গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
৩৭৩০৫ আপ হাওড়া সিঙ্গুর লোকাল। প্রতিদিন সন্ধ্যা সওয়া ৭টায় হাওড়া স্টেশন ছাড়া ট্রেনটির আর এক নাম— ‘সিঙ্গুর আন্দোলন লোকাল’। সিঙ্গুর এবং সেই জমিতে আন্দোলনের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের আবেগ বোঝাতেই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বেনজির ভাবে কোনও লোকাল ট্রেনের এমন নামকরণ করেছিলেন। সেই সিঙ্গুর। তৃণমূলের উত্থানের সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। যেমন ভাবে সিঙ্গুরের সঙ্গে জড়িয়ে ‘মাস্টারমশাই’ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নাম। তৃণমূলের সেই ‘রবি’ সোমবার উদিত হলেন গেরুয়া আকাশে।
দল তাঁকে প্রার্থী করেনি। বয়সের কারণ দেখিয়েই করেনি। একই সঙ্গে তাঁর পছন্দের বা পরিবারের কাউকেও টিকিট দেয়নি। উল্টে দলে তাঁর বিপরীত মেরুতে থাকা বেচারাম মান্নাকে সিঙ্গুর কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। শুধু কি তাই! পাশের কেন্দ্র হরিপালেও প্রার্থী হয়েছেন বেচারামের স্ত্রী করবী মান্না। ক্ষোভের অনেক কারণ ছিল। আর সেই ক্ষোভ থেকেই ৯০-এর দোরগোড়ায় চলে-যাওয়া রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন বিজেপি-তে। অভিমানী গলায় বললেন, ‘‘তৃণমূলে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।’’ অন্য দিকে, আগ্রহ দেখিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের প্রয়োজন। গেরুয়াশিবির মনে করছে, নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দুকে দলে আনার পরে এটাও ‘পরিবর্তন’-এর আন্দোলনভূমিতে একটা মাস্টার-স্ট্রোক— সিঙ্গুরের মাস্টারমশাইকে দলে নিয়ে। বিজেপি মনে করছে, মমতার দুই আন্দোলনভূমিতে নেত্রীর দুই সঙ্গীকে পাশে পাওয়াটা নীলবাড়ির লড়াইয়ে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে। শুভেন্দুকে ইতিমধ্যেই নন্দীগ্রামের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিজেপি। সিঙ্গুরে কী হবে, তা এখনও অজানা। যদিও রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন তিনি প্রার্থী হতে ইচ্ছুক। সোমবার বিজেপি-র যোগদান মেলায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘সিঙ্গুরের সকলের আদর্শ মাস্টারমশাই সৎ এবং পরিচ্ছন্ন মানুষ।’’ সেটা অবশ্য দলত্যাগের পরেও মানছে তৃণমূল। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, ‘‘দল মনে করলে আমি প্রার্থী হতে ইচ্ছুক।’’
টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা বানাতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের উদ্যোগ। জমি অধিগ্রহণ। জমি দিতে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের আন্দোলনে তৃণমূলের যোগদান। মমতার নেতৃত্ব। এক দীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না মাস্টারমশাইয়ের নাম। নন্দীগ্রামের মতো সিঙ্গুরও তৃণমূলের আন্দোলন-ভূমি। দুই ভূমিতেই কি তবে জোড়াফুলের জমিতে থাবা বসাল পদ্ম?
মানছে না তৃণমূল। দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘‘উনি (রবীন্দ্রনাথ) সৎ ও ভাল মানুষ। সিঙ্গুরে ওঁর খুব ভাল ইমেজ ছিল। উনি অন্য দলে চলে যাওয়ায় দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু দলের কোনও ক্ষতি হবে না।’’ একই সঙ্গে সৌগতর দাবি, ‘‘ওঁর অনেক বয়স হয়েছে। উনি আমাদের ‘শালগ্রাম শিলা’ ছিলেন। ওজনে ভারী। কিন্তু নড়ানো যায় না। ওঁর জন্য দলের সংগঠনই কাজ করত। তাই দলের কিছু অসুবিধা হবে না। বরং এই বয়সে দলবদল করায় ওঁর ভাবমূর্তিই খারাপ হবে।’’ কিন্তু কেন চলে গেলেন দলের এত বছরের সঙ্গী? ২০ বছরের বিধায়ক? সৌগতর জবাব, ‘‘বয়সের জন্যই ওঁকে প্রার্থী করেননি মমতা। উনি চেয়েছিলেন ওঁর কাছের কাউকে প্রার্থী করা হোক। কিন্তু সকলের সব দাবি তো মানা যায় না।’’
তৃণমূলের প্রথম দিকের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ। ২০০১ সালেই বিধায়ক হন তিনি। সিঙ্গুর আন্দোলনের অন্যতম মুখও ছিলেন। ২০১১ সালে মমতার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মন্ত্রীও করা হয় তাঁকে। তবে পরে দলের সঙ্গে অনেকটাই ‘দূরত্ব’ তৈরি হয় এই প্রবীণের। দ্বিতীয় দফার তৃণমূল সরকারে মন্ত্রিত্ব পাননি। বেচারামের সঙ্গে গোলমাল হলেও দল ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না কিছুদিন আগে পর্যন্তও। সম্প্রতি তাঁর ছেলে তুষার অবশ্য প্রকাশ্যেই বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার কথা বলেন। সেই সময় মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ‘‘ছেলে যেতেই পারে। তার জন্য বাবাকেও যেতে হবে, এমন কোনও কারণ নেই।’’ গত ২১ জানুয়ারি এমন কথা বলা রবীন্দ্রনাথ ৮ মার্চ বিজেপি-তে। এর মাঝে রয়েছে ৫ মার্চ। সে দিন প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেন মমতা। ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের চোখে জল এসেছিল। বিজেপি-তে যোগদানের পরে তৃণমূল মনে করছে, আসলে অনেক দিন থেকেই তলে তলে তিনি বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। কিন্তু অপেক্ষা করছিলেন, শেষ মুহূর্তেও যদি প্রার্থী হওয়ার শিকে ছিঁড়ে যায়। সেটা না হওয়াতেই এই বদল। ক্ষোভের কথা সোমবার নিজেই বলেছেন মাস্টারমশাই। বলেছেন, ‘‘দল আমাকে পরিত্যাগ করেছে। যদি দল আমাকে রাখতে চাইত, তা হলে আলোচনা করে, জানিয়ে কিছু করতে পারত।’’ বেচারামকে নিয়ে ক্ষোভও গোপন করেননি। বলেছেন, ‘‘বেচারাম মান্না ও তাঁর স্ত্রী পাশাপাশি দু’টি কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ায় আমার আরও ক্ষোভ। এটা কি একটা পারিবারিক সম্পত্তি হয়ে গেল?’’ এ বার কি তিনি সিঙ্গুরে বিজেপি-র প্রার্থী? রবীন্দ্রনাথের মাস্টারস্ট্রোক— ‘‘আমি নিজে থেকে প্রার্থী হতে চাইব না। দল ঠিক করবে। দল টিকিট দিলে আমি গ্রহণ করব। আমি ইচ্ছুক।’’
সোমবার সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ছেড়ে যাওয়া ‘আন্দোলন লোকাল’-এ আলোচনার কেন্দ্রে নিশ্চিত ভাবে বড় অংশ জুড়ে ছিলেন মাস্টারমশাই। শুধু ওই ট্রেন কেন, এ তো গোটা রাজ্যের কাছেই আলোচনার বিষয়। বৃহদার্থে সিঙ্গুর তো শুধু হুগলি জেলার নয়, গোটা বাংলার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy