জোটসঙ্গী: হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল হক।
এক বন্ধু সে দিন প্রশ্ন করছিলেন, আচ্ছা বাম দলগুলিকেই কেবল নৈতিক রাজনীতি করতে হবে, অন্য কারও সেই দায় বা দায়িত্ব নেই, এমনটা কেন? বার বার বাম নেতাদের বিষয়েই মানুষের ‘হতাশা’ আর ‘আঘাত’ তৈরি হয় কেন? অন্যরা একই কাজ করলেও তা নিয়ে তো এত কথা হয় না? আব্বাস সিদ্দিকিকে দলে নেওয়াই হোক, আর ‘টুম্পা সোনা’র ব্রিগেড-আহ্বানই হোক— আর কেউ এ সব করলে এত হইচই তোলপাড় হত কি?
কঠিন প্রশ্ন। ভাবতে গিয়ে হয়রান হয়ে মনে হল, আসলে এঁরাই বলেন যে এঁরা আলাদা, তাই আমরা বাকিরা বার বার তা বিশ্বাস করে ফেলি। সকলেই এক রকম হয় না, কেউ কেউ একটু আলাদা হলেও হতে পারে, এটা বিশ্বাস করার জন্য আসলে আমরা মুখিয়ে থাকি। রবিবারের ব্রিগেডই প্রমাণ, এই বাজারেও কত লোক বিশ্বাসের খোঁজে হাঁটা দিয়েছিলেন ও দিকে। রবিবারের ব্রিগেডই প্রমাণ, কত বড় প্রতিশ্রুতি, সম্ভাবনা, বিশ্ববীক্ষা নিয়ে আজও কত ছোট, কত সঙ্কীর্ণ রাজনীতি করে যেতে পারে বাম রাজনৈতিক মহল।
সে দিনের মানুষের ঢলে বার বার চোখে পড়ছিল অসংখ্য তরুণ মুখ। খবর আসছিল, অল্পবয়সিরা নাকি দলে দলে হাঁটা দিয়েছে ব্রিগেডের দিকে। কেন যাচ্ছিল তারা? কেন টিভি খুলে বসছিল দুপুরে, অন্য কাজ ছেড়ে? চার দিকে তো কতই মিটিং মিছিল হয়, তা হলে? সম্ভবত, ক্লান্ত ধ্বস্ত তাদের মন খুঁজছিল একটা বিকল্প রাজনীতি আর আদর্শের প্ল্যাটফর্ম। সে দিন মঞ্চের উপরে যে নেতারা বসেছিলেন, যাঁরা বক্তৃতা দিলেন, তাঁরা কি এই প্রত্যাশার কথাটা মনে রেখেছিলেন? কেমন লাগছিল তাঁদের, উদ্দীপ্ত তরুণ মুখগুলোর সামনে আব্বাস সিদ্দিকি চরিত্রটিকে তুলে ধরতে? কেমন লাগছিল, নিজেদের সেই বহু বার শোনা, বার বার বাতিল হয়ে যাওয়া বক্তৃতাগুলো দিতে? আজকের তরুণতরুণীরা চেনা বাম নেতাদের পুত্রকন্যার মতোও নয়, প্রায় নাতিনাতনিদের মতো। বুঝতে কি পারছিলেন তাঁরা, ‘পথে এ বার নামো সাথি’ ডাকের উপযুক্ত আদর্শের সন্ধান দেওয়া দূরস্থান, আদর্শবিযুক্ত রাজনীতিরও প্রায় একটা বিকৃত রূপ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা এই নবীন প্রজন্মকে? বোঝাচ্ছিলেন, নৈতিকতা নয়, কৌশলই হল সবচেয়ে দামি কথা। ক্ষমতাদখলের কৌশল। অন্য দলকে আটকানো, আসন সংখ্যা ম্যানেজ করা, ইত্যাদি ছাড়া রাজনীতির আর আছেটা কী?
ধরে নেওয়া গেল, বাম দিকে তাকিয়ে আলাদা কিছু খোঁজার বিষয়টা কেবল প্রত্যাশার কু-অভ্যাস। নৈতিকতার ভার তার উপর না চাপিয়ে কৌশলটাকেই বুঝতে হবে। সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। কৌশলেও তো কিছু নীতি থাকতে পারে? আজকের পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে ঠিক কী কৌশলী নীতি বা নৈতিক কৌশল দেখাচ্ছেন বাম নেতারা?
নৈতিকতার দিক দিয়ে আব্বাস সিদ্দিকির মতো নেতার সঙ্গে হাত মেলানোর কোনও কারণ যে নেই, সেই কথা ইতিমধ্যে অনেক আলোচিত। যতই দলের নামে ‘সেকুলার’ রাখুন না কেন সিদ্দিকি, কট্টরপন্থী ধর্মীয় তারেই তিনি বেঁধে এসেছেন তাঁর রাজনীতি। এই পিরজাদা সম্পর্কে বঙ্গীয় মুসলিম সমাজেরও অনেকেরই ভাল ধারণা নয়। যে ভাষায়, স্বরে ও সুরে তিনি কথা বলেন, এমনকি সে দিনও ব্রিগেডের মঞ্চে বললেন, তাতে অসহিষ্ণুতাটাই কানে ধরা পড়ে। সংখ্যাগুরুর অসহিষ্ণুতাকে আটকানোর জন্য সংখ্যালঘুর অসহিষ্ণুতাকে দলে টানাই কি তা হলে বাম ‘কৌশল’?
কৌশলের প্রধান লক্ষ্য নিশ্চয়ই, আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোটের ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের একটা ক্ষতি ঘটানো। মুসলিম নেতারা ভোটে দাঁড়ালে কিছু ভোট তৃণমূলের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা। তবে সিদ্দিকি জোটে না ঢুকেও তৃণমূলের সেই ক্ষতি করতেই পারতেন, কেবল তাতে সিপিএম-এর ঘরে সেটা আসত না। আর জোটের এই বোঝাপড়া থেকে যেটুকু লাভ, সাধারণ বুদ্ধি বলছে, সেটা যাওয়ার সম্ভাবনা বিজেপির ঘরে, যেমন আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বিষয়েও ধরে নেওয়া হয়। লাভ-ক্ষতির এই অঙ্ক বাম নেতারা কষেছেন নিশ্চয়ই, তবু দমেননি।
আরও একটা লক্ষ্য থাকতে পারে এই কৌশলের: আব্বাস সিদ্দিকিকে নীলকণ্ঠের মতো ধারণ করা। অর্থাৎ যদি সিদ্দিকি-ওয়েইসি জোট হয়ে একটা কট্টর মুসলিম মেরু তৈরি হত এই বাংলায়, তা হলে নিশ্চয় আরও ভয়ানক হত সেটা। বাম-কংগ্রেস জোটে সিদ্দিকি আসার ফলে সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট করা গেল। কী হলে কী হত বলা মুশকিল, তবে ভাবতে যদি হয়ই, এমনও কি ভাবা যায় না যে, সে ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং ইসলামবাদী রাজনীতি দুটোকেই সরাসরি আক্রমণ করা যেতে পারত? সেও তো হত আর এক ধরনের কৌশলী রাজনীতি। বাম আদর্শের পক্ষে এটাই কি স্বাভাবিক হত না? ওই যে বলছিলাম, এখনও আমাদের নাচার মন বিশ্বাস করতে চায় যে, একটা অন্য যুদ্ধের ইশারা হয়তো বাঁ দিক থেকেই আসতে পারে। না, তেমন কিছু হল না। আজকের নেতারা বাম কৌশলে নৈতিকতা আর আদর্শের অমন স্থান আর রাখতে চান না।
অথচ এটা তো ঠিক যে, ভোটের আসনে বা পরিমাণে বিজেপিকে আটকানোর মতোই আদর্শে-উদ্দেশ্যে বিজেপিকে আটকানোটাও কম গুরুতর কাজ নয়! বিজেপি মানে তো কেবল মোদী-শাহের ভোটের অঙ্ক নয়, বিজেপি মানে একটা রাজনৈতিক ধারা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সত্তার ভিত্তিতে দেশের জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করার রাজনীতি। বিজেপি-আরএসএস’এর দক্ষিণপন্থী ধর্মসত্তাবাদী রাজনীতি ভাল করেই জানে, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দোসর— বিপরীত ধর্মের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তাই, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়া মানেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বাড়া, দুই পক্ষ দুই পক্ষকে সেই জন্যই তোয়াজ করে চলে, এমনকি হাতও মেলায়।
মনে পড়ে, এই বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেমন ভাবে হাত মিলিয়েছিলেন মুসলিম লীগের সঙ্গে। বিজেপি-আরএসএস’এর নয়নের মণি, বাংলার ‘বিস্মৃত নায়ক’, এ বারের ভোটে বিজেপির তুরুপের তাস শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু প্রথম বার রাষ্ট্রিক ক্ষমতায় এসেছিলেন মুসলিম লীগের হাত ধরেই। ১৯৪১ থেকে ’৪৩— অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে এই দুই বিরুদ্ধ মেরুর মন্ত্রিসভায় ফজলুল হক হন প্রধানমন্ত্রী— জিন্নার কলকাঠিতে কৃষক প্রজা পার্টি ভেঙে যিনি তখন বাধ্য হয়ে যোগ দিয়েছেন লীগে। আর ফজলুল হকের ডেপুটি ও অর্থমন্ত্রী হন শ্যামাপ্রসাদ। এই সময়েই বাংলায় মুসলিম লীগের সমর্থন বাড়ে অনেকখানি, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তা আটকাতে পারেননি, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মহাসভার প্রভাবও। ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রিসভা বলে পরিচিত সেই আমলে পাকিস্তান প্রচারও যেমন নিয়মিত হয়ে উঠেছিল, মহাসভার ‘পাকিস্তান-বিরোধী দিবস’ পালনও ছিল নিয়মিত। শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর দলনেতারা সরকারি ভাবে পাকিস্তানপন্থী নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে করতেই তাঁদের মুণ্ডপাত করতেন জনসভায়।
শ্যামাপ্রসাদের কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা এখনও হয়নি। যদি মনে করি, প্রবল হিন্দুত্ববাদী নেতা কেবল ক্ষমতার লোভে এই কাজ করেননি, যদি মনে করি তিনি ভেবেছিলেন, হাত মিলিয়ে কাজ করলে অপর পক্ষের সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে বাঁধ দেওয়া যাবে, তবে এইটুকুই বলা যায় যে, তিনি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হন। বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আগেও ছিল, পরেও আছে— কিন্তু ওই চল্লিশ দশকের মাঝের বছরগুলিতে সরকারি ক্ষমতার ইন্ধনে যে ভাবে বাংলার সমাজ দ্রুত দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল, তা বাঙালির ইতিহাসকে চিরতরে পাল্টে দেয়। এর পিছনে শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর দলের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট। বাস্তবিক, মহাসভার সঙ্গে লীগের সন্ধি এমন ভাবেই বাংলার পরিবেশ বিষাক্ত করে দিয়েছিল যে, মুসলিম লীগের কট্টর ভাগটি জিতে গিয়ে বাঙালি আইডেন্টিটির মধ্যপন্থী নেতা ফজলুল হককে সরিয়ে দিল। আর কোনও দিনই তিনি তাঁর বাঞ্ছিত ‘বাঙালি নেতৃত্ব’-এর জায়গাটা ফিরে পেলেন না। সেই সময়ের সাংবাদিক-লেখক মহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর স্মৃতিকথা যুগবিচিত্রা’য় লেখেন, ফজলুল হকের এই ‘দুর্ভাগ্য’ এবং মুসলিম লীগের ‘সৌভাগ্য’র প্রধান কারিগর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন মুক্তমনা, ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে বাঙালি ঐক্যের সমর্থক। তাঁর এই মন্তব্যকে সাম্প্রদায়িকতা-প্রসূত বলা অসম্ভব। সাম্প্রতিক কালে জয়া চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাতেও এই কথারই সমর্থন মেলে।
পুরনো কথা মনে আসে, আজকের এই ঘটনাবলি দেখে। খুব কঠিন সময় এখন। অসহিষ্ণু রাজনীতির হিংস্র কুমিররা পশ্চিমবঙ্গে লম্ফঝম্প করছে, তাদের জন্য নতুন করে খাল না কাটলেই বাঙালির মঙ্গল হত। শত্রুর মধ্যেও কে বড় শত্রু, এটা বাম নেতারা ভাববেন না বলে ঘোষণা করেছেন। তবে কোনও কোনও স্বাভাবিক শত্রুকেও যখন তাঁরা কাছের বন্ধু করে নিচ্ছেন, তখন আমাদের মনে হতেই পারে, ঘোষণাটা পুরো সত্যি নয়— শত্রুর মধ্যে একটা ভাগাভাগি তাঁরা করছেন ঠিকই। ভাগাভাগির হিসেব এবং লক্ষ্যটা কেবল অন্য রকম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy