‘‘তুমি আমাকে আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। সাথে সাথে আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতেও পারতাম না।’’
আবার কোথাও লিখেছেন, ‘‘দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই সব থেকে আনন্দের।’’
এমন সব অমোঘ ভালবাসার চিঠি যিনি লিখেছেন, তিনিই আবার লিখেছেন—
‘‘আমি বেদুইন আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’’
কিংবা
‘‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু
ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’’
অবাক হচ্ছেন? হবারই কথা। নজরুল মানে বিদ্রোহ আর বিপ্লব। এই পরিচয়েই তিনি উজ্জ্বল হয়েছেন। তাঁর মধ্যে যে প্রেমিক সত্তা ছিল তা চাপা পড়ে গিয়েছে বিদ্রোহের অগ্নিবর্ষী অভিব্যক্তিতে।
প্রেমিক কাজী নজরুল ইসলামকেই খুঁজে বের করতে চলেছেন এ বার তাঁর নাতনি অনিন্দিতা কাজী। নজরুল-পুত্র অনিরুদ্ধ কাজী ও কল্যাণী কাজীর কন্যা অনিন্দিতা প্রেমিক নজরুলকে তাঁর অনুরাগীদের সামনে মেলে ধরতে বেছে নিয়েছেন ঠাকুরদার লেখা প্রেমপত্র। প্রেমিকা নার্গিসকে লেখা এই চিঠির বয়ানে, প্রতি ছত্রে ছত্রে উথলে উঠছে ভালবাসার আবেগ। আর সেই চিঠি পাঠের মধ্যে মধ্যে থাকছে জনপ্রিয় সব নজরুলগীতি।
৩ এপ্রিল প্রকাশিত হতে চলেছে পত্রপাঠ ও সঙ্গীতের এই অ্যালবাম যার নাম ‘লভ অ্যান্ড ডেজায়ার কাজী নজরুল ইসলাম’।
কিন্তু হঠাৎ কেন নজরুলের প্রেমের চিঠি পাঠের কথা ভাবলেন অনিন্দিতা? তিনি বলছেন, ‘‘আজকাল শুনি নজরুলগীতি কেউ শোনে না। নজরুলের কবিতা নাকি অচল। এই ধারণা মুছে দেওয়ার জন্যই প্রকাশ করতে চলেছি অ্যালবামটা। যাতে হোয়াটস্যাপ প্রজন্ম নতুন করে চিনতে পারে নজরুলকে।’’
এখন প্রশ্ন হল কে এই নার্গিস?
নজরুল যখন প্রায় কিশোর, তাঁর সংসারবিমুখ মন যখন একটা মুক্তির পথ খুঁজছিল, সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কুমিল্লার মেয়ে সৈয়দা খাতুনের। ভালবেসে কবি তাঁর নাম রেখেছিলেন নার্গিস।
ভাবাবেগের বন্যায় নজরুল এমন ভাবে ভেসে গিয়েছিলেন যে বুঝতেই পারেননি নার্গিস সত্যি তাঁকে ভালবেসেছিলেন, নাকি অবস্থার চাপে পড়ে ভালবাসার অভিনয় করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নার্গিস আর নজরুলের বিয়ে হয়নি। দু’জনের সম্পর্কের মালিন্য এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিয়ের আসর থেকে ফিরে আসেন নজরুল।
সেই ঘটনার প্রায় ষোলো বছর বাদে নার্গিসের এক চিঠির উত্তরে নজরুল যে চিঠি লেখেন তাতে তাঁর কবি ও শিল্পী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। নার্গিসের সঙ্গে তাঁর প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে জন্মেছে বহু গান ও কবিতা।
কল্যাণী কাজীর কন্যা অনিন্দিতা বললেন, ‘‘আমার ঠাকুর্দা প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন নজরুল। প্রত্যেকেই তাঁরা নিজেদের ক্ষেত্রে প্রতিভাময়ী ছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন প্রিয়দর্শিনী। কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সেতু ছিল সঙ্গীত, কারও প্রতি আকৃষ্ট হন অন্য প্রতিভার আকর্ষণে।’’
অনিন্দিতা কাজী মূলত গায়িকা ও সঞ্চালক হলেও এই অ্যালবামে যে চিঠি পাঠ করেছেন তার কারণ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রেমিক নজরুলকে। বললেন, ‘‘দাদু-নাতনির সম্পর্কের মধ্যে একটা খুনসুটি ভাব তো থাকেই। সেই মন নিয়েই ঠাকুরদার প্রেমকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। কনিষ্ঠা নাতনি হিসেবে ঠাকুরদার রোম্যান্সের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছি বলেই এমন একটা অ্যালবাম তৈরির কথা ভাবলাম। নজরুলের পরিবারের উদ্যোগে এমন সিডি এই প্রথম। ঠাকুরদার প্রেমের চিঠি পড়তে গিয়ে আমার মন কোনও সংকীর্ণতার খাঁচায় বদ্ধ হতে পারেনি সেই জন্যেই। এই প্রথম নজরুলের চিঠি নিয়ে কাজ হচ্ছে। এর আগে কখনও এমনটা হয়নি।’’
চিঠির ফাঁকে ফাঁকে থাকছে পাঁচখানি গান। এর মধ্যে রয়েছে ‘শাওন রাতে যদি’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি’ , ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় অঁখি জল’, ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই’। গানগুলি গেয়েছেন সঙ্গীত পরিচালক সৌম্য বসু। ‘‘নজরুলের গানকে কালোয়াতির বাইরে নিয়ে গিয়ে সহজ করে গাওয়ার চেষ্টা করেছি। সঙ্গীত পরিকল্পনার মধ্য নজরুলগীতির সহজ রূপটাই ধরার চেষ্টা করেছি,’’ বলছেন সৌম্য।
অনিন্দিতার ইচ্ছে আছে সারেগামা থেকে প্রকাশিত এই অ্যালবামটি বাংলাদেশে ও ভারতের বড় বড় শহরের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। ‘‘নজরুলের প্রকাশিত, অপ্রকাশিত বিভিন্ন প্রেমের চিঠি নিয়ে পরবর্তী কালে আরও কাজ করার ইচ্ছে রইল আমার। এবং নজরুলের গান যেহেতু আজকাল কম গাওয়া হয় তাঁর গানকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নতুন করে আমি আবার তাঁর গানগুলো গাওয়া শুরু করেছি,’’ বলছেন অনিন্দিতা।
নার্গিস বনে নজরুলের খোঁজে এই যাত্রা যদি সফল হয় তা হলে আশা করা যায় আগামী দিনে অনিন্দিতা এই ধরনের আরও কিছু অ্যালবাম শ্রোতাদের উপহার দেবেন।
আনাচে কানাচে
ত্রয়ী: নন্দন-এ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর ছবির রেট্রোস্পেকটিভ অনুষ্ঠান।
তাঁর সঙ্গে তরুণ মজুমদার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: কৌশিক সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy