আসন্ন নির্বাচন এই ‘না’ ও ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যেই হতে চলেছে। গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ।
আবার এল একটা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বস্তুত দু’টি ভিন্ন প্রবণতার গজকচ্ছপ যুদ্ধের মতো। একদিকে ‘না’, আর স্বভাবতই অন্য দিকে ‘হ্যাঁ’ এসে দাঁড়ানোই আমাদের গণতন্ত্রের উৎসব। বিপক্ষকে দাঁড়াতে দেব না, দাঁড়ালে ভোট দিতে দেবনা, ভোট দিলে জিততে দেব না। এই রকম বহু ‘না’-এর সমাবেশ হয়ে আসছে বহু দিন থেকে।
বামপন্থীদের আওয়াজ ছিল ‘চলছে না, চলবে না’, ‘মানছি না’ বড়জোর ‘পাচ্ছি না’,’দিচ্ছে না’। ‘The Agony of West Bengal’-এ লেখা হয়েছিল এই রকম কিছু কথা। সে সব কথা সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ছিল না। ‘মাশুল সমীকরণ নীতি’ সম্পর্কে যা বলা হত তার তথ্যপ্রমাণ ছিল। মূল কথাটি ছিল দেশের শাসকরা রাজ্যের কাঁচামাল নিয়ে যাচ্ছে, রাজ্যে আসছে অন্য রাজ্যে উৎপন্ন সামগ্রী আর অন্যান্য কাঁচামাল— শুল্কের হার এক থাকছে না। অর্থাৎ দেশের একাংশ অন্য অংশের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে।
এই ভাষ্যে, বাচ্যে ধ্বনিতে গর্জনে একটা কথা চাপা পড়ে যাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ তো একটি শিল্পে অগ্রসর রাজ্যই ছিল, কোন সার্বিক ‘না’-এর অধীন হয়ে তার এমন হতশ্রী অবস্থা হল? বিচিত্র এক রাজনৈতিক আদর্শ শিল্প কারখানাগুলিতে শ্রমিক আন্দোলনের নামে অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দিতে দিতে শাসন ক্ষমতায় এসে সেই ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ করতে পারেনি। ভাল করে ভেবে দেখলে, এই ছিল আমাদের রাজ্যের কংগ্রেস-মুক্ত বামপন্থী রাজনৈতিক উত্থানের ইতিবৃত্ত।
আড়াল-কথাও কিছু ছিল। প্রথম দিকের ‘না’ ছিল অন্যরকম। দেশভাগ হল। তখন উদ্বাস্তুদের পুর্ণবাসন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেওয়া চলবে না। মানা-পিলভিট-দণ্ডকারণ্য বা আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া চলবে না। এই ‘না’ যে কখন অন্য’না’-তে পরিণত হল, তা বুঝিনি। মরিচঝাঁপি থেকে বুঝলাম। দণ্ডকারণ্য থেকে নিজেদের জন্য নির্জন দ্বীপে থাকাও চলবে না। এই বৃত্ত বা চাকাটির আবর্তন বামপন্থী রাজনীতির মায়াবী চক্র। বিনয় মজুমদার হলে বলতেন,’ফিরে এসো চাকা’।
এত দিন কংগ্রেস ছিল ‘হ্যাঁ’- এর পক্ষে। কেন্দ্রীয় শক্তি বিন্যাস সংহত রাখত, দক্ষিণী ভাষাগত, উত্তরপূর্বের জাতিসত্তা গত পার্থক্যের চ্যালেঞ্জ হোক, বা কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানোর জন্য হোক। এছাড়া উপায় ছিল না।সেই দুর্দিন এখন গেছে।কংগ্রেস এখন ছিন্ন পাল ভগ্ন দাঁড় অবস্থা। অতএব—’ফিরে এসো চাকা’। আপত্তির ‘না’ আর আসক্তির ‘হ্যাঁ’ এখন মিশে গেছে।সাদা-কালো ভেদ করা যাচ্ছে না— সব কেমন মেঘলা ধূসর।দিল্লির দোস্তি প্রসারিত।কেরল ব্যতিক্রম। সেখানে ভয়ানক যুদ্ধ চলছে।
চক্র আরও আছে। উদ্বাস্তুরা একদা ছিলেন সম্পদ পরে হলেন বোঝা। ছিল ইউসিআরসি, হল মরিচঝাঁপি। একই ভাবে শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে দেখলাম, ছিল জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন, হল জমিদখল। শিল্প গড়ার জন্য সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। মিলে মিশে গেল অপারেশন বর্গা আর বড় চাষিদের ট্রাক্টর মিছিল। আদর্শের ফুসফুসে ঘুন ধরল।
ইতিমধ্যে নতুন একটি শক্তি ‘হ্যাঁ’-কে নতুন ভাবে আশ্রয় করেছে। শক্তিটি অপরিচিত। কী করবে আঁচ করা মুশকিল। অথচ চোখ বুজে থাকাও সম্ভব নয়।শক্তিটি ক্রমবর্ধমান। মানুষ সমর্থন করছেন। তাঁদের কথাগুলো স্পষ্ট, বিদেশের সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি বা রাজনীতির শিলমোহর কেনা কঠিন, তবে গরুর রচনা মুখস্থ করা দিগগজরা শ্মশানে গরু খুঁজে পাবেনা, তা কি হয়? পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটল, অথচ সাম্রাজ্য পাওয়া যাচ্ছে না—এসব পরিস্থিতি না থাকলে ফ্যাসিবাদ বা নাজিবাদ জন্মায় না—এই ইতিহাস ভুলিয়ে ফ্যাসিবাদের রূপ খুঁজে পাওয়া গেল। সুতরাং, নির্বাচন এসে গিয়েছে আর রাজ্যে একনায়িকাতন্ত্র কেন্দ্রে একনায়কতন্ত্র আর মঞ্চে বহু নায়ক নাট্য!
‘না’-এর শক্তি নতুন-নতুন মুখে তুবড়ির মতো ফাটছে।ব্যক্তিগত অন্যায় ক্ষমতার হুঙ্কার প্রলাপের মতো শোনা যাচ্ছে। সে-ও প্রায় এক যুগ হল। টাটাকে ‘টা-টা’ করার পর শুকনো নিষ্ফলা জমিতে সরষে বুনে স্থানীয় চাষিদের চোখে সরষে ফুল দেখিয়ে মরচে পড়া কারখানাএলাকায় নতুন কৃষি নির্ভর শিল্প! স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি একটু বেশি পড়ুক— এতে কোনও রাজস্ব লাগে না।
রাজ্য রাজনীতির ভাষা একবারে তলানিতে নেমে আসছে। পাতাল রাজ্যের ভাষা ছড়িয়ে পড়ছে ময়দানে। নির্বাচন এগিয়ে আসছে—এই ভাষা বিদূষণ কোন কূলে গিয়ে ঠেকবে কোথায় জানিনা। বলিউডি সংলাপ ‘জবান কো লগাম লগাও’ বলতেও ভয় লাগে। এ অবশ্য উচ্চস্তরের গণতন্ত্র। সকলের বোধ-বুদ্ধির অতীত।
দিল্লির শাসকরা ধর্মকে পতাকার বর্ণে, দেশকে ধ্বনিতে, অবতারকে রণধ্বনিতে প্রয়োগ করছেন। এখানে কোনও অস্পষ্টতা নেই। অস্পষ্টতা এখানেও নেই যে, সংখ্যালঘুর ধর্মকে আচার, আচরণ থেকে বোঝানো হয়ে গিয়েছে। যে গরু দুধ (অর্থাৎ ভোট) দেয় তার লাথ খাবো,হাজার বার ইফতার খাবো— এ সব তো কানে শোনা, চোখে দেখা দৃশ্য-কাব্য। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বার্তা, ইমামরা ভাতা পাবেন। কোর্ট বারণ করলেও অন্য শুলুক ভর করা হবে। সীমান্ত অঞ্চলে সব বিন্যাস বদলে যাবে, খারিজা মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়বে, খাগড়াগড়-নৈহাটি-মালদহ-পিংলা-বীরভূম-দমদমে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকবে আর তদন্ত প্রায় অমীমাংসিত থাকবে। এসবের সঙ্গে ঢাকার জঙ্গি আক্রমণের সম্পর্ক থাকলেও সেসব নিয়ে কথা বলা হবে না। সবই কারপেটের নীচে চলে যাবে। তবে নির্বাচনে এসব কথা মনে রাখবেন না মানুষ? এমন হওয়া সম্ভব নয়। হতে পারে ভয়ে বা স্বার্থে।
চাকরি হয় কী ভাবে? এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ, সার্ভিস কমিশন-এর মাধ্যমে। এই উত্তর এক যুগ ধরে তামাশায় পরিণত করে সরকারি চাকরির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে! যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁদের পরিবর্তে নতুন চাকুরে আসেননি। এসেছেন চুক্তিভিত্তিক, অস্থায়ী। তাঁদের কোনও কোনও অংশ সবুজ পুলিশ বা ওই রকম বাহারি নামের আড়ালে। এঁদের সবাই যোগ্য, সৎ,দল না করতে পারা, শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত বেকারদের পথ আগলে আছেন। কারণ, এসব চাকরি হয় চিরকুটের মাধ্যমে। ব্যতিক্রম হয়তো আছে,আর সেটাই প্রবণতাকে বুঝতে সাহায্য করে। করোনা এসে দেখিয়ে গেল বিহার সম্পর্কে যে প্রচার করতাম তা ভুল। পরিযায়ী শ্রমিকরা আসতে থাকলেন। বামপন্থী বুদ্ধিতে— সব কিছুতে রাজনীতিতে তৎপর কিছু শিল্পী বানালেন দেবী দুর্গা পরিযায়ী শ্রমিক জননী! যদি বলি, এদের অন্য রাজ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করল কোন দুর্বুদ্ধি পটু পরজীবী শ্রমিক (?) নেতা আর কৃষকপন্থী গণ-আন্দোলনের প্রতাপ?
‘না’-এর দিগ্বলয়ে করোনা নতুন সংযোজন, আমপান একটি নতুন সন্নিবেশ। করোনার সময় মৃত্যু সংখ্যা বলব না, শ্রমিক-স্পেশাল ট্রেন চাইব না, আমপানের সাহায্য যাঁদের পাওয়ার কথা, তাঁরা পাবেন না! আশ্চর্য হয়ে আমরা দেখলাম,’রাম’ নাম নাকি গালাগাল! বললে ধরা হবে তারা বহিরাগত,জেল হাজতের হুমকি দেওয়া হবে। আয়ুষ্মান প্রকল্পে না, শৌচাগার নির্মাণে কেন্দ্র সরকারের নামগন্ধ থাকা চলবে না।
এই প্রথম একটা নির্বাচন হচ্ছে যেখানে নেটমাধ্যম (social media )-এর শক্তি অনুভূত হচ্ছে। সংবাদপত্র, দূরদর্শনের অজস্র চ্যানেল এখন জনমত প্রভাবিত করার শক্তি হারাচ্ছে। নতুন সংযোগ ব্যবস্থা মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক, পরিণতবুদ্ধি মানুষের মতকে অল্প হলেও প্রভাবিত করছে—ব্যাক্তির পক্ষে মত প্রকাশের এই নতুন মঞ্চ সংবাদপত্র বা চ্যানেলের একমুখী যাত্রা পথ (One way Traffic)-এর প্রভাব দিচ্ছে কমিয়ে। এর সঙ্গে অর্থ চক্রের ভূমিকা থাকতে পারে। পারে কেন আছেই। বিজ্ঞাপন পাতার মতকে প্রচারের দায়িত্ব দিলে মানুষ তাদের উপেক্ষা করবেন। এর ফল এবারের নির্বাচনকে নতুন কোন, কোন মাত্রা দেবে বলতে পারব না; অপেক্ষা করা যাক।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দল ভাঙা, দল বদলের ইতিহাস এক সময় খুব বড় অধ্যায় লেখেনি। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এই প্রবণতাকে ‘আয়ারাম গয়ারাম’বলার চল ছিল। বিহার নির্বাচনে ভোট লুট করার ঐতিহ্য আমরা স্থানীয় প্রতিভায় তাকে নতুন ভাবে বিন্যস্ত করেছি। জলের মধ্যে মাছ যেভাবে থাকে — সেই ভাবে কর্মীদের নিযুক্তকরে, লোকাল কমিটির মাধ্যমে পাড়া নিয়ন্ত্রণ করে, বিরোধী দলের সমর্থকদের বাড়িতে গৃহকর্ত্রীকে সাদা থান পাঠিয়ে বিহারি বাহুবল জঙ্গির বুদ্ধিবলে পরিণত হয়েছে। এখনতো বাহুবল ফিরে এসছে। উপরস্তু এসেছে দল বদলের নতুন পালা। এমন ঘটনা আমাদের বিমূঢ় করেছে। দল বদলের সঙ্গে নতুন নতুন কুনাট্য দেখা যাচ্ছে— স্বামীর দল ছেড়ে অন্য দলে ফেরা, কিংবা স্ত্রীর দল ছেড়ে ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচেনা’ গাইতে থাকা চলছে! মনে হচ্ছে এই রাজনীতি বাংলার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। এক্ষেত্রে অন্তত সর্বভারতীয় হচ্ছি আমরা— প্রাদেশিক থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। এর ফল কী হবে বলা অসম্ভব।
আর একটি ক্ষেত্রে আমরা সর্বভারতীয় হচ্ছি। জিএসটি, হ্যাস্টাগ থেকে শুরু করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। আমরা কখনও ভাবিনি, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা লুপ্ত হবে,ভাবিনি অযোধ্যার সমস্যা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে একটি পরিণতি পাবে, তালাক প্রথা বিলুপ্ত হবে। এ সব ঘটনা থেকে দু’টি ব্যাখ্যা উঠে আসছে। জাতীয়তাবাদী ‘হ্যাঁ’-কে ‘অস্মিতা’ বলে ‘আত্মনির্ভরতা’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বিরোধী ‘না’-এর দল বলতে চাইছেন, এ হল অতি কেন্দ্রীয়তা আর একনায়কতার ঝোঁক। কৃষক আন্দোলন, ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর মিছিল, লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ লাঞ্ছনা— গভীর এক ‘না’-এর বাহিনী তৈরি করেছে। শাহিনবাগ আন্দোলন জাতীয় নাগরিক পঞ্জিবিরোধী ‘না’-এর যুক্তিসঙ্গত পরিণতি মনে হয়। রাজ্যের শাসক আর পুরনো শাসক দল বা গোষ্ঠী দু’টি এই ‘না’–এর অধীন। আসন্ন নির্বাচন এই ‘না’ ও ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যেই হতে চলেছে।
(লেখক গৌরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy