আমার বন্ধুবান্ধব বা আমার ফেসবুক আর ট্যুইটারের বন্ধুরা প্রায় সবাই জানেন, আমি আমার প্রত্যেকটা ফিল্মকে আমার ‘সন্তান’ বলে থাকি।
মাই ফিল্মস আর মাই চিল্ড্রেন।
এবং ‘চতুষ্কোণ’ বলে যে বাচ্চাটিকে আপনারা পরের শুক্রবার বড় পর্দায় দেখতে পাবেন তার সম্বন্ধে একটা কথা বলি।
এই বাচ্চার হুপিং কাশি, ডিপথেরিয়া, হাম, জন্ডিস সব রকম রোগ কিন্তু খুব ছোটবেলাতেই হয়েছে। আনন্দplus-এর খুব প্রিয় শব্দ ‘ভেন্টিলেটর’য়েও বেশ কয়েক বার চলে গিয়েছিল আমার এই বাচ্চাটি।
কিন্তু এতগুলো রোগ, এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফাইনালি আমার বাচ্চা সুস্থ। এ বারে পুজোর আগেই আপনারা দেখতে পাবেন তাকে। কিন্তু এত যে রোগের কথা বললাম, তা হল কী করে?
দাঁড়ান, পুরোটাই বলছি তা হলে...
বাধাবিপত্তি যেন শেষ হওয়ার নয়
সাল ২০১০। ‘অটোগ্রাফ’য়ের পরে পরেই ঠিক করেছিলাম ‘চতুষ্কোণ’ করব। মেন কাস্ট ঋতুদা, রিনাদি, গৌতম ঘোষ আর অঞ্জনদা। মিটিং হল, শ্যুটিং গরমকালে হবে না শীতকালে সে নিয়ে কথা হল। কিন্তু ব্যস, ওইটুকুই। ছবিটা শুরু হল না।
তার পর ২০১২-তে যখন ‘মিশর রহস্য’র শ্যুটিং হঠাৎ করে পিছিয়ে গেল তখন আবার ‘চতুষ্কোণ’ রিভাইভ করলাম। কিন্তু যে কে সেই, ছবিটা শুরু করতে পারলাম না।
তার পর এল ২০১৩-র অভিশপ্ত ৩০ মে। তার ঠিক সাত দিন আগে আমার ঋতুদার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ঋতুদাকে বলেছিলাম, “‘ঊনিশে এপ্রিল’য়ের সময় তোমার যে লুকটা ছিল সেই লুকটা চাই।” ঋতুদা বলেছিল মুম্বই থেকে উইগ আনাবে। এই নিয়েই শেষ বার ফোনে কথা হল ঋতুদার সঙ্গে।
কিন্তু মে মাসের সেই মেঘলা সকালে ঋতুদা চলে গেল। যে ভাবে ভেবেছিলাম ছবিটা ঋতুদাকে নিয়ে, বুঝতে পারলাম সেটা আর কোনও দিন সম্ভব হবে না। সত্যি, বাধাবিপত্তি যেন শেষ হওয়ার নয়।
অঞ্জনদার বদলে এল চিরঞ্জিত, কৌশিকদার বদলে পরম
ঋতুদার বদলে কৌশিকদাকে মাথায় রেখে ছবিটা আবার রি-রাইট করলাম। তারপর ‘জাতিস্মর’ শেষের মুখে ঠিক হল এ বার ‘চতুষ্কোণ’ হবে।
কিন্তু বাধ সাধল আমার শরীর। আমার বাঁ দিকের লাংসে ব্লাড ভেসেলস্ ছিঁড়ে যাওয়াতে দিনের পর দিন কাঁচা রক্ত বমি করছিলাম। ছবির শুটিং আবার পিছিয়ে গেল। এর মধ্যে প্রযোজক রানা সরকারের সঙ্গে ঝামেলা হল অঞ্জন দত্তর। অঞ্জনদা বেরিয়ে গেলেন প্রোজেক্ট থেকে।
তখন মাথায় এল চিরঞ্জিতের কথা। অ্যাপ্রোচ করলাম। উনি ছবিটা করতে রাজি হলেন। চিরঞ্জিতের জন্য রোলটা আবার করে লিখলাম।
এর মধ্যে আবার কথা হল কৌশিকদার সঙ্গে। কিন্তু ডেট সব গুলিয়ে গিয়েছে তত দিনে। কৌশিকদাও ওর পরের ছবি ‘খাদ’য়ের শ্যুটিং প্ল্যান করে ফেলেছে।
তাই কৌশিকদা ‘চতুষ্কোণ’য়ে অন্য একটা রোল করলেও যে রোলটা ঋতুদার মৃত্যুর পর লিখেছিলাম সেটা করতে পারল না।
লিখতে বসলাম আবার। এ বার চরিত্রটা পরমকে মাথায় রেখে লিখলাম। পরম যে এই রোলটা করতে পারে সেটা আমায় প্রথম সাজেস্ট করেছিল কিন্তু বুম্বাদা।
এর মধ্যে আমার ক্যামেরাম্যান কাম সেনাপতি সৌমিক হালদারও বলল ও ছবিটা করতে পারবে না। সেই সময় খারাপ লেগেছিল। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম ও কেন করতে পারেনি ছবিটা।
এর মধ্যে ‘ধুম থ্রি’র ক্যামেরাম্যান সুদীপ চট্টোপাধ্যায়কে অ্যাপ্রোচ করলাম। উনি করতে রাজি হলেন।
যে ছবিটা ভেবেছিলাম আর শুরু হবে না, সেটা অবশেষে শুরু হল। শ্যুটিং শুরু হল ‘চতুষ্কোণ’য়ের।
এক এক সময় ভাবতাম ছবিটা কি ‘অভিশপ্ত’!
আজ ফিরে তাকালে মনে হয় যেন রূপকথা। আসলে এই ছবিটা এত বাধা ফেস করেছে যে এক সময় সত্যি ভেবেছিলাম এই ছবিটা কি ‘অভিশপ্ত’... কার্সড। জিঙ্কসড্!
অনেকে আমাকে বলেছিল চিরতরে ছবিটা শেলভড্ করে দিতে। কিন্তু আমার মন বলত অন্য কথা। মনে হত এত বাধাবিপত্তি যখন আসছে, তখন দেয়ার মাস্ট বি আ লাইট অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য টানেল।
সেই দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে শুধু এগিয়ে গিয়েছি।
আজ বুঝতে পারি আত্মবিশ্বাস যদি থাকে, তা হলে শেষ পর্যন্ত তুমি যেটা চাইছ, সেটা পাবেই।
তবে দু’জন মানুষের নাম না করলে অন্যায় হবে। অপর্ণা সেন আর গৌতম ঘোষ।
‘তুই যেটা ভাল বুঝবি’
এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু আমার পাশে রক অব জিব্রাল্টারের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। যখনই কোনও কারণে ছবিটা পিছিয়ে গিয়েছে, গৌতমদা আমাকে নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেছেন, “চিন্তা কোরো না, ছবি হবে। আমি তোমার ডেট সরিয়ে রেখেছি।”
রিনাদিও তাই। যখনই দেখা হয়েছে, ‘চতুষ্কোণ’ নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। একবারের জন্যও এই দেরির কারণে অধৈর্য হননি।
আর গৌতম ঘোষ-রিনাদিকে এক ছবিতে পরিচালনা করা আমার কাছে অসম্ভব স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। একজন ‘পার’ বানিয়েছেন, অন্য জন ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’। এ রকম দু’জন মানুষকে ডিরেক্ট করা সত্যি সম্মানের ব্যাপার।
অনেক সময় অবশ্য ওঁরা আমাকে আর ক্যামেরাম্যান সুদীপদাকে জিজ্ঞেসও করতেন, লাইটটা এ রকম কেন করেছি? আমি আর সুদীপদা তখন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতাম। কিন্তু কোনও দিন কোনও কিছুতেই আপত্তি করেননি তাঁরা।
রিনাদি তো প্রায়ই বলতেন, “তোর ছবি, তুই যেটা ভাল বুঝবি।”
রিনাদির এই ‘তুই যেটা ভাল বুঝবি’ কিন্তু অনেকটা মায়েরা যে রকম করে বলেন, সে রকম। পড়াশোনা না করলে যেমন সবাই শুনেছি, ‘তুই যেটা ভাল বুঝবি’ অথবা নতুন প্রেমের খবর পেয়ে মায়েরা যেমন বলেন, ‘তুই যেটা ভাল বুঝবি’। রিনাদিরটাও তাই।
এই নিয়ে সেটে খুব মজাও করতাম আমরা।
এটা বোধহয় সব মা-বাবারই হয়
আর একজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমার মতে উনি এই ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ।
চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। হি হ্যাজ কিলড ইট।
এই ছবির গল্পে বাকি তিন জন, মানে রিনাদি, গৌতম ঘোষ আর পরম সেদিক থেকে দেখতে গেলে একটি বিশেষ ধারার ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দিকে দীপকদা একেবারে হার্ডকোর বাণিজ্যিক বাংলা ছবির প্রতিনিধি। তাই ওঁর উপস্থিতি ছবিতে একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছে। আমি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি বাঙালি এই চিরঞ্জিত চক্রবর্তীকে আগে কখনও দেখেনি।
আজ ছবি প্রায় মুক্তির পথে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টারও পড়ে গিয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে যখন পোস্টারগুলো দেখছি, তখন মনে পড়ছে কত রকম ঝামেলা পেরিয়ে এলাম সেই কথাগুলো।
মনে হচ্ছে বিভিন্ন সিনেমা নিয়ে আমাদের বেশ কিছু আবেগ থাকে। এক একটা সিনেমা আমরা জীবনের এক একটা সময়ের সঙ্গে রিলেট করতে পারি।
কিন্তু সিনেমার সঙ্গে জড়িত অনুভূতির কথা যদি বলেন, তা হলে আমার কাছে সব থেকে আগে থাকবে ‘চতুষ্কোণ’।
এটা বোধহয় সব মা-বাবারই হয়। যে বাচ্চাটা ছোটবেলা থেকে নানা রোগে ভুগছে, তার প্রতি মা-বাবার এই দুর্বলতা বোধহয় থেকেই যায়।
রোগমুক্ত সেই বাচ্চার এ বার প্রথম পুজো।
জানাবেন কেমন লাগল আপনাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy