শীতলখুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন শশী পাঁজার। রবিবার, বাগবাজারে। নিজস্ব চিত্র।
এত রাগ কেন? এ যেন রাগের আগ্নেয়স্তূপের উপরে বসে আছে বঙ্গদেশ। রাস্তায় বেরোলে, বাসে, মেট্রোয় সামান্য বিষয় থেকে তর্কাতর্কি, তার পরে তা থেকে অতর্কিতেই মারামারি, রক্তারক্তিতে চলে যাচ্ছে। বাড়ির মধ্যে রাগের চোটে ভাঙচুর চলছে সদ্য কেনা টেলিভিশন সেট, শৌখিন আসবাবের। এই রাগের বৃত্ত বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে তা গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর গোষ্ঠী তো এ বঙ্গদেশে এক নয়, একাধিক। অতএব রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে গোষ্ঠীর দলবল পরস্পরের উপরে হামলা চালায়। রক্তে ভিজে যায় মাটি।
সেই মাটির উপর দিয়ে সদর্পে রক্ষীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হেঁটে যায়। তারা নাকি নির্বাচনী বঙ্গে শান্তিদৌত্য করতে এসেছে। তা হলে, তা হলে কেন ওই যে, ওই বাড়ির দাওয়া থেকে পরিজনদের চিৎকার ভেসে আসে? যাঁদের ছেলেকে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ‘শান্তিবাহিনী’-র বিরুদ্ধে। বা প্রথম বার ভোট দিতে গিয়ে তরুণের আর বাড়ি ফেরা হয় না! যা নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। ‘শান্তিরক্ষা’ বাহিনীর তরফে দাবি করা হয়েছে, আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল তারা। কিন্তু এই উত্তর কে বোঝাবে, কবেই বা বোঝাতে পেরেছে সন্তানহারা মা, পরিবার-পরিজনেদের!
বাংলার থমথমে আকাশের নীচে প্রায় জনমানবশূন্য রাস্তায় পড়ে থাকে রক্তস্নাত পলাশ। ‘‘আমার মনে হয় আমরা আগের থেকে অনেক বেশি হিংস্র, অনেক বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছি। যার প্রতিফলন ব্যক্তিগত, সমাজজীবন এবং রাজনৈতিক আঙিনাতেও পড়ছে।’’— বলছিলেন এক সমাজতাত্ত্বিক। ইতিহাসবিদদের একাংশ আবার বাংলার সঙ্গে গুন্ডারাজের যোগসূত্রের ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, কলকাতায় প্রথম গুন্ডা আমদানি করা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে। সেটা ১৯২৫-’২৭ সাল। বহিরাগত সেই গুন্ডাদের ব্যবহার ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। যার ফল, অগুনতি মানুষের মৃত্যু।
তার পরে বিচ্ছিন্ন ভাবে গন্ডগোল, আরও পরে নকশাল আন্দোলন, বাম জমানায় রাজনৈতিক হিংসা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বর্তমানের হিংসার ধরন ও চরিত্র পূর্বতন হিংসার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে জানাচ্ছেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়। বর্তমানে বহিরাগতদের মাধ্যমে সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত ভাবে হিংসা ছড়ানো হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা গুলি চালিয়ে ভোটারদের মেরে ফেলল! এই ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে কি না, জানি না। সব মিলিয়ে কলকাতা-সহ সমগ্র বাংলায় যেন এক উত্তাল হিংসা-স্রোত বইছে। যার আশ্রয় কম-বেশি সব রাজনৈতিক দলই নিচ্ছে। ফলে সে বিষয়ে সংযত হওয়া প্রয়োজন।’’
কিন্তু কে সংযত হবে? কেনই বা হবে? কেউ যদি মুখ বুজে চুপ করে বসে থাকে, তা হলে তো তাঁকে ধরে নেওয়া হবে দুর্বল হিসেবে। অতঃপর চুপ করে থাকা সেই ব্যক্তিই হোক কিংবা রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর জন্য ‘‘ও তো জলভাত। ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই’’— এই শ্লেষ, এই বক্রোক্তি চলতেই থাকবে। ফলে কেউ আর চুপচাপ বসে থেকে ‘দুর্বল’ তকমা পেতে রাজি নয়। এক মনোবিদের কথায়, ‘‘হাতের কাছে যাকে পারো, মারো। অন্যকে মেরেই যেন নিজের অস্তিত্ব জাহির করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সে কারণেই দেখবেন কোনও রাজনৈতিক নেতা সগর্বে বলছেন, দিকে দিকে শীতলখুচি হবে। আর সেই কথায় হাততালিও পড়ছে তুমুল ভাবে!’’
এর অন্য মানসিকতাও রয়েছে। তা হল,— ‘আমার সব চাই মনোভাব।’ এমনটাই জানাচ্ছেন মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সায়কায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা। তাঁর কথায়, ‘‘আর এই সব চাইতে গিয়ে মানসিক আবেগ এক দিকে ঢলে পড়ছে। আর যখন সেই সব-চাওয়ার মনোভাব কোনও কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, তখন সবাই ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ছে।’’ আর কে না জানে, ক্রোধ হল সর্বগ্রাসী, সর্বধ্বংসাত্মক।
তা হলে কি ডিএনএ পাল্টে যাচ্ছে? যে কারণে সব পক্ষই হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছে? ‘‘না। জিনের কারণে আমরা হিংস্র হয়ে উঠছি, এমন বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। বরং কোনও এলাকার হিংস্রতার মাত্রা সেখানকার মানসিক ও সংস্কৃতির উপরে নির্ভরশীল।’’— বলছেন ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হিউম্যান জিনোম স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রণবীর সিংহ।
যাক! ‘আমরা ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছি’— এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যে এখনও নেই, তা আশ্বাসের কথা। ফলে হিংস্রতার ব্যাখ্যা হিসেবে যা পড়ে থাকে, তা হল নিজেদের মানসিক ধরন ও সংস্কৃতির কথা। যা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। অবশ্য নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা থাকলে তবেই। রজতবাবু বলছিলেন, ‘‘আমার মা বলতেন, কোনও মহিলা গয়না পরে রাতে রাস্তায় বেরোতে পারবেন কি না, তা দেখে বোঝা যায় কোনও শহর কতটা নিরাপদ।’’
কিন্তু রক্তমাখা পলাশকাল জানান দিচ্ছে, শুধু মহিলা কেন, ‘বিরোধী’ পুরুষেরা রাস্তায় বেরোলে, তাঁরা আর ঘরে ফিরতে না-ও পারেন। এমনকি, গণতন্ত্রের উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে ঘরে যা ফিরে আসে, তা হল তাঁর নিথর শায়িত দেহ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy