ব্রাত্য বসু, বিমলশঙ্কর নন্দ, পলাশ দাস
আপনার পেশা কী? “এমনিতে অধ্যাপনা। তবে টেলিভিশন ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক হিসেবেই আমাকে লোকে বেশি চেনেন।”, দমদমের বিজেপি প্রার্থী বিমলশঙ্কর নন্দের এই মন্তব্য শুনেই মনে পড়ে যায় এলাকায় কান পাতলেই শুনতে পাওয়া কথাটা। অনেকেই বলছেন, “তৃণমূলের হয়ে টিভিতে যিনি গলা ফাটাতেন, তিনিই বিজেপি-র টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়লেন? টিকিটটা দরকার ছিল হয়তো!”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, মাঝে যে সময় তৃণমূল টেলিভিশন টক-শো এড়িয়ে চলছিল, সেই সময়ই বিমলবাবুর ‘উত্থান’। সন্ধ্যার গরমাগরম আলোচনায় তাঁকে দেখা যেত কার্যত তৃণমূলের ‘অঘোষিত মুখপাত্র’ হিসেবেই। সেখান থেকে হঠাৎ বিজেপি-র টিকিটে ভোটপ্রার্থী কেন? বিমলবাবুর যুক্তি তিনি ‘হিসেব কষেই’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর কথায়, “কোনও কালেই আমি তৃণমূলের অঘোষিত মুখপাত্র ছিলাম না। ওটা সিপিএম বলত। প্রথমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই ভাল লাগত। চেষ্টা করলেই আমি তৃণমূলের একজন কেউকেটা হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে হিসেব করে দেখেছি, দল হিসেবে তৃণমূল দাঁড়াবে না।”
দমদমের সিপিএম প্রার্থী পলাশ দাস অবশ্য বললেন, “ওঁ তো একা নন, দমদমের এক তৃণমূল কাউন্সিলরও এখন উল্টো সুরে গাইছেন। তৃণমূল প্রার্থী নিজে গিয়ে তাঁর মানভঞ্জন করিয়েছেন।” প্রবীর পাল (কেটি) নামে দক্ষিণ দমদমের যে কাউন্সিলর ভোটের আগে দলত্যাগী হতে পারেন বলে খবর ছিল, তাঁকে অবশ্য এ বারের ভোটে ‘নিষ্ক্রিয়ই’ দেখা যাচ্ছে। নাট্টব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক তথা রাজ্যের মন্ত্রী, দমদমের তৃণমূল প্রার্থী ব্রাত্য বসু বললেন, “কারও সম্পর্কেই আলাদা করে কিছু বলব না। কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাজ করে থাকতে পারে। আর দমদমের কাউন্সিলরেরা দলের প্রতি ১০০ শতাংশ দায়বদ্ধ।
জিতছে তৃণমূলই।”
এই জয়ের দাবি প্রসঙ্গে তৃণমূলের ব্যখ্যা, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তৃণমূলের ‘খারাপ’ ফলাফলের মধ্যেও বিধানসভা ভিত্তিক ফলের নিরিখে দমদম কেন্দ্রে বিজেপি-র থেকে পাঁচ হাজার ১১২ ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দমদম কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী পলাশ যেখানে ৭২ হাজার ২৬৩টি ভোট পেয়েছিলেন, সেখানে ২০১৯-এ দমদমে সিপিএমের ভোট কমে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৬০০। পাঁচ হাজার ৪৩টি ভোট কমেছিল তৃণমূলেরও। কিন্তু তা সত্ত্বেও দমদমে পাঁচ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলই। এক তৃণমূলকর্মীর মন্তব্য, “কিছু ভোট যদি এ বার সিপিএম ঘরে ফেরাতে পারে, লাভ আমাদেরই। অন্য কেউ এখানে ছবিতেও নেই।” সিপিএম প্রার্থী ভোট ঘরে ফেরানোর নিশ্চয়তা দিয়েই বললেন, “নতুন প্রজন্ম আমাদের সঙ্গে। ভোট তো ফিরবেই, সিপিএমই জয়ী হবে।”
দমদমের বাসিন্দাদের বড় অংশই অবশ্য এই পাটিগণিতে মন দিতে নারাজ। তাঁরা বরং বেশি উৎসাহী কে, কী পেয়েছেন, সেই হিসেব কষতে। যেখানে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠছে লকডাউনের স্মৃতি। দমদম ছাতাকলের একটি মিষ্টির দোকানের মালিক যেমন বললেন, “দশ বছর আগের দমদম আর এ দমদমের অনেক পার্থক্য। পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস যেমন কমেছে তেমনই
লকডাউনের মধ্যে মানুষ তাঁর সমস্যার কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। শুধু তো তৃণমূল সরকার নয়, দল তৃণমূলও আগাগোড়া পাশে থেকেছে।” নাগেরবাজারের বাসিন্দা স্নেহময় কর্মকারের আবার দাবি,
“লকডাউনে মাজা ভেঙে যাওয়া মানুষকে তো তৃণমূল সরকারই বিনামূল্যে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করেছে। সেই সাহায্য ভুলব কী করে? আর এটাই বা ভুলব কী করে যে, কেন্দ্রের সরকার তেলের দাম এত বাড়িয়েছে যে, অনেকেই গাড়ি বাড়িতে রেখে অফিস যাচ্ছেন। দিদির দেওয়া বিনা পয়সার চাল ফোটাতে গ্যাসের দাম ছ্যাঁকা দিচ্ছে।” দমদম বেদিয়াপাড়ার এক তরুণ ভোটার আবার বললেন, “আগে লটারির টিকিট নিয়ে বসতাম। এখন
পুরসভার সাফাইকর্মীর কাজ পেয়েছি। কিছুদিন আগেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে হাত ভেঙে যাওয়া মায়ের চিকিৎসা করিয়ে এনেছি। এখন অনেকেই আমাদের মতো কলোনির কিছু ভোট টাকা দিয়ে কিনতে চাইছেন। কোথাও ২০০ দেওয়া হচ্ছে, কোথাও পাঁচশো। টাকা নিয়ে ভাবছি, এ তো আমাদেরই টাকা। ১৫ লাখ দেবে বলেছিল, সেটাই ছোট ছোট কিস্তিতে দিচ্ছে। ভোটটা যথা স্থানেই পড়বে।”
এই বেদিয়াপাড়ারই আরও এক বাসিন্দার কথায়, “সবই তো হল, পরিস্রুত পানীয় জল থেকে কিন্তু আমরা এখনও বঞ্চিত। দমদমের বহু জায়গাতেই কিন্তু পরিসুদ্ধ পানীয় জল আসেনি।” দমদম মধুগড়ের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা তন্দ্রা বসাক আবার বললেন, “২০০৯ সালের ভোটে এক প্রার্থীকে বলতে শুনেছিলাম, জল এনে দেওয়া কী এমন ব্যাপার! জলের বন্যা বইয়ে দেবো। জলের বন্যা কখন বয় জানেন? যখন বৃষ্টি হয়।” অনেকের মুখেই উঠে এসছে জল থইথই দমদমের কথা। তাঁদের প্রশ্ন, বাঘজোলা খাল কী আদৌ সংস্কার হয়? যদি হয়, তা হলে দমদম জলে ভাসে কেন? বিজেপি এবং সিপিএম-এর উভয়েরই প্রশ্ন, “আর জি কর হাসপাতালের উপর ব্যাপক চাপ দেখেও কেন ১০ বছরে দমদমে আলাদা করে একটা ভাল সরকারি হাসপাতাল তৈরি করা গেল না? বিধানসভা এলাকায় একটিও দমকলকেন্দ্র নেই কেন?
নাগেরবাজারে যেটি ছিল সেটিই বা তুলে দেওয়া হল কেন?” সিপিএম প্রার্থী আবার বললেন, “একের পর এক কারখানা বন্ধ। দশ বছরে দমদমের শিল্পাঞ্চল পরিচিতি ফেরানো
গেল না কেন?”
ব্রাত্য যদিও বলেন, “প্রায় সমস্ত বাড়িতেই জল পৌঁছনো গিয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে পানীয় জল ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করব। বিমানবন্দরের ২ নম্বর গেট থেকে মল রোড পর্যন্ত উড়ালপুলও ব্যয় বরাদ্দের তালিকায় রয়েছে। প্রচুর ছেলে-মেয়ে কাজ পেয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরে তা আরও বাড়বে। তা ছাড়া আমিই সম্ভবত সেই বিধায়ক যে প্রথম মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রতি মঙ্গলবার ওয়ার্ড ধরে ধরে বসে মানুষের সমস্যা শুনেছি। আদতে কিছু বলার নেই, বিরোধীরা বিরোধিতা করতে হয় বলে করছে।”
সারা বছরের ‘উৎসবের কেন্দ্র’ দমদম রোডের হকারদের সঙ্গে জনসংযোগে ব্যস্ত তৃণমূল প্রার্থী এর পর বললেন, “এই রাস্তা নিয়েও অনেকের অনেক অভিযোগ। একটি রেল স্টেশন, মেট্রো স্টেশন তৈরির পরেও দমদমের রাস্তা সম্প্রসারণ হয়নি। এই হকারদের আমরা জোর করে উচ্ছেদ করতে চাইনি। বরং পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি। গুজরাত সরকার তো এ নিয়ে বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েছে।”
এত কিছু সত্ত্বেও কি এ বার একটু বাড়তি চাপ অনুভব হচ্ছে? তৃণমূল প্রার্থী বললেন, “ব্রাত্য বসু বলছে, ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক মেরুকরণের চেষ্টা ব্রাত্য করে রেখেই তৃণমূলের পক্ষে মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ২ তারিখ ফল প্রকাশের দিনমিলিয়ে নেবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy