Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Gram Panchayat

Bengal Polls: ‘পঞ্চায়েত বলেছে তোমাদের নেতা নেই, কাজ আনারও কেউ নেই’

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ!

বন্ধ স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটরা। পুরুলিয়ার বিন্দুইডি গ্রামে।

বন্ধ স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটরা। পুরুলিয়ার বিন্দুইডি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

সম্রাট মুখোপাধ্যায়
নিতুরিয়া (পুরুলিয়া) শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২১ ০৬:৫৬
Share: Save:

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ!

কোকিল ডাকছে কি? ডাকছে নিশ্চিত। হাওয়া দিচ্ছে জোর। বসন্তের হাওয়া।

তবে সেই হাওয়া কোন দিকে বইছে, তা ঠাহর করতে পারেন না ঝুমা দাস, বাহমণি হেমব্রম, সবিতা বাউড়িরা। ঠাহর করার তেমন ইচ্ছেও কি আছে তাঁদের? হাওয়ার মতিগতি যেমনই হোক, তাতে কী-ই বা আসে যায়?

‘‘হাওয়া বুঝে হবেটাই বা কী বলো তো? কলে জল আসবে আমাদের? এই তো দেখ না, বাড়ি বাড়ি কল বসিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু এক ফোঁটাও জল পড়ে না। সেই পাশের গ্রামে জল আনতে যেতে হয়।’’ পড়ন্ত বিকেলে রাঢ় বাংলার রুখা মাটির মতোই ক্ষোভ আর অভিমান ঝরে পড়ছে বিন্দুইডি গ্রামের গলা থেকে।

আসানসোল থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। পশ্চিম বর্ধমান থেকে দামোদর পেরিয়ে পুরুলিয়ায় ঢুকতেই নিতুরিয়া ব্লক। বিন্দুইডি সেই ব্লকেরই এক ছোট্ট গ্রাম। রঘুনাথপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। দিগন্তরেখায় দাঁড়িয়ে আছে গড়পঞ্চকোট পাহাড়। পলাশে রাঙা হয়ে আছে চারপাশ।

দু’পাশে মাটির কুঁড়েঘর, মাঝখান দিয়ে ভাঙাচোরা পথ। চার দিকে এক বার তাকিয়ে নিলে গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে কোনও সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যানে চোখ বোলানোর প্রয়োজন হবে না। আশপাশে শিল্প বলতে রয়েছে স্পঞ্জ আয়রনের গুটিকতক কারখানা। সেখানে যৎসামান্য মজুরিতে কাজ করেন কয়েক জন। বাকিরা হয় অবৈধ কয়লা খাদানের শ্রমিক, নয়তো ঢালাইয়ের কাজের রাজমিস্ত্রি। অধিকাংশ খাদানই আপাতত বন্ধ। যার জেরে কাজ গিয়েছে বহু শ্রমিকের। কোথায় আবার কী জুটবে, জানেন না কেউই।

চাষবাসও অবশ্য আছে। তবে রাঢ়বঙ্গের ওই শুষ্ক মাটিতে ফসল ফলাতে জল লাগে প্রচুর। সেই জলের ব্যবস্থাও অপ্রতুল এবং অনিয়মিত। তাই সারা বছর চাষবাসের উপরে নির্ভর করে থাকা মুশকিল। গ্রামের মহিলাদের কয়েক জন কাজ করেন স্থানীয় বিন্দুইডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আয় সামান্যই। তা দিয়েই চলে যায় কোনও মতে।

লকডাউনে কী করলেন? সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করলেন, লকডাউনে নগদে টান পড়লেও পেটে টান পড়েনি। কারণ, সরকারি চাল-ডালের জোগান এসেছে নিয়মিত। তবে অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁদের।

একশো দিনের কাজ পান না?

এ বার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন মহিলারা— ‘‘আমাদের এখানে ও সব কাজ আসে না গো। পঞ্চায়েত বলে দিয়েছে, তোমাদের তো নেতা নেই। তাই কাজ আনারও কেউ নেই। একশো দিনের কাজ এখানে কেউই পাই না আমরা।’’

বছর কয়েক আগে দল বেঁধে একেবারে ‘রণং দেহি’ মূর্তিতে গ্রামের শুঁড়িখানা ভেঙে দিয়ে এসেছিলেন এই মহিলারাই। সেই ‘বীরগাথা’ নিয়ে প্রশ্ন করতেই হেসে গড়িয়ে পড়লেন ছবিবালা আচার্য, চন্দনা দাসেরা— ‘‘সে বার একটা কাণ্ড হয়েছিল বটে! সবাই মিলে এক দিন সাহস করে গিয়ে দিলাম মদের ভাটি ভেঙে। তার পর থেকে এ তল্লাটে আর ওই দোকান খুলতে পারেনি।’’ তা হলে পুরুষদের মদ খাওয়া কি পুরোপুরি বন্ধ? এক প্রবীণা বললেন, ‘‘না না, সে কি আর বন্ধ হয়! তবে গ্রামে আর খেতে পারে না। বাইরে থেকে খেয়ে আসে।’’

কথা বলার ফাঁকেই এ দিক-ও দিক থেকে দৌড়ে এল আরতি, খুশি, প্রণতি, শুভজিৎ, ঝিলিকেরা। আগন্তুককে ঘিরে ধরল এক ঝাঁক হাসিমুখ। কেউ পড়ে প্রাথমিকে, কেউ বা সবে হাইস্কুলে উঠেছে। প্রাথমিকের সকলেই স্থানীয় বিন্দুইডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়া। স্কুল বন্ধ প্রায় এক বছর। অনলাইন ক্লাসের বালাই নেই। কারণ, তার জন্য যে পরিকাঠামো বা আর্থিক সামর্থ্য দরকার, তা থেকে এই গ্রাম কয়েক যোজন দূরে। কিন্তু স্কুলের জন্য মন কেমন করে ওদের সকলেরই। তাই মাঝেমধ্যেই প্রধান শিক্ষক সৌমেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সঙ্গে স্কুলের ভিতরে ঢুকে খানিক হুটোপাটি করে আসে তারা।

সৌমেন্দ্রনাথবাবু জানালেন, ‘নির্মল বিদ্যালয়’ ও ‘শিশুমিত্র’ পুরস্কার পেয়েছে তাঁর স্কুল। সম্প্রতি সেখানে তৈরি হয়েছে মিড-ডে মিল খাওয়ার ডাইনিং হল ও মেয়েদের পৃথক শৌচাগার। আরও নানা রকম পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

ওই গ্রামেরই বাসিন্দা লাল্টু দাস কাজ করেন স্থানীয় স্পঞ্জ আয়রনের কারখানায়। বেতন বাড়ার বদলে কমতে কমতে এখন হাজার সাতেকে এসে দাঁড়িয়েছে। লাল্টু জানালেন, যে কারখানায় তিনি কাজ করেন, সেখানকারই উড়ো ছাইয়ে প্রতিদিন দূষিত হয়ে উঠছে তাঁদের গ্রাম। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বার বার অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। লাল্টু বললেন, ‘‘সারা দিন গ্রামের বাতাসে ছাই উড়ছে। সেই হাওয়াতেই সবাই শ্বাস নিচ্ছি। কী করব? কাজ না করেও উপায় নেই। এই কারখানার উপরেই তো সংসারটা টিকে আছে।’’ সৌমেন্দ্রনাথবাবু জানালেন, স্কুলের টেবিল-বেঞ্চেও প্রতিদিন জমে থাকে ছাইয়ের আস্তরণ।

চাওয়া আর পাওয়ায় ফারাক বিস্তর। তবু সকলেই ভোট দেন নিয়মিত। লোকসভা হোক বা বিধানসভা— নেতা বাছাইয়ের উৎসাহে ভাটা পড়ে না কখনও। ‘ফেডারাল স্ট্রাকচার’, ‘এসডিপি’ বা ‘জিডিপি’র জটিলতা তাঁরা বোঝেন না। দিনে অন্তত এক বার কলে জল আসুক বা গ্রামের রাস্তায় একটু পিচের আস্তরণ পড়ুক— এমন অকিঞ্চিৎকর, বিন্দু বিন্দু নানা স্বপ্ন নিয়েই আবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবে বিন্দুইডি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy