Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

বাংলায় বিশ্বকাপ

হচ্ছে ব্রাজিলেই। তবে প্রথম বারের জন্য বাংলায় তার ধারাভাষ্য। লিখছেন কৃশানু ভট্টাচার্যবাংলা চ্যানেলে বিশ্বকাপ। ঘরোয়া ফুটবলের গণ্ডি টপকে সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবলের মহামঞ্চে। ইতিহাস গড়ার পথে বাংলা বিনোদন চ্যানেল সোনি আট। ১২ জুন থেকে এই চ্যানেলে ২০১৪-র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মাঠে-মাঠে নেইমার-মেসি-ফান পার্সি-রিবেরি-রবেনদের পায়ের জাদু দেখার সাক্ষী থাকার পাশাপাশি রাত-জাগা বাঙালি দর্শক যে-ধারাভাষ্য শুনবেন, তা-ও বাংলায়। আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন? এ-ও কি সম্ভব?

ফান পার্সি, রুনি, মেসি, ওজিল ও নেইমার।

ফান পার্সি, রুনি, মেসি, ওজিল ও নেইমার।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০০:১৫
Share: Save:

বাংলা চ্যানেলে বিশ্বকাপ।

ঘরোয়া ফুটবলের গণ্ডি টপকে সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবলের মহামঞ্চে। ইতিহাস গড়ার পথে বাংলা বিনোদন চ্যানেল সোনি আট।

১২ জুন থেকে এই চ্যানেলে ২০১৪-র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মাঠে-মাঠে নেইমার-মেসি-ফান পার্সি-রিবেরি-রবেনদের পায়ের জাদু দেখার সাক্ষী থাকার পাশাপাশি রাত-জাগা বাঙালি দর্শক যে-ধারাভাষ্য শুনবেন, তা-ও বাংলায়। আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন? এ-ও কি সম্ভব?

বাঙালি দর্শকের জন্য এমনই ব্যবস্থা করেছে সোনি আট। “আজ পর্যন্ত ফুটবলের কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাংলা চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হয়নি। বাংলা চ্যানেলের পক্ষে যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছি আমরা,” দাবি করলেন এই চ্যানেলের শীর্ষ কর্তা তুষার শাহ।

বিশ্বকাপ সম্প্রচারের জন্য ফিফা রাইটস পাওয়ার পরে সোনি আট-এ সাজো সাজো রব। “৬৪টি ম্যাচের মধ্যে ৫৬টি সম্প্রচার করব আমরা।” বাঙালি দর্শককে বিশ্বকাপের এই মহাভোজে শামিল করার জন্য শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যাপক প্রচার। কফি মগে আটকানো সাদা-কালো বল। বিশ্বকাপের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি নানা মেমেন্টো। আর এ সবই তুলে দেওয়া হবে দর্শকদের হাতে।

কেন বাংলায় ধারাবিবরণী? ভারতে আন্তর্জাতিক ফুটবল সবচেয়ে বেশি দেখে বাঙালি দর্শক, দাবি করলেন তুষার। বর্তমানে সংখ্যাটি প্রায় ১.৮৪ কোটি। সর্বস্তরের বাঙালির সুবিধার জন্য তাই বাংলায় ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা।

চ্যানেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বাছা হয়েছে বলিউড তারকা জন আব্রাহামকে। “২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ সোনির কাছে। শৈশব থেকেই ফুটবল আমাকে টানে। বাংলার দর্শকের কাছে আমার অনুরোধ, বিশ্বকাপ দেখুন সোনি আটে। শুনুন বাংলায় ধারাভাষ্য,” বিশ্বকাপের আগেই জন বেশ তেতে আছেন।

ধারাভাষ্যের জন্য ইতিমধ্যেই চার জনকে অডিশনের পরে নির্বাচিত করেছে সোনি আটের মুম্বই ‘প্রোডাকশন টিম’। ভারতীয় ফুটবলের টিভি ভাষ্যকার হিসেবে ডা.পল্লব বসু মল্লিক অতি পরিচিত মুখ। স্পোর্টস মেডিসিনেও তিনি বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া আছেন জাতীয় লিগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-সালগাঁওকর-সহ ভারতের প্রাক্তন গোলকিপার কল্যাণ চৌবে।

আর থাকবেন দেবায়ন সেন ও দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে অলিভার কানের বিদায়ী ম্যাচই হোক বা ভাইচুং ভুটিয়ার বিদায়ী ম্যাচ, এশিয়ান গেমস বা কমনওয়েলথ গেমস— ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দেবায়নবাবু। তবে বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো মহামঞ্চে সবাই এই প্রথম! “চার ভাষ্যকারই পেশাদার এবং অভিজ্ঞ। সবাই খুব ভাল করেই জানেন তাঁদের কী করতে হবে এবং কী ভাবে করতে হবে”, স্পষ্ট স্বীকারোক্তি তুষারবাবুর।

অবসর নেওয়ার পরে ফুটবল বিশেষজ্ঞ হিসেবে কল্যাণ কাজ করেছেন বিভিন্ন বাংলা চ্যানেলে। দূূরভাষে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে তিনি চেপে রাখতে পারলেন না নিজের উত্তেজনা। “এই প্রথম বাংলা চ্যানেলে বিশ্বকাপের সরাসরি সম্প্রচার। সঙ্গে বাংলায় ধারাভাষ্য। একেবারেই দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। কী যে ঘটতে চলেছে, বলে বোঝাতে পারব না।”

তাঁর মতে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বাংলায় ফুটবলের কদর অনেক বেশি। গ্রাম-গঞ্জের মানুষও রাত জেগে বিশ্বকাপ দেখেন। কিন্তু ইংরেজি উচ্চারণের ধারাভাষ্যে তাঁদের অসুবিধা হয়। “এ বার আর হবে না। মাতৃভাষায় তাঁরা খেলার বিবরণ শুনতে পাবেন। দারুণ ব্যাপার হবে।”

বহু বছর টিভি-তে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন পল্লব বসু মল্লিক। এটি তাঁর কাছে নতুন কোনও কাজ নয়। “কিন্তু বাঙালির বসার ঘরে বিশ্বকাপের ধারাভাষ্য মাতৃভাষায় পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে আমার এই পেশায় সবচেয়ে বড় সম্মান দিল সোনি আট।”

কলকাতা বা ভারতের মাঠে বসে বহু বার ধারাভাষ্য দিয়েছেন এই দুই ধারাভাষ্যকার। কিন্তু এ বারে তো আলাদা ব্যাপার। তার জন্য বিশেষ কোনও প্রস্তুতি?

ব্রাজিলে গিয়ে নয়, মুম্বইয়ে সোনির স্টুডিয়োয় একশো ইঞ্চি জায়ান্ট স্ক্রিনে ফুটবল দেখতে দেখতে ধারাবিবরণ দিতে হবে ভাষ্যকারদের। ‘‘মাঠে বসেও ধারাভাষ্য দিতে হয় সেই টিভি দেখেই”, জানালেন কল্যাণ। মাঠে হাজির না-থাকলে ধারাবিবরণী দিতে কি সমস্যা হবে না? তুষার শাহ জানালেন, ‘সাউন্ড-প্রুফ’ কাচের ঘরে বসে ‘ওয়ার্ল্ড ফিড’ দেখে বাংলায় ধারাবিবরণী দিতে কোনও অসুবিধা হবে না বাঙালি ভাষ্যকারদের। “মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকলে ফুটবলারদের মাইনর মুভ দেখতে অনেক সময় অসুবিধা হয়। টিভি-র পর্দায় যা হয় না।”

প্রতিদিন রাত সাড়ে ৯টায় প্রথম ম্যাচের আগেই চ্যানেলে শুরু হয়ে যাবে ‘স্টুডিও শো’। প্রথমার্ধের পরে ‘ব্রেক শো’ এবং ম্যাচ শেষে পর্যালোচনা। সকালে হবে ‘ব্রেকফাস্ট শো’। বাঙালি দর্শক যাতে বিশ্বকাপ ফুটবল চেটেপুটে খেতে পারেন, তার জন্য অনুষ্ঠানে কোনও ত্রুটি রাখবে না চ্যানেল, দাবি তুষারের।

ম্যাচ চলাকালীন ভাষ্যকারদের হাতের কাছে থাকবে দুই দলের ফুটবলারদের প্রোফাইল। টিভি-র পর্দায় যে-ফুটবলারের মুখ দেখা যাবে, ভাষ্যকারদের ফোকাস থাকবে তার উপরে। ধারাবিবরণীর পাশাপাশি নানা প্রয়োজনীয় তথ্যও চটজলদি জানিয়ে দেওয়া হবে দর্শকদের। “বাংলার দর্শকদের কাছে বিশ্বকাপ ফুটবলে এ বারের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটাই,” কল্যাণ চৌবে নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।

পল্লবের মতে, রেডিয়োতে অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্য বা পুষ্পেন সরকারেরা যে-ধরনের ধারাবিবরণী দিতেন, তার কোনও স্কুলিং ছিল না। “আজকের যুগে এ সব অচল। এখন শোনার যুগ নয়। দেখার যুগ। কথা কম। আজেবাজে কথা বললে হয়তো বিরক্ত হয়ে দর্শকেরা জিওফ বয়কটের ঢঙে মন্তব্য করে বসবেন, ‘ইউ সে রুবিশ’। ক্রিকেট ধারাভাষ্যে তাঁর মতে বেঞ্চমার্ক যেমন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা সানি গাওস্কর। টেকনিক্যাল দিক নিয়ে কথা বলায় তাঁরা দুরস্ত। স্টুডিয়োয় বসে ধারবাবিরণী দেওয়ার সময় সমানে কথা বলা এখন আর স্টাইল নয়।

উদাহরণ দিলেন পল্লব। “মনে করুন ফ্রি কিকের জন্য কোনও ফুটবলার বল বসাচ্ছেন। ভাষ্যকারের কাজ হবে ফ্রি-কিকটা কতটা সুইং করবে বা কত দূর থেকে মারা হচ্ছে তা জানিয়ে দেওয়া। হয়তো সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে ক্লাব ফুটবলে ফ্রি-কিকে সেই ফুটবলারের সাফল্যের খতিয়ান।”

অর্থাৎ দর্শকদের না-জানা দিকটা তুলে ধরাও হতে হবে ভাষ্যকারের কাজের অন্যতম শর্ত। তুলে ধরতে হবে সূক্ষ্ম টেকনিক্যাল দিক। যেমন সেস ফাব্রেগাসকে দেল বস্কি যে-ভাবে ২০১০-এর ইউরো কাপে স্পেনের হয়ে ব্যবহার করেছিলেন, সেই মুভমেন্টকে এক জন ভাষ্যকার ‘ফলস নাইন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই টেকনিক্যাল দিকটি দর্শকদের কাছে অজানা ছিল।

ঘরোয়া ফুটবলে যদিও অনেক অভিজ্ঞতা চার ভাষ্যকারের, কিন্তু বিশ্বকাপ কি আপনাদের কাছে অগ্নিপরীক্ষা নয়? “একটা কথা বলতে পারি। বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দেওয়া আমার কাছে হবে ‘হাইট অব অ্যাচিভমেন্ট’’, জানালেন পল্লব।

স্টুডিয়োতে বসে থাকলেও ধারাভাষ্যে কিন্তু মাঠে হাজির থাকার ‘অ্যামবিয়েন্স’ তৈরি করার উপরে জোর দিচ্ছে চ্যানেল। কণ্ঠের ওঠাপড়ায় দর্শকদের প্রত্যাশার পারদকে চড়িয়ে দিতে হবে। ক্রিকেটে যেমন করতেন টনি গ্রেগ। এখন করেন নভজ্যোত সিধু বা রবি শাস্ত্রী। উদাহরণ দিলেন পল্লব। ধারাভাষ্যে বাঙালিয়ানা বজায় রাখার উপরেও জোর দিলেন তিনি।

বিশ্বকাপ মানেই তো রাতজাগা। পর পর তিনটে ম্যাচ। কী ভাবে রাত জাগার ক্লান্তি দূর করবেন? “মারাদোনার বিশ্বকাপ জয় থেকে রাত জাগছি। এ আর নতুন কি? অষ্টমী বা নবমীর সারারাত জাগার পরে ক্লান্তির যে-সুখানুভূতি আমরা পাই, বিশ্বকাপে রাতজাগাও তেমনই”, কল্যাণ বেশ দার্শনিক।

পল্লবের আবার অন্য মত। “বিশ্বকাপের উন্মাদনা দিয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে দর্শকদের। বিশ্বকাপকে বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। রোজ রোজ তো আর এই শো হবে না।” নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস দূরভাষেও গোপন করতে পারলেন না বহু ম্যাচের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ডা. পল্লব বসু মল্লিক।

তা হলে বিশ্বকাপের মহাআসরে এ বার বাংলাও নিজেকে শামিল করে নিল? আর হবে না-ই বা কেন? ফুটবল যে বাঙালির ‘সব খেলার সেরা’!

অন্য বিষয়গুলি:

krishanu bhattacharya world cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE