Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Satyajit Ray

প্রোফেসর শঙ্কু এই দুঃসময়ে কি যোগাযোগ করছেন প্রফেসর হেসোরাম হুঁশিয়ারের সঙ্গে?

১৯২২ সালের মাঝামাঝি হেসোরাম হুঁশিয়ার কারাকোরাম বন্দাকুশ পাহাড়ের জঙ্গলে নিজস্ব ছোট দল নিয়ে ঘুরছিলেন।

সত্যজিৎ রায় এবং প্রোফেসর শঙ্কু

সত্যজিৎ রায় এবং প্রোফেসর শঙ্কু

বিভাস রায়চৌধুরী
বিভাস রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২১ ২৩:৩৯
Share: Save:

দুই তুখোড় চরিত্র ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু। ফেলুদা বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় গোয়েন্দা। প্রোফেসর শঙ্কুও কম যান না। কল্পবিজ্ঞান পড়তে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের কাছে প্রোফেসর শঙ্কু অতি প্রিয়জন। শঙ্কুর ডায়েরির পাতায় দুঃসাহসিক সব অভিযানের কথা।

কে এই প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু?

সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট এই চরিত্রটি একজন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা টমাস আলভা এডিসনের পরেই মহান উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁকে। প্রোফেসর শঙ্কু জানেন ৬৯টি ভাষা। ৭২টি আবিষ্কার তাঁর ঝোলায়। হায়ারোগ্লিফিক পড়তে পারেন। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার দুর্বোধ্য লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন। ব্রাজিলের রাটানটান ইন্সিটিউট থেকে লাভ করেছেন ডক্টরেট। সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মান।

কোথায় অভিযানে যাননি তিনি? সারা বিশ্ব তাঁর করতলগত। সাহারা মরুভূমি থেকে আফ্রিকার অরণ্য, আমাজন থেকে মিশরের ফারাওয়ের সমাধি, সমুদ্রের তলদেশ থেকে অজানা দ্বীপ-- অনন্য তাঁর অভিজ্ঞতা। তিনি গিয়েছেন মঙ্গল গ্রহেও। আর শঙ্কুর যে ডায়েরি পড়ে আমরা তাঁর বিষয়ে জানি, উল্কার পিঠে চেপে তা এসেছে পৃথিবীতে! আরও বিস্ময়, এই ডায়রির লেখাগুলি মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদলায়। কখনও কিছুতেই নষ্ট হয় না (কিন্তু পিঁপড়েয় খেয়ে ফেলতে পারে)।

প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে ক’টি গল্প লিখেছেন সত্যজিৎ রায়? 'শঙ্কু সমগ্র'-এ আছে ৩৮টি পূর্ণাঙ্গ গল্প এবং ২টি অসম্পূর্ণ গল্প। পাঠকের কাছে কবে আবির্ভূত হন শঙ্কু? ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে (১৯৬১ সাল)। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায় সত্যজিৎ লেখেন প্রথম শঙ্কু-কাহিনি। নাম ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। পাঠকের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়।

সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়

প্রথম শঙ্কু-কাহিনির শুরুতে দেখা যায় তারকবাবু লেখকের কাছে নিয়ে এসেছেন একটি ডায়েরি। সেটা প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়েরি। গল্পে লেখক বিস্মিত-- “প্রোফেসর শঙ্কু বছর পনেরো নিরুদ্দেশ। কেউ কেউ বলেন তিনি নাকি কী একটা ভীষণ এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারান। আবার এও শুনেছি যে তিনি নাকি জীবিত, ভারতবর্ষের কোনও অখ্যাত অজ্ঞাত অঞ্চলে গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, সময় হলে আত্মপ্রকাশ করবেন। এসব সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে এটা জানতাম যে তিনি বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তাঁর যে ডায়রি থাকতে পারে সেটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সে ডায়রি তারকবাবুর কাছে এল কী করে?”

তারকবাবুর কাছ থেকে জানা যায় সুন্দরবন অঞ্চলে একটি বড় উল্কাখণ্ড পড়েছে জেনে সেখানে তিনি গিয়েছিলেন। উল্কার গর্তের মধ্যে লাল-লাল কী একটা উঁকি মারছে দেখে মাটি থেকে টেনে তোলেন সেটি। তার পর শঙ্কুর নাম দেখে ডায়েরিটা পকেটে নিয়ে চলে আসেন। তারকবাবুকে কিছু টাকা দিয়ে ডায়েরিটা রেখে দেন লেখক এবং পড়তে শুরু করেন। ডায়রির পাতায় শঙ্কুর বয়ানে লেখা একটি অভিযানের গল্পই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’।

ডায়েরিতে আত্মকথনের ঢঙে অদ্ভুত চরিত্রের অদ্ভুত অভিযানের গল্প লেখার প্রেরণা কোথায় পেয়েছিলেন সত্যজিৎ? মনে পড়ে তাঁর বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের একটি গল্প ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরী’র কথা। ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। গল্পের শুরুতেই লেখা ছিল---

(প্রফেসর হুঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সন্দেশে সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানা কথা ছাপিয়েছি; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভুত শিকার কাহিনীর কোনও উল্লেখ করিনি। সত্যি, এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সেসব কাহিনী কিছুই জানতাম না, কিন্তু প্রফেসার হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরী থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এসব সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিও।)

ডায়েরি থেকে জানা যায় ১৯২২ সালের মাঝামাঝি হেসোরাম হুঁশিয়ার কারাকোরাম বন্দাকুশ পাহাড়ের জঙ্গলে নিজস্ব ছোট দল নিয়ে ঘুরছিলেন। সেখানে তিনি অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন এবং নতুন নতুন প্রাণীর দেখা পান। প্রাণীগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মজার সব নামকরণ করেন। যেমন, হ্যাংলাথেরিয়াম (সব গবগব করে খায়), গোমরাথেরিয়াম (খিটখিটে মেজাজের জন্তু), চিল্লানোসোরাস (কুমির সাপ মাছ সব মিলিয়ে এক ধরনের জন্তু, যে শুধু চিৎকার করে), বেচারাথোরিয়াম (নিরীহ ভিতু প্রাণী) ইত্যাদি। অসাধারণ কল্পনাপ্রসূত এইসব প্রাণী!

স্রষ্টা

স্রষ্টা

এই কল্পজগতেরই বৃহত্তর রূপ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। প্রোফেসর শঙ্কু যেন প্রফেসর হুঁশিয়ারের উত্তরাধিকার বহন করছেন। প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কার করেছিলেন অদ্ভুত সব জিনিস। যেমন, অ্যানাইহিলিন পিস্তল (শত্রু নিশ্চিহ্ন, অদৃশ্য হয়), মিরাকিউরল বড়ি (সর্বরোগনাশক), রিমেমব্রেন (স্মৃতি ফিরিয়ে আনার যন্ত্র), নস্যাস্ত্র (মানুষ মরে না, ৪০ ঘণ্টা অবিরাম হাঁচতে থাকে), শ্যাঙ্কোভাইট ধাতু (যা মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারে, মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্য এই ধাতু দিয়ে তিনি একটি প্লেন তৈরি করেন, যার নাম দেন শ্যাঙ্কোপ্লেন)। তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি আবিষ্কার এক্স ও অ্যান্টি-এক্স। এক্স মানুষকে হিংস্র দানব বানায়, অ্যান্টি-এক্স দানবকে আবার মানুষে ফেরায়।

পরলোকগত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য প্রফেসর শঙ্কু বানিয়েছিলেন ‘কম্পুডিয়াম’। সেই কম্পুডিয়ামের মাধ্যমে আজ হয়তো তিনি প্রফেসার হুঁশিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলছেন, “পিতঃ! সর্বনাশ!”

“কী হয়েছে?”

“আপনার ওই হ্যাংলাথেরিয়াম আমার অ্যান্টি-এক্স গবগব করে খেয়ে পালিয়েছে। এদিকে ল্যাবরেটরি থেকে চুরি গেছে এক্স। কারা যেন চারদিকে এক্স প্রয়োগে মানুষকে বানাচ্ছে দানব। মন খারাপ করে। প্লিজ কিছু করুন। বন্দাকুশ পাহাড়ে গিয়ে খুঁজে বের করুন আপনার হ্যাংলাথেরিয়াম-কে। তার কাছ থেকে ফিরিয়ে আনুন আমার অ্যান্টি-এক্স। পিতঃ... পিতঃ... শঙ্কু বলছিলাম…”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy