ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় , রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, শতরুপা সান্যাল, সঞ্জয় নাগ, নাগার্জুন, অভিজিৎ গুহ, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় , বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
একা থাকা মানুষ... ঘর ধরে বেঁচে আছে। সেই ঘরে তার ছোটবেলার চাঁদ পূর্ণিমা হয়ে ঝরে।
বড়মা বা আলাদা হয়ে যাওয়া বউ আর তার ছেলের সঙ্গে তার কথা বলা। গল্পের বিষয় রোজের দিন। রূপচাঁদা মাছের ঝাল থেকে ডিমের মামলেটের কুচনো পেঁয়াজ... একাই চলে।
এ ভাবে চলতে চলতে এক দিন সেকালের বাহারি কেদারা বাড়িতে নিয়ে আসে সে, কেদারায় বসে নিজেকে জমিদার ভাবে... কেদারা? নাকি ক্ষমতার আসন? একা মানুষ? ছোটবেলা থেকে বউবেলা... ঘুরতে থাকে। এই রূপকথন আসলে এক বাংলা ছবির মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এল। যার নাম ‘কেদারা’। পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। ‘‘অনেক গল্প, কথা গানের মধ্যে দিয়ে বলা যায় না। সিনেমার হাত ধরতে হয় তাই। আমি একা মানুষ। একা মানুষের গল্প বলেছি। তবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় রাজি না হলে এই ছবি করতাম না।’’ শান্ত স্বরে বললেন ইন্দ্রদীপ। এ বছর হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, সাউন্ড ডিজাইন, সর্বোপরি সেরা ছবির সম্মান পেল ‘কেদারা’।
ফিল্ম উৎসবের সূচনা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ‘উড়ো জাহাজ’ দিয়ে। এই ছবিতে মোটর মেকানিক তার স্বপ্নের জন্য ছুটে একাকার। তার না পাওয়ার হাহাকার আর গার্হস্থ্যের গাঢ় প্রেম। ছবির ক্যানভাসে মেঠো সুর।
মরচে পাতার জীবন? লড়াই? যেন বাংলা ছবির আর এক জীবন কল্পনার পথ...
একা থাকার আর এক গল্প বাঁধলেন পরিচালক সঞ্জয় নাগ। ‘ইয়োর্স ট্রুলি’ ছবিতে। সোনি রাজদানের অভিনয়ে বারে বারে চমক। ছবি দেখে আপ্লুত সঙ্গীত পরিচালক এম এম কিরাভানি বললেন, ‘‘দারুণ গল্প। দেবজ্যোতি মিশ্রর কাজও খুব ভাল। আমি কিন্তু বাংলা আর পাকিস্তানি সঙ্গীতকে সবার ওপরে রাখি।’’ বাহুবলীর সঙ্গীত পরিচালক গেয়ে উঠলেন, ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে...’।
আবারও লাল মাটির রাস্তা। সবুজ ক্ষেত। কুয়াশা ঘনায় মনে মনে। সে কুয়াশা রাজনীতির নগ্ন রক্তাক্ত হাতে কালো হয়ে ওঠে আবার তীব্র আগুন ঘেরা প্রেমে আলো ছড়ায়। রাজনীতির আঙিনায় সম্পর্ক নাকি সম্পর্কের রাজনীতি? পরিচালক শৈবাল মিত্র প্রশ্ন রাখলেন সিনেমার দর্শকদের কাছে। ‘তখন কুয়াশা ছিল’ ছবিতে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়। ‘‘ভাবতেই পারিনি সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাবো।’’ উচ্ছ্বসিত বাসবদত্তা। চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘তারিখ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য রাইমা সেনের সঙ্গে সেরা অভিনেত্রীর সম্মান ভাগ করে নিলেন তিনি।
আসলে হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বিভিন্ন ঘরানার বাংলা ছবিকে হায়দরাবাদের দর্শকদের রুচির সামনে হাজির করল। এমন সব ছবি যা হয়তো ফেস্টিভ্যাল ছাড়া দেখার সুযোগ পাবেন না হায়দরাবাদের মানুষ। ‘‘বাংলা ছবির স্বার্থেই আমার হায়দরাবাদ আসা। দর্শকদের কাছে যাওয়া। ছবি দেখে তাদের রিঅ্যাকশন বোঝা। সেখানেই ফেস্টিভ্যালের গুরুত্ব। এ বার নাগার্জুন উদ্বোধনে ছিলেন। এটা একটা বিশাল পাওয়া। আমি ছোটবেলায় ওর সঙ্গে একটা কাজ করেছিলাম। মনে পড়ে গেল। উদ্যোক্তাদের ভাবনাকে স্বাগত জানাই,’’ বললেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। রঞ্জন ঘোষের পরিচালনায় ঋতুপর্ণার ‘আহা রে’ দেখানো হল হায়দরাবাদে। নাগার্জুন অনায়াসে বললেন, ‘‘আমি বাংলা ছবি করতে চাই। কেউ বলে না।’’ তবে তাঁর ছবি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ নিয়ে তিনি খুবই উত্তেজিত। জানালেন, তাঁর পরিচালক তো বাঙালি। অয়ন মুখোপাধ্যায়।
ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন করলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।
রাজনীতি, মনকেমন, একাকিত্ব, প্রেম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড়কে শহুরে বাস্তবতায় সিনেমাকে ধরলেন পরিচালক ইন্দ্রনীল ঘোষ, তাঁর প্রথম ছবি ‘শিরোনাম’-এ। মিডিয়ার সোজাকে ধূসর করে বিক্রি করার পন্থায় দাম্পত্যের ভাঙন না কি অন্য কোনও সম্পর্কের বুনোট? চারপাশের নির্মম ঘটনার গল্প বলায় ‘শিরোনাম’ মনখারাপকে ছুঁয়ে দিল। প্রথম বার ছবি দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। অসাধারণ তাঁর অভিনয়। সঙ্গে যিশু সেনগুপ্ত। অঙ্কিতা চক্রবর্তী এ ছবিতে নিজেকে যে ভাবে ভেঙেছেন তা দেখার মতো।
ভেঙে ভেঙে সহজ কথা বলা। সহজ ছবির নতুন ভাষা দিলেন নতুন পরিচালক অর্জুন দত্ত। ‘অব্যক্ত’। মা ও ছেলের সম্পর্কের কথা ভেতর থেকে ঘা দিয়ে যায়। আদিল হুসেন আর অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। দেখানো হল সুব্রত সেনের ‘মানব মানবী’।
উপন্যাস লিখতে গিয়ে চরিত্রেরা যদি জীবন্ত হয়ে যায়? সম্পর্কের জটিল সমীকরণে ব্রেখটীয় ন্যারেটিভে মুখোমুখি দাঁড় করান কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর চরিত্রদের। অন্য দিকে প্রতিম ডি গুপ্ত বলে যান, প্রতিটি হৃদয় নতুন করে গল্প বলে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গেল ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ ছবিতে। ডাক্তার আর রোগীর সমীকরণে রহস্য এনে পরিচালক সুদেষ্ণা রায় আর অভিজিৎ গুহ সময়কে ধরলেন এই ছবিতে।
ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
বাংলা ছবির ফেস্টিভ্যালে ভাষা কখনও পথ আটকাতে পারে না। সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তারা দেখালেন দিলীপ দেও-র ছবি ‘আনওয়ানটেড’। দানিশ রেন্জুর ‘হাফ উইডো’। বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের বহু চর্চিত ‘ভায়োলিন প্লেয়ার’। দর্শকদের সঙ্গে বৌদ্ধায়নের প্রশ্নোত্তর পর্বে ছবির প্রেক্ষিতে উঠে এল আদিল হুসেন আর ঋত্বিক চক্রবর্তীর ভিন্ন অভিনয় ধারার প্রসঙ্গ।
নিজামের শহরে বাংলা ছবি দেখাই নয়, এই ফেস্টিভ্যালে দর্শক সরাসরি প্রশ্ন করলেন নানা ছবি নিয়ে। প্রিয় অভিনেতাদের সঙ্গে সেলফি তোলা থেকে সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। শুধু আলাপ নয়, সিনেমাকে ঘিরে তৈরি হল তর্কের মঞ্চ। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায়, অভিজিৎ গুহ, রঞ্জন ঘোষ, শৈবাল চট্টোপাধ্যায়, শেখর রায় প্রমুখ।
আরও পড়ুন: ফ্লপথেকে থেকে সুপারস্টার: মহানায়কের উত্তম-জীবনের আখ্যান
বাংলা ছবি বললে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকে বহির্বিশ্বের বাঙালি এখনও থেমে আছে। এর শুরু কোথায়? ‘পথের পাঁচালী’-র নাম আসে কেন বার বার? বাংলা ছবি কি অন্যান্য প্রাদেশিক ছবি নির্মাণের চেয়ে এগিয়েছে? কেউ বললেন, ‘‘বিদেশে বাঙালি ফিল্মমেকার মানে সত্যজিৎ রায়।’’ কেউ সরাসরি তার প্রতিবাদ জানালেন। সামনে রাখলেন ‘নগরকীর্তন’-কে।
তর্ক রইল। থাকল ডিনার টেবিলে হালিম খেতে খেতে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আড্ডা। নায়িকাদের বিয়ে আর প্রেম নিয়ে গল্প।
কেউ ঢুঁ মারলেন গোলকোন্ডা ফোর্টে। কেউ পাবে। কেউ মুক্তাহারের খোঁজে। পুরস্কারের মঞ্চে খোলা মনে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ের প্রশংসা করলেন ঋতুপর্ণা। এ শুধুমাত্র হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রইল না, হয়ে উঠল আস্ত একটা দুর্গাপুজো বা সিনেমা পুজো।
এ ভাবেই দিন পেরিয়ে রাত। রাতের গায়ে হাল্কা বৃষ্টি। চারমিনারের ঐশ্বর্যে বাংলা ছবি তৈরি করল সিনেমার নতুন প্রান্তর। যেখানে দর্শকের দেখার মন আর সিনেমার শরীর মিলেমিশে একাকার!
ছবি: সমরজিৎ সরকার এবং হায়দরাবাদ বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
আরও পড়ুন: শেষকৃত্যে ছিল না বলিউড, পদ্মভূষণজয়ী প্রবীণ অভিনেতার মৃত্যু হয়েছিল নিঃস্ব অবস্থায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy