কলকাতায় বিজেপি-র সদর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দলীয় কর্মীদের। ছবি: পিটিআই
অন্য রাজনৈতিক দলের থেকে স্বতন্ত্র থাকার ‘অহঙ্কার’ থেকেই বিজেপি ‘পার্টি উইদ আ ডিফারেন্স’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে বরাবর। কিন্তু তাতেই যেন চিড় ধরল সোমবার। আর সেটা হল এমন দিনে যে দিন রাজ্য সফরে খোদ অমিত শাহ। দিনভর দলীয় কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে বিজেপি-র মুখ তো পুড়লই, সেই সঙ্গে অস্বস্তিতে পড়লেন রাজ্য নেতারাও।
কিন্তু কেন এমন হল? নিজেদের ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দল বলে দাবি করা বিজেপি কর্মীদের কোনও শৃঙ্খলে বাঁধতে পারল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাজ্য বিজেপি-র অন্দরে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলছে দোষারোপের পালা। দক্ষিণপন্থী দলে এমনটা হয়ে থাকে বলে নবীনরা অনেকে দাবি করলেও এমন বিজেপি ‘অচেনা’ বলছেন পুরনোরা। অনেকেই টেনে আনছেন তৃণমূল ও কংগ্রেসে প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভের অতীত নিদর্শনের কথা। এটা ঠিক যে, নির্বাচনের প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ তৃণমূলনেত্রীর কালীঘাটের বাড়ির দরজাতেও পৌঁছেছে অতীতে। কলকাতায় কংগ্রেস সদর দফতর বিধান ভবনে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে লজ্জাজনক হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। বিজেপি-তে যে কোনও কালে এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়নি সেটা নয়। কিন্তু দলের পক্ষে সেই বিক্ষোভকে প্রকাশ্যে ‘অনভিপ্রেত’ বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি কখনওই। সোমবার দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এটা দলের নিয়মবিরোধী। অনভিপ্রেত। আমাদের মতো দলে এটা হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।’’
প্রথম দফার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগেও বিজেপি-র ক্ষোভ-বিক্ষোভের আশঙ্কা ছিল। গেরুয়া সূত্রেই জানা যায়, সেই কারণে তালিকা তৈরি হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্রিগেড সমাবেশের বেশি আগে তা ঘোষণা করা হয়নি। বেছে নেওয়া হয় সমাবেশের আগের সন্ধ্যাকে। প্রথম দফায় সে ভাবে বিক্ষোভও সামনে আসেনি। যেটা হয় রবিবার দ্বিতীয় দফায় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর পরই। বিতর্ক তৈরি হতে পারে এমন ১২টি আসন বাদ রেখেই দিল্লি থেকে তালিকা ঘোষণা করেন পদ্ম শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ আটকানো যায়নি। চুঁচুড়া কেন্দ্রে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করায় জেলার হতাশ নেতা সুবীর নাগ ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ ঘোষণা করেন। হুগলিরই উত্তরপাড়া ও সিঙ্গুরে তৃণমূলত্যাগী দুই বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল ও রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয় কর্মীদের মধ্যে। তা প্রকাশ্যে এসে গেলেও খুব একটা অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি দলকে। বেহালা পূর্বে প্রার্থী হতে না পারা শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি ছেড়ে দেওয়াতেও দলকে অতটা অস্বস্তি পড়তে হয়নি, যেটা সোমবার হল।
সোমবার হাওড়ার পাঁচলা ও উদয়নারায়ণপুর বিধানসভা কেন্দ্রের কয়েকশো বিজেপি কর্মী-সমর্থক কলকাতার হেস্টিংসে রাজ্য বিজেপির প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অভিযোগ, দল যাঁদের প্রার্থী করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। পাঁচলা থেকে বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন মোহিত ঘাঁটি। তাঁর বিরুদ্ধে তোলাবাজি, মধুচক্র ও বেআইনি কারবারে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলেন বিক্ষোভকারীরা। পাশাপাশি উদয়নারায়ণপুরের প্রার্থী সুমিতরঞ্জন করারকে বহিরাগত বলেও দাবি করেন বিক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীরা। ওই দু’জনের প্রার্থিপদ অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানান তাঁরা। ওই দাবিতে হেস্টিংসে দফায় দফায় বিক্ষোভও দেখানো হয়। বিক্ষোভের মুখে পড়েন বিজেপি-র একাধিক শীর্ষ স্থানীয় নেতা। তার মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিবপ্রকাশও। শুধু কলকাতা নয়, হুগলিতে দলীয় দফতরে ভাঙচুর চলে। এক ‘নবাগত’কে আদিসপ্তগ্রামে প্রার্থী করা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় এক কর্মী রেললাইনে শুয়ে আত্মহত্যার হুমকিও দেন।
এ সব দেখে বিজেপি-র একাংশ বলছে, দলের দরজা হাট করে খুলে রাখারই পরিণতি এটা। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একাধিক বার অন্য রাজনৈতিক দল ছেড়ে আসাদের যোগদান নিয়ে বলেছেন, ‘‘বিজেপি সকলকে স্বাগত জানাতে তৈরি। আমাদের দলের মন অনেক বড়।’’ সেই নীতির দিকে অনেকেই আঙুল তুলেছেন সোমবার। তবে দিলীপ ঘনিষ্ঠদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপেই দরজা খুলে রাখতে হয়েছে। অনেক যোগদানই রাজ্য সভাপতি জানতে পারেননি। অথবা শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছেন। তিনি একটা সময় ‘দরজা বন্ধ’ করার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু শোনা হয়নি।
রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক এই ক্ষোভকে ‘অনভিপ্রেত’ বললেও অনেকেই সেটা মানতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, দল যে বিধানসভা দখল করার মতো শক্তিতে পৌঁছেছে সেটাই প্রমাণ দিচ্ছে এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ। রাজ্য বিজেপি-র এক প্রবীণ নেতার বক্তব্য, ‘‘একটা সময় পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থী খুঁজে পেত না। এখন দলের ১৮ জন সাংসদ। দল বিধানসভা দখলের দোড়গোড়ায়। সেই কারণেই এত কর্মী প্রার্থী হতে চাইছেন। অন্য দলের নেতা, বিধায়করা বিজেপি-র আশ্রয়ে আসতে চাইছেন। আসছেন। সেই কারণেই ক্ষোভ।’’
বাংলার বিজেপি-তে আদি-নব্য বিবাদ অনেক দিন ধরেই চলছে। তৃণমূল ছেড়ে মুকুল রায় গেরুয়া শিবিরে আসার পরে অনেক সময়ই তাঁর সঙ্গে দিলীপ ঘোষের বিবাদ প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। একাধিক বার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুই নেতাকে একসঙ্গে নিয়ে বসেছেন। একসঙ্গে চলার নির্দেশও দিয়েছেন। ভোটের আগে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দু’জনকে একসঙ্গে চলার নির্দেশ দিলেও ভিতরে ভিতরে চাপা উত্তেজনাটা পুরোপুরি যায়নি। শুভেন্দু অধিকারী যোগ দেওয়ার পরেও কোথাও কোথাও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে শুভেন্দু নিজে শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রমাণ দিয়ে সেই বিতর্কে কখনও জড়াননি। তবে দলে তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধিতে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষোভ বেড়েছে দিলীপ ও মুকুল ঘনিষ্ঠদের মধ্যে।
দলে এমন দাবিও উঠতে শুরু করে যে, গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা নেতাদেরই এগিয়ে থাকা ১২১টি আসনে প্রার্থী করা হোক। যাঁরা পরে এসেছেন এবং এর পরেও আসবেন, তাঁরা লড়ুন বাকি ১৭৩ আসনে। এবং জিতে দেখান! ওই ‘আদি’ নেতাদের বক্তব্য, যে সব এলাকায় বিজেপি একাই জেতার মতো জায়গায় রয়েছে, সেখানে দলের নীতি আলাদা হোক। অনেক ক্ষেত্রে এমনও বলা হচ্ছে যে, তৃণমূল থেকে এমন অনেক নেতা বিজেপি-তে এসেছেন বা আসতে পারেন, যাঁদের সঙ্গে দলের কর্মীদের লড়তে হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। যে প্রশ্ন উঠেছিল পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক তথা আসানসোল পুরসভার প্রাক্তন প্রশাসক জিতেন্দ্র তিওয়ারির বিজেপি-তে যোগদানের জল্পনার সময়। পরে তাঁকে নেওয়াও হয়। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম দফায় জল্পনার সময়ে দলের একটা বড় অংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, আসানসোলে যখন বিজেপি পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে জিততে পেরেছে, তখন দলের এতটা ‘জিতেন্দ্র-নির্ভরতা’ কেন! অনেকে এমনও বলেন যে, লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি কর্মীদের মূল লড়াইটাই ছিল জিতেন্দ্রর বিরুদ্ধে! যদিও সেই প্রশ্ন বা যুক্তিকে আমল দেননি বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জিতেন্দ্র নিয়ে প্রকাশ্যে ‘দলের বিরোধী’ মন্তব্য করায় শো-কজ করা হয়েছিল সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু, মহিলা মোর্চা সভানেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল-সহ চার জনকে। এর পরে বর্ধমানে দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনাতেও এক ডজন কর্মীকে শো-কজ করা হয়। কিন্তু এখন বিক্ষুব্ধদের সংখ্যাটা অনেকে বেশি। এমন ক্ষোভ যাতে তৈরি না হয় তার জন্যই বিজেপি সায়ন্তন, অগ্নিমিত্রার মতো রাজ্য স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করে নিচু স্তরে বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বজ্র আঁটুনি যে অনেকাংশেই ফস্কা গেরো হয়ে রয়েছে সেটাই যেন সোমবারের ঘটনাপ্রবাহ বুঝিয়ে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy