Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Assembly Election 2021

bengal polls: কয়লা, নতুন মুখের সমীকরণের কঠিন অঙ্ক

একদা এই জেলায় তৃণমূলের কার্যত সর্বেসর্বা ছিলেন জিতেন তিওয়ারি। কিন্তু আচমকাই একদিন শোনা গিয়েছিল বিজেপিতে চলে যাবেন তিনি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
আসানসোল শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪২
Share: Save:

জামুড়িয়া রেলগেট ছাড়িয়ে ডান দিকে ঢুকে গিয়েছে রাস্তা। ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে থমকে গেল গাড়ি। সঙ্গী সহকর্মীর ইঙ্গিত মতো সামনের ঝোপঝাড় পেরিয়ে মাটির ধাপ বেয়ে নামতেই চোখে এল গুহামুখ! নিকষ অন্ধকারে মোবাইলের টর্চ জ্বালতেই বুঝলাম, এ হল খনি! কালো সোনার খনি!

কয়লা ওরফে কালো সোনা! পশ্চিম বর্ধমানের রাজনীতিতে এ হেন সোনার এবং তার কারবারিদের কদর নতুন নয়। কিন্তু বিধানসভা ভোটের সেই মাত্রা যেন সপ্তকে ঠেকেছে। ভোটে উন্নয়ন বনাম মেরুকরণের আঁচে জ্বালানি জোগাচ্ছে সেই কয়লাই!

একদা এই জেলায় তৃণমূলের কার্যত সর্বেসর্বা ছিলেন জিতেন তিওয়ারি। কিন্তু আচমকাই একদিন শোনা গিয়েছিল বিজেপিতে চলে যাবেন তিনি। সে বার অবশ্য যেতে গিয়েও ‘কেন যাব’ বলে ফিরে এসেছিলেন। তার পরেই কয়লা কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম জড়ায় এবং ‘দলে থেকে মনের কথা বলতে না-পারার’ জন্য শিবির বদলে ফেলেন তিনি। বিজেপিও ‘কয়লার কলঙ্ক’ ধুয়ে ফেলে পাণ্ডবেশ্বরে প্রার্থী করেছে জিতেন তিওয়ারিকে। তবে কান পাতলেই পদ্ম-শিবিরে নানা কথা শোনা যায়। পাণ্ডবেশ্বরের এক পার্টি অফিসে কয়লা প্রসঙ্গ তুলতেই অবশ্য হোঁচট খেলেন এক আরএসএস নেতা। তার পর হাসতে-হাসতে শোনালেন, দস্যু রত্নাকরের মহর্ষি বাল্মীকি হয়ে ওঠার মহাকাব্যিক আখ্যান।

জিতেন অবশ্য বিজেপির ক্ষোভের কথা মেনে নিচ্ছেন। বলছেন, “তৃণমূলে থাকার সময় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কাজেই ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তাঁরা আমাকে সব রকমের সাহায্য করছেন।” পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল প্রার্থীকে ‘মাফিয়া’ বলেও কটাক্ষ করছেন তিনি।

পাণ্ডবেশ্বরে জিতেন তিওয়ারির বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে তাঁর দাপটও কম নয়। একদা সতীর্থ জিতেনের সঙ্গে নরেনের (এ নামেই বেশি পরিচিত তিনি) ‘মধুর’ সম্পর্কও সুবিদিত। জিতেনের ‘মাফিয়া’ কটাক্ষ শুনে তৃণমূলপ্রার্থী বলছেন, “এত গরমে ও বোধ হয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। ওর চিকিৎসা প্রয়োজন।” এই লড়াইয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সিপিএমের সুভাষ বাউড়িও রয়েছেন। কিন্তু লড়াইয়ের অভিমুখ যে এখানে কার্যত দ্বিমুখী তা মানছেন সবাই।

দলবদল এবং কয়লার সূত্রেই উঠে আসছে আসানসোল (উত্তর) কেন্দ্রের নাম। জোড়াফুলের প্রার্থী বিদায়ী মন্ত্রী আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী একদা তৃণমূল এবং অধুনা বিজেপি নেতা কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রতিপক্ষের উদ্দেশে তিনি বলছেন, “কোনও ব্যক্তি নয়, লড়াই রাজ্যের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে।” শিল্পাঞ্চলের তৃণমূলকর্মীদের অনেকেই কয়লা, লোহা সিন্ডিকেটের সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুবাবুকে জুড়ে দিচ্ছেন। সেই সুর শোনা যায় জেলার তৃণমূল নেতা ভি শিবদাসনের গলাতেও। তবে কৃষ্ণেন্দুবাবু বলছেন, “২০১৭ সালের পর থেকে নাগাড়ে মামলা করা হয়েছে।” তিনি এও বলছেন, “কয়লা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। আমি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী। ইস্পাত কারখানা থেকে লোহা কিনে ব্যবসা করি। আয়-ব্যয়ের সমস্ত হিসেব রয়েছে।”

অনেকেই বলছেন, এই কেন্দ্রে ভাষা-ধর্মভিত্তিক মেরুকরণের প্রভাব রয়েছে। অবাঙালি ভোটারদের একাংশ গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। পদ্ম-প্রার্থীর কথাতেও তার ইঙ্গিত মেলে। প্রতিপক্ষের ‘অভিযোগের’ পাল্টা বলছেন, “বাঙালি বাড়িতে বিদ্রোহী, একরোখা ছেলেদের নামের আগে নানা বিশেষণ বসানো হয়। কিন্তু অন্য কোথাও হয় না।” তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ লোকেরাও একান্তে মেরুকরণের চোরাস্রোত মেনে নিচ্ছেন। তবে এ-ও দাবি করছেন, সংগঠনের জোর এবং নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্কের জোরেই এগিয়ে রয়েছেন মলয় ঘটক।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই জেলার ৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের সব কটিতেই জিতেছিল বিজেপির ‘লিড’ ছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, পথ বুঝি মসৃণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ বার ভোটের মুখে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে তাঁরাই বলছেন, “দুর্গাপুর বা আসানসোল, কান পাতলেই নানা ক্ষোভ শোনা যাচ্ছে। সাংসদের নামও বারবার আসছে। এই ক্ষোভের প্রভাব ভোটবাক্সে পড়তে পারে।”

গত লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি সব থেকে বেশি ভোটে এগিয়েছিল আসানসোল (দক্ষিণ) কেন্দ্রে। এ বারও সেই আসনে চমক দিয়েছে যুযুধান তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী সায়নী ঘোষ এবং বিজেপির ফ্যাশন ডিজ়াইনার অগ্নিমিত্রা পাল। দুজনেই ভোটে নতুন মুখ। লোকসভায় ৫২ হাজার ভোটের পিছিয়ে থেকে লড়াই করার ‘চাপ’ সায়নীর চোখেমুখে ধরা পড়ে। তবে তারকা ভাবমূর্তি সরিয়ে এলাকা চষছেন তিনি ঘেমেনেয়ে প্রচারের ফাঁকে বললেন, “নেত্রী আমাকে লড়তে পাঠিয়েছেন। আপ্রাণ লড়ে যাব।” আসানসোলের ‘ঘরের মেয়ে’ অগ্নিমিত্রা বলছেন, “জেতার মার্জিন বলতে পারব না। তবে মানুষের প্রবল সাড়া পাচ্ছি।” শোনা যাচ্ছে, এই জেলার কুলটি, বারাবনিতে দু বছরে হারানো জমি অনেকটাই ফিরে পেয়েছে জোড়াফুল। তাতেই কিছুটা স্বস্তি রয়েছে।

পশ্চিম বর্ধমানের এই শিল্পাঞ্চল অবশ্য একদা বামেদের ঘাঁটি ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরেও রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া বামেদের হাতছাড়া হয়নি। কিন্তু সেখানেও গত লোকসভায়
‘লিড’ পেয়েছে বিজেপি। মেরুকরণের কথাও ঘুরপাক খাচ্ছে। দুই কেন্দ্রেই নতুন ও তরুণ মুখ দিয়েছে বামেরা। জামুড়িয়ার সিপিএমের প্রার্থী ঐশী ঘোষ দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া-বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়ে শিরোনামে এসেছিলেন। তবে শ্রমিক-প্রধান জামুড়িয়ায় জেএনইউ-ছাত্রী কতটা প্রভাব ফেলবেন তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। ভোট-প্রচারে অবশ্য সাড়া পাচ্ছেন নতুন মুখ, মাটির মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে তাঁর মুখে। রানিগঞ্জে সিপিএম
প্রার্থী হেমন্ত প্রভাকর বলছেন, “লকডাউন-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের ধারাবাহিক অপদার্থতা মানুষকে নাড়া দিয়েছে। ধর্মের দোকান খুলে ভোট নেওয়া যাবে না।” আসানসোল (দক্ষিণ)-এর তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ বার রানিগঞ্জে পাঠিয়েছে দল। রানিগঞ্জ শহরের তুলনায় অন্ডালের দিকে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী।
তবে দলের অন্দরের খবর, তাপসবাবুর সাংগঠনিক দুর্বলতা চিন্তার কারণ হতে পারে।

২০১৬ সালে দুর্গাপুর থেকে জোটপ্রার্থী হিসেবে জিতে বিশ্বনাথ পারিয়াল চলে গিয়েছিলেন তৃণমূলে। তিনিই এ বার দুর্গাপুর-পশ্চিম কেন্দ্রের জোড়াফুলের প্রার্থী। ডিপিএল কলোনিতে মিছিল শুরুর আগে বিশ্বনাথবাবু বললেন, “আমি দল বদলালেও রং না-দেখে মানুষের জন্য কাজ করেছি। তাই জেতা নিয়ে সন্দেহ নেই।” তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ-মহলে শোনা যাচ্ছে, মিটিং-মিছিল হচ্ছে বটে। কিন্তু লোকের হাবভাব কেমন যেন সন্দেহজনক। ডিপিএল কলোনি, কোক ওভেন কলোনি হয়ে মিছিল করছিলেন বিজেপি প্রার্থী লক্ষ্মণ ঘোড়ুই। জেতার ব্যাপারে ‘নিশ্চিত’ তিনি। বলছেন, “মানুষ আমাদের পাশে আছে।”

দুর্গাপুর (পূর্ব) কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী কর্নেল দীপ্তাংশু চৌধুরী একদা বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছিলেন। এ বার ফিরেছেন বিজেপিতেই। তবে তাঁর এক ভোটারের ঠেস, “বিধানসভা ভোটে তো উনি প্রতিবার বিজেপির হয়েই দাঁড়ান।” বাকি দুই প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন সিপিএম নেতা আভাস রায়চৌধুরী এবং তৃণমূলের প্রদীপ মজুমদার। আভাসবাবু ভোট ময়দানে অপরিচিত মুখ নন। একদা শিল্পনগরী দুর্গাপুরের বেহাল দশার কথা বলছেন তিনি, বলছেন নাগরিক সমস্যার কথাও। উন্নয়নের কথা বলছেন তৃণমূলপ্রার্থীও। তবে রাজ্যের কৃষি-উপদেষ্টা প্রদীপবাবু কতটা ‘মাটির কাছের মানুষ’ তা নিয়ে ধন্দ থাকলেও তৃণমূলকর্মীরা বলছেন, “ভোট তো হবে নেত্রীকে দেখে।”

শিল্পাঞ্চলের ভোট সোজাসাপ্টা পাটিগণিত নাকি সমীকরণের প্যাঁচপয়জার ভর্তি বীজগণিত? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই পশ্চিম বর্ধমানের রাজনীতি নিয়ে পোড়খাওয়া এক ব্যবসায়ী বললেন, “ত্রিকোণমিতিও হতে পারে!”

সত্যিই, অঙ্ক কী কঠিন!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy