নিশানায়: ভোটের দেওয়াল লিখনে ব্যঙ্গচিত্রের প্রাধান্য। তপসিয়া অঞ্চলে একটি রাজনৈতিক দলের প্রচার এ ভাবেই। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সময় বদলেছে, বদলেছে ভোট-প্রচারের ধরন। একদা বঙ্গ ভোটের অঙ্গ-শোভা ছিল দেওয়ালের ছড়া-কার্টুন। কিন্তু এখন সে সব আর তেমন ভাবে চোখে পড়ে না। ইটের দেওয়াল থেকে সেই ছড়া-কার্টুন জায়গা নিয়েছে ই-দেওয়ালে।
সূক্ষ্ম রসিকতা হোক বা ব্যঙ্গ— বাংলার ভোটপ্রচারে তা চিরদিনই অন্যতম অস্ত্র। গত শতকের ষাটের দশকে মূল্যবৃদ্ধি ও অনটনের সময়ে প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষের মতো কংগ্রেস নেতাদের খোঁচা দিয়ে সিপিএম লিখেছিল, ‘দু’টাকা সের বেগুন কিনে মন হল প্রফুল্ল/ ঘরে এসে কেটে দেখি সবই কানা অতুল্য’। ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হয়েছিল সিপিআইয়ের। সেই সময়ে কংগ্রেসের প্রতীক ছিল গাই-বাছুর। সিপিআই-কে কটাক্ষ করে সিপিএমের দেওয়াল লিখন, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। জরুরি অবস্থার পরে রায়বরেলীতে ভোটে হারলেন ইন্দিরা গাঁধী। উৎফুল্ল বিরোধী শিবির। পরবর্তী সময়ে চিকমাগালুর থেকে উপনির্বাচনে জিতলেন ইন্দিরা। বাংলার দেওয়ালে কংগ্রেস লিখল, ‘রায়বরেলী ভুল করেছে ভুল করেছে, চিকমাগালুর করেনি/ সিপিআইএম মনে রেখো ইন্দিরা গাঁধী মরেনি’।
আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তপ্ত হয়েছিল গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে ঘিরে। ওই সময়ে ‘হোপ এইটটি সিক্স’-এর আয়োজন করে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী তথা প্রয়াত সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী। ওই অনুষ্ঠানকে অস্ত্র করে কংগ্রেসের দেওয়াল লিখন, ‘লতার গান, আশার গান জ্যোতি বসুর জড়ায় প্রাণ/ তালে তালে বাজছে ব্যান্ড গোর্খাল্যান্ড, গোর্খাল্যান্ড’। বফর্স দুর্নীতির অভিযোগের সময়ে বামপন্থীরা দেওয়াল ভরিয়ে দিয়েছিল ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়’ লিখে।
সময় যত গড়িয়েছে, মানুষের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়া ততই বেশি জায়গা করে নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালই হয়ে উঠেছে ভোটপ্রচার বা যে কোনও বিষয়ে মতামত দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে যাদবপুরের তৃণমূল প্রার্থী, অধুনা সাংসদ মিমি চক্রবর্তী বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মাতৃসমা। তা নিয়ে বিরোধীরা ই-দেওয়ালে লিখেছিলেন, ‘কালীঘাটের টালির চালে নেমেছে খুশির ঢল/ দিদির আবার মেয়ে হয়েছে দেখবি সবাই চল’। অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, বাস্তবের দেওয়ালের থেকে ই-দেওয়ালের গুরুত্ব বৃদ্ধি অনিবার্যই ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘দেওয়াল লিখনে যে প্রার্থী সম্পর্কে যা লেখা হচ্ছে, সেটা দলের নিজস্ব কিছু কথা, যা ওই এলাকার লোকই দেখতে পেতেন। এখন সোশ্যাল মিডিয়া এসে যাওয়ায় প্রসার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।’’
দেওয়াল লিখনে একমাত্রিকতা আছে। কিন্তু ই-দেওয়ালে কেউ কিছু লিখলে অন্য দলের লোকজনও সেখানেই পাল্টা কিছু মন্তব্য বা কটাক্ষ করতে পারেন। উদয়নবাবু বলছেন, ‘‘দেওয়াল লিখনে পার্টির নিজস্ব বয়ান থাকত বা থাকে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কমেন্টের মাধ্যমে বিতর্কটা প্রসারিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বেশি উদ্ভাবনী বিষয়টা থাকে।’’
একই মতের সমর্থক প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়া আসার পরে মনোভাব প্রকাশ অনেক সহজ হয়েছে। অনেকেই খুব দ্রুত নিজেদের মতামত সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন।’’ অর্থাৎ, আগে দেওয়াল লিখতেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক দলের সমর্থকদেরও প্রচারের কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ এসেছে।
প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে ‘বিলো দ্য বেল্ট’-এর বিকল্প কোনও কালেই নেই। এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরুদ্ধ পক্ষকে একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণের ঘটনা আকছার ঘটছে। কার্টুনিস্ট মহফুজ আলির কথায়, ‘‘আগে দেওয়াল লিখনে ঠাট্টা, শ্লেষ, কটাক্ষের পাশাপাশি অশালীনতাও ছিল। তবে তাকে খুব একটা প্রশ্রয় দেওয়া হত না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় অশালীনতার কোনও সীমা রাখা হচ্ছে না।’’ এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যের যুক্তি, ‘‘এখন জীবনযাপনের ধরনের মধ্যেই আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক মনোভাব অতীতে বেশি ছিল না কম ছিল, সেই তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু এখন তার বহিঃপ্রকাশ অনেকটাই বেশি দেখা যায়। তার প্রভাব সোশ্যাল মিডিয়াতেও পড়ছে।’’
যাঁরা রাজনীতি ও রাজনীতির আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের অনেকেই মনে করেন, দেওয়াল লিখন থেকে এমন কিছু ছড়া বা কার্টুন পাওয়া যেত, যা দীর্ঘদিন মনে থেকেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালের ছড়ায় সেই দীর্ঘমেয়াদি বিষয়টা নেই। এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত মহফুজ আলিও। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তাৎক্ষণিকতা অনেক বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট এখন বড়জোর দু’-তিন দিন মনে থাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy