম ক্লাবের কথা জানতে পারলাম। সে সময় অনেকে চলচ্চিত্র চর্চা করছেন। প্রচুর প্রাক্তনী আসতেন, যাঁরা এফটিআইআই থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। এই যোগাযোগগুলো হয়তো মফস্সলের কোনও কলেজে পড়লে সম্ভব হত না। গোর্কি সদন, ম্যাক্স মিউলার ভবন বা নন্দনে সে সময় বিনামূল্যে বা খুব কম টাকার টিকিটে অনেক দেশ-বিদেশের ছবি দেখতাম। তার পর এফটিআইআই-এর পরীক্ষা দিয়ে পেয়েও গেলাম। এ ভাবেই শুরু করেছিলাম।
প্রশ্ন: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পড়ুয়ারা এফটিআইআই থেকে পাশ করে মুম্বই চলে যান। আপনি কলকাতা ফিরে এলেন কেন?
ইন্দ্রনীল: এখন মুম্বইয়ে নানা রকমের কাজ হয়। তখন হত না। কোনও ধারণা ছিল না, ভবিষ্যতে ইন্ডাস্ট্রি কোন দিকে যেতে পারে। আর সত্যি বলতে কি, বাংলা ছবি করব বলেই এফটিআইআই যাওয়া। কোনও দিন ভাবিনি, হিন্দিতে কাজ করব। তবে মুম্বই গেলে হয়তো বিজ্ঞাপনের কাজগুলোয় অনেক সুযোগ বেশি থাকত। সে সময় আমার অবশ্য এত বোধবুদ্ধি ছিল না। দেখতাম, এফটিআইআই থেকে পাশ করে বেশির ভাগ সহপাঠী টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি নিচ্ছে। সে সময়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা বেশ খারাপ। আমাদের মতো পরিচালকদের জন্য তখন খুব একটা সুযোগ ছিল না। দূরদর্শনে কিছু ফ্রিল্যান্স কাজ করতাম। আমাদেরই সিনিয়র অমিত সেন সে সময় মূলত বাংলাদেশের বহু বিজ্ঞাপন করতেন। আমি তিন বছর ওঁর সঙ্গে অনেক বিজ্ঞাপন করেছিলাম। তার পর নিজের একটা প্রযোজনা সংস্থা খুলে একা বিজ্ঞাপন করার চেষ্টা করি। কিন্তু একদমই সফল হয়নি। কারণ, বিজ্ঞাপনের সাফল্য শুধু আপনার কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করে না। মার্কেটিং আর পিআর-এর দরকারও পড়ে। আর আমি সে সবে একদমই পারদর্শী নই।
প্রশ্ন: সেই ব্যর্থতার পরেই কি ছবি বানানোর দিকে বেশি করে ঝুঁকলেন?
ইন্দ্রনীল: প্রায় সাত-আট বার ছবির করার কথা হয়েছিল। একটা ছবি তো প্রায় শুরু করে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বুঝতে পারছিলাম না, আমার ছবি কোনও দিন কেউ করবে কি না। ছবি করতে হলে সে সময় বড় কোনও প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হত। তারা সে সময় যে ধরনের ছবি বানাচ্ছিল, দেখেই বুঝতে পারতাম, আমি ঠিক মানিয়ে নিতে পারব না। আর বাকিদের গতিবিধি বোঝা মুশকিল। এমনিতেই এখানে অসৎ লোক বেশি। তাদের সঙ্গে ডিল করতে করতে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ১৭ বছর ধরে নানা রকম টেলিফিল্ম করেছি। অনেকে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু কোনও দিন কোনও প্রযোজক আসেনি। হতাশ হয়ে ভাবছিলাম, এ সব ছেড়ে অন্য কোনও উপায়ে উপার্জন করব কি না। ২০১৩ সালে হঠাৎ আমার এক পুরনো বন্ধু আমায় ‘ফড়িং’-এর জন্য বলে। পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার বলতে পারেন। কারণ, বহু বছর এই বন্ধুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। এই ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পর অবশ্য অনেকে আমার কথা জানতে পারেন।
প্রশ্ন: তার পর কি প্রযোজক পাওয়ার রাস্তাটা আর একটু সহজ হয়?
ইন্দ্রনীল: গত ১০ বছরে আমার বদনাম বা সুনাম দুটোই ছড়িয়েছে। ‘ফড়িং’-এর পরেও অনেক আজেবাজে লোক আমায় ডাকার চেষ্টা করেছিল। ২০১৫ সালে একটি ছবি শুটিংয়ের এক মাস আগে ছেড়ে দিই। কারণ, ছবিটা গন্ডগোলের। এক বার ঢুকে পড়লে ফেঁসে যাব। তাই সব কাজ করেও এক পয়সা না নিয়ে ছেড়ে দিই। পরে দেখলাম, আমার সন্দেহ ঠিক ছিল। যে ছবি বানানোর কথা হয়েছিল, সেটার আইনি স্বত্ব ওদের কাছে ছিল না। তাই বুঝতেই পারছেন, ‘ফড়িং’-এর পরেই সব কিছু খুব সহজ হয়ে যায়নি। তবে ধীরে ধীরে যেটা হয়েছে, তা হল আমি ছবি ‘না’ করতে শিখেছি। কলকাতা শহরে পরিচালকেরা সাধারণত কখনও ‘না’ বলেন না। কিন্তু আমার শর্ত মতো সব কিছু না হলে আমি বলি। আমি আগেই বলে দিই, ছবির কাজ এক বার শুরু হলে তার মধ্যে কেউ ঢুকতে পারবে না। টাকাপয়সায় হেরফের করলে আমি মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিই। নতুন প্রযোজক এলে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে আমি তাঁদের সিভি দেখতে চাই। অনেকে এটাকে আমার দম্ভ বলে মনে করেন। কিন্তু এই পন্থা নিয়ে জীবন থেকে অনেক আবর্জনা ঝেড়ে ফেলা গিয়েছে। এতে হয়তো আমার পথ অনেকটা সরু হয়ে গিয়েছে। তবে আমার ব্যাপারে ভাল করে না জেনে অন্তত কলকাতায় আর কেউ আমায় ডাকে না। আমি বুঝে গিয়েছি যে, আমার কোনও দিনও টন টন ছবি হবে না। কিন্তু সেটা তো আমি করতেও চাই না।
প্রশ্ন: যে সময় কাজ শুরু করেছিলেন, সে সময়ের চেয়ে এখন নিজের মতো করে ছবি করার সুযোগ কি অনেক বেশি পান?
ইন্দ্রনীল: একটা জিনিস সত্যি যে, সে সময় অন্তত সিনেমার ব্যবসা ভাল হত। যে সংখ্যাটা শোনা যেত, সেটা বাড়িয়ে বলা সংখ্যা নয়। এখন শুধু বাংলা নয়, সব জায়গার সিনেমার ধরন বদলে গিয়েছে, দর্শক বদলে গিয়েছে। আগে অপর্ণা সেন বা গৌতম ঘোষের ছবি দর্শক হলে গিয়ে দেখতেন। এখন একটু অন্য রকম ছবি করার সুযোগ অনেক বেশি হতে পারে। কিন্তু দর্শক আর এই ছবিগুলো দেখতে সিনেমাহলে যান না। তাঁরা পরে ওটিটি-তেই দেখে নিতে চান। তাই যে ধরনের ছবি দেখতে হল পর্যন্ত যাচ্ছেন দর্শক, পরের ছবিগুলোও সব একই ধরনের তৈরি হচ্ছে। আমরা গত ২০ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনও নতুন পরিচালক তৈরি করতে পারিনি। হয়তো চাইনি বলেই পারিনি। একই রকম ছবি দেখে দর্শকও ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। সব মিলিয়ে সিনেমার ব্যবসার ক্ষতি বিশ্ব জুড়েই হচ্ছে।
প্রশ্ন: তা হলে সিনেমার কি ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে করছেন?
ইন্দ্রনীল: স্করসিসি-ট্যারান্টিনো— সকলেই তো বলছেন যে সিনেমার মৃত্যু ঘটছে। কাজেই আমি না বলার কে! গত ১০-১২ বছরে পৃথিবীটা পুরো পাল্টে গিয়েছে। এত হিংস্রতা, এত উগ্রতা, যুদ্ধের এত উল্লাস আগে ছিল না। মানুষ যে প্রায় জান্তব হয়ে উঠছে, তার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। অন্যতম সমাজমাধ্যম। এই পাগলের পৃথিবীটা তো সমাজমাধ্যম আরও বেশি করে তৈরি করছে। মানুষের মনোযোগ কমে গিয়েছে। তারা এখন সিনেমা দেখতে দেখতে ফোন করে, খায়, বাচ্চা সামলায়, বেরিয়ে যায়। এই অস্থির সময়ে একটা গোটা সিনেমা বসে দেখা কি সম্ভব? মাল্টিপ্লেক্সের উত্থান ভারতবর্ষে সিনেমার মৃত্যুর পিছনে একটা বড় কারণ। তবে শুধু সিনেমা কেন? থিয়েটার, সাহিত্য, কবিতা এবং আমাদের রাজনৈতিক জীবন— সব কিছুরই মৃত্যু ঘটছে।
প্রশ্ন: এমন অস্থির সময় পরিচালক হিসাবে আপনাকে কী অনুপ্রেরণা জোগায়?
ইন্দ্রনীল: এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সিনিসিজ়মের সঙ্গে লড়া খুব কঠিন। কিন্তু তার মধ্যেও নিজেকে বোঝাতে হয়, এইটুকুই আমি করতে পারি। তখন মনে হয়, আচ্ছা চুপচাপ নিজের কাজটাই তা হলে করে যাই। কারণ আমার ক্ষমতা খুব সীমিত। আমি পৃথিবীর কিছুই আর পাল্টাতে পারব না। তবে আমি নিজের পরিবেশ খানিকটা বদলাতে পারি। আমার পরিবেশ যেমন বাংলা সিনেমার কাজের জগৎ। সেখানে নিজের মতো কাজ করি। আমি আলসে হতে পারি, বিশৃঙ্খল হতে পারি, খারাপ সিনেমা বানাতে পারি, কিন্তু অসৎ ছবি বানাই না। নিজের কাছে মিথ্যে কথা বলি না। অন্তত সেই দিক থেকে আমি তৃপ্ত। বাকিটা তো সবই টিকে থাকার লড়াই।
প্রশ্ন: সেই টিকে থাকতেই কি ওটিটি-তে আসা? এর পর কি বড় প্রযোজনা সংস্থায়ও কাজ করবেন?
ইন্দ্রনীল: ওটিটি-তে এসে যদি আমায় খুব আপস করতে হত, তা হলে সেটাকে আমি নিজের হার বলে মানতাম। ‘ছোটলোক’-এর সময় জ়ি ফাইভ আমার শুট বা এডিটে একদম হাত দেয়নি। কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। যেগুলো লজিক্যাল মনে হয়েছিল, শুনেছিলাম। কিন্তু এটা বদলাতে হবে, ওটা বদলাতে হবে, এ সব একদমই বলেনি। প্রযোজনা সংস্থা ছোট হোক বা বড়— আমার কোনও সমস্যা নেই। যত ক্ষণ না আমার কাজে তারা নাক গলাচ্ছে। আমার সৃজনশীল স্বাধীনতা থাকলেই হল। সেটা হলে আমার কোনও সংস্থার সঙ্গেই কাজ করতে অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: আপনাকে কোনও বড় সংস্থা এখনও পর্যন্ত কোনও প্রস্তাব দিয়েছে?
ইন্দ্রনীল: হ্যাঁ, প্রস্তাব এসেছিল। উদ্যোগটা তাদেরই ছিল। আমি আসলে গত ১২-১৩ বছর ধরে কোনও ছবি নিয়ে কাউকে ফোন করিনি। কিন্তু সেই সময়ে মতে মেলেনি। বাট ইট ওয়াজ অ্যামিকেব্ল। তাই ভবিষ্যতে অবশ্যই কাজ করতে পারি।
প্রশ্ন: ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর কলকাতার প্রযোজক আপনি নিজেই ছিলেন। ছবির প্রচারের দিকটা সামলাতে ভাল লাগে?
ইন্দ্রনীল: প্রচারের কৌশল তৈরি করার জন্য আমি ঠিক লোক নই। তবে কাজটা ভাল একদম লাগে না বলা যাবে না। নিজের দর্শকদের বোঝা, ছবির বাজার বোঝা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু সমস্যা হল, গোটা সিস্টেমটা স্বচ্ছ নয়। তাই শুধু লজিক দিয়ে গোটাটা ক্র্যাক করা যায় না। সেটা করতে গেলে ‘সফ্ট পাওয়ার’ ব্যবহার করতে হবে। সেটার জন্য প্রয়োজন যোগাযোগ। সেখানেই আমি খুব দুর্বল।
প্রশ্ন: সেই কারণেই কি ‘মায়ার জঞ্জাল’ এত প্রশংসিত হওয়া সত্ত্বেও খুব বেশি চলেনি?
ইন্দ্রনীল: আমি একটা জিনিস বুঝে গিয়েছি, ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর মতো ছবি বাঙালি শুধু নন্দনেই দেখবেন। সেখানে ৭০ টাকার টিকিট, তার পর ফিশ চপ। সব মিলিয়ে ২৫০ টাকায় সপরিবার গোটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সে গেলেই সেটা ২৫০০ টাকা। বাংলা ছবিকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তা হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে মধ্যবিত্ত ছবি দেখার সুযোগ পায়। না হলে তারা ওটিটি-তেই ছবি দেখবে।
প্রশ্ন: তা হলে অন্য রকম ছবি করতে চাইলে ওটিটি-ই কি একমাত্র ভরসা?
ইন্দ্রনীল: ওটিটি কোন দিকে রূপ নেবে, কেউ জানে না। কিছু কিছু অন্য রকম কাজ হয় বটে। ভারতবর্ষে এখন ওটিটি-কে ‘টিভি প্লাস’ বানিয়ে দেওয়ার দিকে একটা চাপ তৈরি হচ্ছে। আসলে যাঁরা ওটিটিগুলো সামলাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই তো টেলিভিশন থেকেই গিয়েছেন। তাই তাঁরা টেলিভিশনের প্রশিক্ষণ এবং লজিকই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। এটা একটা অন্য রকমের দৌড়। সেই দৌড়ে কিন্তু ‘ছোটলোক’-এর মতো সিরিজ়গুলো এক একটা ‘ডিজ়রাপ্টার’। আরও এ রকম হবে কি না, তা নির্ভর করছে আর কত জন ‘ছোটলোক’ বানানোর সুযোগ পাচ্ছেন। হিন্দিতে তা-ও কিছুটা জায়গা তৈরি হয়েছে। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে এখনও সেগুলো সে ভাবে ফল দিতে পারেনি। টেলিভিশন দিনের শেষে অর্থ আনে। ১০ বছর আগের মতো স্বর্ণযুগ না থাকলেও এখনও টেলিভিশন লাভজনক। যত ক্ষণ না অন্য ধরনের কাজগুলো সেই লাভ আনতে পারবে, তত ক্ষণ লড়াইটা চলবে। কী হবে জানি না। তবে ‘ছোটলোক’ সেই লড়াইয়ের একটা অংশ। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে অনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালককে ওটিটি-তেই আসতে হচ্ছে। কারণ, তাঁর আগের জায়গাটা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে। হনশল মেটা, সুজয় ঘোষ, বিশাল ভরদ্বাজ— যাঁরাই একটু অন্য রকম কাজ করছেন, সবাই এখন ওটিটি-তে। তাঁরা যে রকম কাজ করবেন ভবিষ্যতে, ওটিটি সেই দিকেই ঝুঁকবে। তাঁরা যদি আপস না করেন, তা হলে ওটিটি একটা ভরসার জায়গা হবে। আশা করা যায়, বাংলাও সেটা অনুকরণ করবে। কারণ, বাংলার এখন আর নিজের মতো করে ভাবার জায়গা নেই। মুম্বইয়ের কর্পোরেট সংস্কৃতিকে এখানে কোনও ক্রমে তৈরি করার চেষ্টা চলে। তবে আমি খুব আশা করে বসি আছি, টিভিওডি (যেখানে প্রয়োজন মতো গ্রাহক কোনও ছবি বা কনটেন্ট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া করে দেখতে পারেন) মডেলের দিকে। সেটাই আমাদের মতো পরিচালকদের জন্য আশার জায়গা।
প্রশ্ন: হিন্দিতে ‘কোহরা’, ‘স্কুল অফ লাইজ়’, ‘স্কুপ’-এর মতো নানা রকম কাজ হয়। কিন্তু বাংলায় কেন একই ধরনের সিরিজ়ের একের পর এক সিজ়ন তৈরি হচ্ছে?
ইন্দ্রনীল: গোটাটাই মার্কেট রিসার্চের উপর নির্ভরশীল বলে। আপনি যদি কোনও দর্শককে জিজ্ঞেস করেন, আপনার কী দেখতে ভাল লাগে, তাঁরা তো যা দেখেছেন, তার মধ্যে থেকেই বেছে নেবেন। প্রশ্নটাই তো ভুল। এ ভাবে কখনও বোঝা যাবে না যে, দর্শকের কী দেখার ইচ্ছা। এই ধরনের সমীক্ষা কোনও পণ্যের জন্য ঠিক আছে। যেমন ধরুন টুথপেস্ট। কেউ আশা করেন না যে, তাঁর টুথপেস্টের এক এক দিন এক এক রকম স্বাদ হবে। তবে ছবির ক্ষেত্রে আমাদের সেই চমকটাই তো চাই। এত সহজ একটা কথা এখানে কেউ বুঝতে চান না। কারণ, তাতে একটা ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশও বেশ কম বাজেটে কাজ করে। কিন্তু তাদের অনেক কাজ দেখে বেশ টাটকা লাগে। তারা যেটা পারছে, আমরা কেন পারছি না?
ইন্দ্রনীল: কারণটা রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক। আমি মনে করি, বাংলা সিনেমার বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ, আমাদের বাংলা ভাষার সঙ্গে কোনও যোগ নেই। অনেক পরিচালককে দেখেছি, বাংলা ভাষায় ছবি করছেন, কিন্তু গোটা সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে দিচ্ছেন। অবাক লাগে দেখে যে, তাঁরা বাংলায় কথাই বলেন না। ভাষার এক অবিশ্বাস্য অবদমন আমরা ঘটিয়েছি। সার্বিক ভাবে এখন আর কেউ ভাষাটাকে সম্মান করে না। চলচ্চিত্রকাররাও করেন না, অভিনেতারাও করেন না। তাই বাংলা ছবির মান এত নীচে। আমাদের চেয়ে বাংলাদেশের ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। তা ছাড়া, দীর্ঘ রাজনৈতিক ডামাডোলের পর ওরা তুলনামূলক ভাবে একটি থিতু পরিস্থিতি পেয়েছে। যে সময় ওরা প্রথম নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক ভাবে জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করছে। তাই জাতির একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওদের অনেক কাজের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে। সেটা সিনেমা, ক্রিকেট, সবেতেই আছে। ওদের আরও একটা বড় গুণ হল, ওরা খুব হাত মিলিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে। ওদের পরিচালকদের একটা দল রয়েছে। কেউ লিখলে, অন্য জন পরিচালনা করে। কেউ শুট করলে, তার বন্ধু গিয়ে অ্যাসিস্ট করে। কারণ, ওরা মনে করে, ওটা তাদের দায়িত্ব। তবে ভবিষ্যতে ওরা কোন পথ নেয়, সেটা দেখার। কারণ, শুধু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কথা ভাবলে হবে না। যদি কোরিয়া, ইরান বা জাপানের মতো একটা জাতীয় সিনেমা তৈরি করতে পারে, যেখানে মূল ধারা এবং অন্য ধারার সিনেমার সহাবস্থান রয়েছে, তা হলেই একটা প্রোডাক্টিভ দিশা পাওয়া যাবে। ওদের মাঠ এখন ফাঁকা এবং এই মুহূর্ত রাষ্ট্র ওদের সঙ্গে। তাই চাইলে ওরা করতেই পারে।
প্রশ্ন: ‘ছোটলোক’ থ্রিলার হলেও সমাজের অনেক আঙ্গিক তুলে ধরেছে। এই ধরনের চিত্রনাট্য লিখতে কতটা সময় লাগে?
ইন্দ্রনীল: আমার সব মিলিয়ে ৬-৭ মাস লেগেছে। সেটা বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে ভাবাই যায় না। তবে সিনেমাতে চিত্রনাট্য খারাপ হলেও দর্শককে ভাল অভিনয়, ভাল স্পেশ্যাল এফেক্ট, ভাল গান— কোনও না কোনও কৌশলে দেড় ঘণ্টা ধরে রাখা যায়। ওটিটি-তে কোনও ভাবেই এক জনকে ৯টা পর্ব ধরে রাখতে পারবেন না। বিদেশে সব সিরিজ়ের একটা বড় ‘রাইটিং টিম’ থাকে। এখানে থাকে না, লেখকদের সে ভাবে টাকাও দেওয়া হয় না। তাই অধিকাংশ চিত্রনাট্য এত দুর্বল হয়। লেখকদের ছ’মাস প্রশিক্ষণ দিলেই কিন্তু অনেকটা উন্নতি করা সম্ভব।
প্রশ্ন: ‘ছোটলোক’-এ মুখ্য চরিত্রে দামিনী বেণী বসুকে দেখে সকলেই ছিটকে গিয়েছেন। আপনার ছবির কাস্টে বরাবরই চমক থাকে। বাছাই করেন কী ভাবে?
ইন্দ্রনীল: ‘ফড়িং’ ছিল সোহিনীর (সরকার) বড় পর্দায় প্রথম কাজ। তার আগে ওকে নিয়েও কেউ ভাবেনি। তবে আমার কাস্টিংয়ের প্রক্রিয়া পুরোটাই সাধারণ বুদ্ধির উপর দাঁড়িয়ে। এখানে সকলে সিস্টেমকে দোষ দেয়। কিন্তু নতুন কিছু করার কথা বলার আগেই লোকে সব কিছুতে রাজিও হয়ে যায়। আপনি কী চাইতে পারেন, সে কথা ভেবে আগেই টেবিল সাজিয়ে নিয়ে যায়। তাই বাংলা ছবির কাস্টিং এত একঘেয়ে হয়ে যায়। বইতে পড়েছিলাম, চিত্রনাট্য অনুযায়ী অভিনেতা বাছাই করা উচিত। আমি তো সে ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক কিছু করছি না। আগে কিন্তু এ রকম ভাবেই কাজ হত। এখন হয় না বলে আমার কাজের ধরন নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু আমি অস্বাভাবিক কিছুই করছি না। উল্টো দিকে যেটা হচ্ছে, সেটা বরং অস্বাভাবিক। অভিনয় না জানলেও কেন এক জন সুন্দর দেখতে মেয়েকেই আমাদের বার বার দেখে যেতে হবে? হিন্দি সিনেমায় কত সাধারণ চেহারার অভিনেতারা এখন গোটা ছবিতে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায়। বেণীর মতো এক জন অভিনেতাকে যে এখানে কেউ কাস্ট করে না, সেটা আমাদের দৈন্য।
প্রশ্ন: এখানে যা চলে, তা-ই তৈরি হয়। ‘ছোটলোক’ অনেকের খুব ভাল লেগেছিল। তা হলে কি আপনি আরও অনেক ধরনের কাজ করতে পারবেন? না কি আরও পাঁচটা ‘ছোটলোক’-ই করতে হবে?
ইন্দ্রনীল: এই উত্তরটা ‘অফ দ্য রেকর্ড’ দেওয়াই ভাল। কারণ, সত্যিটা খুব একটা সুখের নয়।
প্রশ্ন: বেশ, কিন্তু ‘ছোটলোক’-এর দ্বিতীয় সিজ়ন আসবে কি না, অন্তত সেটা বলুন।
ইন্দ্রনীল: সাবিত্রী মণ্ডলের চরিত্রটা আমি কিন্তু একটা ফ্র্যাঞ্জাইজ়ি তৈরি করব ভেবেই লিখেছিলাম। না হলে এত পরিশ্রম করতাম না। তবে সেই গল্পগুলো অন্য হবে। ‘ছোটলোক’ হবে না। আমি আশা করছি, করতে পারব। দেখা যাক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy