ফাইল চিত্র।
মখমলের মতো যে রাস্তাটা শালজঙ্গলকে চিরে গড়বেতার দিকে ছুটেছে, তার একপাশে দাঁড়িয়ে শালজঙ্গলে কান পাতলে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে — ‘‘বাবু, বড় নয়-ছয় হয়েছে গো!’’
কেশপুর থেকে ডেবরা — পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার যেখানেই যাবেন, বোরো ধানের জমি থেকে হাট-বাজার, ফিসফিসিয়ে উঠছে ওই নয়-ছয়েরই অভিযোগ। কেশপুরের চায়ের দোকানে বসে উদাস চোখে ইউসুফ বলেন, ‘‘ধুস! গরিবের কথা কেউ শোনে না।’’
কিসের নয়-ছয়?
ডেবরার মোড়ে টোটোচালক সুজিত মান্না বলেন, ‘‘দিদি ঠিক আছে। কিন্তু এই ক’টা বছরে নিচুতলার নেতাদের ভুঁড়ি হয়ে গিয়েছে। বাকিটা বুঝে নিন।’’ গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য সরকারি প্রকল্প রয়েছে, মানছেন সকলেই। সেই প্রকল্পের জন্য টাকা দিচ্ছে সরকার, তাও মেনে নিচ্ছেন খেটে-খাওয়া মানুষগুলো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অভিযোগ, সেই সুবিধা এসে পৌঁছচ্ছে না দুয়ারে। মাঝপথে উবে যাচ্ছে টাকা।
দুই প্রাক্তন আইপিএস উর্দি খুলে ডেবরায় সম্মুখসমরে নেমেছেন। বিজেপি-র ভারতী ঘোষের ‘দাপট’-এর কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর পালে এখন বিজেপি-র হাওয়া। তবে তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর সবে নেমেছেন ভোট ময়দানে। প্রচারে বেরিয়ে এক প্রৌঢ়ার হাত ধরে বললেন, ‘‘আমি পাশে থাকব। কথা দিচ্ছি।’’
পিংলায় স্কুলশিক্ষক মদন মোহন মণ্ডল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হিসেব করছিলেন— ‘‘এখনও ১০-১৫ শতাংশ ভোট আছে বামেদের ঘরে। সেটা বাড়া-কমার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে।’’ আর নয়ছয়ের অভিযোগ? হেসে ফেলেন প্রবীণ মানুষটি। বলেন, ‘‘কাজ তো বেশ কিছু হয়েছে। কিন্তু মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। না মিটলেই অভিযোগ।’’ যে চাহিদার কথা শোনা গেল সবং-এ মাঠ থেকে ফেরা চাষির কাছে। বলেন, ‘‘বাবু, আমার নাম লিখবেন না। পারলে লিখে দেবেন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি পাইনি। তিনি পেয়েছেন, যাঁর আগে পাকা বাড়ি ছিল। সজল ধারায় পানীয় জল পাইনি।’’
সবংয়ের তৃণমূলের প্রার্থী ভূমিপুত্র মানস ভুঁইয়া। আসমুদ্র-হিমাচল বঙ্গের মানুষ তাঁকে এক নামে চেনে। চষে ফেলছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। কলসবাড়ে সামিয়ানার তলায় দাঁড়িয়ে শোনাচ্ছিলেন তাঁর ৪২ বছরের রাজনৈতিক কর্মজীবনের কাহিনি। দূরে দাঁড়িয়ে স্থানীয় সপ্রতিভ যুবকের ফিসফিসানি, ‘‘নিচুতলার নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ! জানি না কী হবে!’’ উল্টো দিকে, অমূল্য মাইতি সবে ঘাস ছেড়ে পদ্ম ধরেছেন। সবংয়ের বিষ্ণুপুর বাজারে বসে হতাশা শোনা গেল উৎপল ধারার গলায়, ‘‘এখানে কাজ কোথায়? থাকলে, বিপদে-আপদে আমাকে মহারাষ্ট্র থেকে ৩৬ ঘণ্টা উজিয়ে বাড়ি ফেরার কথা তো ভাবতে হত না।’’ জেলার তৃণমূল সভাপতি, পিংলার তৃণমূল প্রার্থী অজিত মাইতি-র কথায়, ‘‘এ সব বুঝিয়ে বিজেপি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কয়েকটা আসন পাওয়ার। মানুষের ভরসা এখনও আমাদের সঙ্গে।’’
একই ভরসার কথা বলছেন, নারায়ণগড়ের সিপিএমের প্রার্থী তাপস সিংহ। নারায়ণগড় ছিল সূর্যকান্ত মিশ্রের ঘাঁটি। নারায়ণগড়ের মানুষের কাছে বাম নেতা বললে আজও চোখের সামনে এক চিকিৎসক সজ্জন ব্যক্তির মুখ ভেসে ওঠে। তাপসবাবুর মূলধন সেটাই। সেখানেও ‘সুবিধা’ না পাওয়ার অভিযোগ। অভিযোগ সেই নয়-ছয়ের। নারায়ণগড়ের তৃণমূল প্রার্থীর নামও সূর্যকান্ত। পদবী অট্ট। তাঁর দাবি, ‘‘দুর্নীতির সঙ্গে যাঁদের যোগ ছিল, তাঁদের তো দল থেকে বের করেই দেওয়া হয়েছে।’’
এক সময়ে গোটা জেলাটাই নিয়ন্ত্রিত হত কেশপুরের জামশেদ আলি ভবন থেকে। জেলায় সিপিএম নেতা দীপক সরকারদের যে ‘জমানা’ ছিল, তাতে সন্ত্রাস, অত্যাচারের হাজারো অভিযোগ আজও আছড়ে পড়ে তিন ফসলি জমিতে। যার ফলশ্রুতি, ২০১১-র পরিবর্তন। সেই জামশেদ আলি ভবনে ঢুকতেই দেখা এ বার কেশপুরের সিপিএম প্রার্থী, রামেশ্বর দলুইয়ের সঙ্গে। শুধু নিজে জিতবেন বলে দাবি করে ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি সপাটে বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাস আমরা কখনওই করিনি।’’ কেশপুরের মাথানিয়ায় চায়ের দোকানে দেখা শেখ মুসলেম আলি-র সঙ্গে, ‘‘আপনারাও তো জানেন, এক সময়ে কত অশান্তি হয়েছে এখানে। এখানে বামেদের প্রভাব ফিরে আসা মুশকিল।’’
বিজেপি-র প্রভাব নিয়েও মানুষ নিশ্চিত নয়। তাই জেলায় তৃণমূলের খুব খারাপ ফল হলেও কেশপুরের আসনটা দিদির হাতে শিউলি সাহা তুলে দিতে পারবেন বলে নিন্দুকেরাও বলছেন। শিউলি নিজেও আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি-র মতো টাকা খরচ করতে পারব না। মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ আছে। কিন্তু, মানুষ আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।’’
কেশপুরের মতো খড়্গপুর শহর নিয়েও আশাবাদী তৃণমূল নেতৃত্ব। সেখানে প্রার্থী প্রদীপ সরকার সারা বছর ধরে জন-পরিষেবার কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে বাসিন্দাদের দাবি। তার উপরে রূপালি পর্দার নায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায় বিজেপি-র প্রার্থী হওয়ায় তাঁর সুবিধা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করছেন স্বয়ং প্রদীপ। বলছেন, ‘‘হিরণ যদি জিতেও যান, তা হলে কি আপনারা প্রয়োজনীয় পরিষেবা চাইতে কলকাতা যাবেন? নাকি খড়্গপুরে থাকতে চাইবেন?’’ হিরণ পাল্টা বলছেন, ‘‘মানুষের সেবায় নেমেছি। এটাই এখন আমার অগ্রাধিকার।’’
খড়্গপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ী মহম্মদ জাভেদ আখতারের কথায়, ‘‘৭০ শতাংশ কাজ করেছে প্রদীপ। কিন্তু, বিজেপি-র টাকার জোরটা ভুলবেন না। ২০১৯ সালে আমার এক ঠ্যালাচালকের হাতে ৫ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছিল।’’ — এও এক নয়-ছয়ের নমুনা।
সেই নয়-ছয়ের প্রশ্ন শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ঘাটালের ব্যবসায়ী প্রশান্ত সামন্ত। বলেন, ‘‘কান পাতুন। এখানে প্রার্থী শঙ্কর দলুইয়ের নামে লোকে কী-ই না বলছে।’’ পাশ থেকে অনুপম পাঠকের দাবি, ‘‘শান্তিটাই তো আসল। আমি এম-কম পাশ। দিদির কথা শুনে চপের দোকান করে দিব্যি খেয়ে-পরে আছি।’’
দাসপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে গোপীগঞ্জ-পাঁশকুড়া রুটের বাসচালক বিশ্বনাথ দাস ফিসফিসিয়ে ওঠেন, ‘‘এত মানুষ নিয়ে যাতায়াত করি। একটা বড় সংখ্যক মানুষের মনে কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া।’’ সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী মমতা ভুঁইয়া মানতে নারাজ। ‘‘বাম জমানায় কাজ হয়নি। এখন হচ্ছে। এ কথা দাসপুরের মানুষ জানে’’, প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলেন মমতা। চন্দ্রকোনার যুবক গোপাল রানা, ফিনান্স সংস্থার কর্মী। বাইকে বসে বলেন, ‘‘বিজেপি-র কাছে চলে যাওয়া সিপিএমের ভোট ফিরছে। তাতে সুবিধা হবে তৃণমূলেরই।’’
আর সেখানকার চাষির অভিযোগ, এক বিঘে জমিতে আলু চাষ করতে খরচ হচ্ছে ৪১ হাজার টাকা। বিক্রি করে আসছে ৩৬ হাজার। এও তো এক নয়-ছয়ের হিসেব।
সব মিলিয়ে জেলায় আসন ১৫টা। নিন্দুকেরা বলছে, রেজাল্টটা আবার নয়-ছয় না হয়ে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy