খেলার ছলে। আমতায় তুষার শীল। সুব্রত জানার তোলা ছবি।
রোড শো করছিলেন আমতায়। হঠাৎ খড়ের চালার ভিতর থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। ‘‘হ্যাঁ গো বাবা সবাই বলছে যোগ করলে নাকি কোমরের ব্যামো সেরে যাবে। ঘাড়ের ব্যথা সেরে যাবে। একটু দেখো না!’’
থেমে গেল মিছিল। প্রেসক্রিপশন লিখতে বসে পড়লেন তুষার শীল। রোগী বাড়তেই লাগল। কারও গাঁটে ব্যাথা, কারও কোমর-হাত-পা-ঘাড়ের সমস্যা। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন আসনও দেখাতে শুরু করলেন তিনি।
পাঁচ বারের মিস্টার ইন্ডিয়া আর এক বারের এশিয়ার রানার্সের বিড়ম্বনা এখানেই শেষ নয়। ভোটের প্রচারে বেরিয়ে কোথাও অনুরোধ আসছে, ‘‘দাদা আপনার নাম তো প্রচুর শুনেছি। ভারতশ্রেষ্ঠ বডি বিল্ডার। একটু আপনার বাইসেপস, ট্রাইসেপসটা দেখান না!’’ ভোট চাইতে নেমেছেন। মানুষকে নিরাশ করবেন কী করে? স্থানীয় ক্লাবে ঢুকে জামা খুলে দেখাতে হচ্ছে সুঠাম পেশি। কেউ কেউ এই সুযোগে টিপে দেখছেন হাতের গুলি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সঙ্গে তিরিশ বছরের জানাশোনা তুষারবাবুর। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘খারাপ লাগছে না ব্যাপারটা। আমি তো সারা বছর অসংখ্য মানুষকে সুস্থ করে তুলি। কিন্তু সমস্যা হল এটা করতে গিয়ে সময় চলে যাচ্ছে। বিশাল এলাকা, সব মানুষের কাছে যেতে হবে তো!’’ বিপক্ষে তিন বারের বিধায়ক। তাঁকে হারিয়ে তুষার ঘাসফুল ফোটাতে পারবেন কি না বলা কঠিন। তবে তুষার মানছেন, ভোটে এটাই তাঁর প্লাস পয়েন্ট। ‘‘আমাকে নতুন করে চেনাতে হচ্ছে না নিজেকে। না হলে নতুন মঞ্চে লড়তে নেমে সমস্যা হতো।’’
সমস্যা তো হচ্ছেই এক কালের ডাকাবুকো মিডিও-র। ‘‘আরে কী বলব দাদা! এর চেয়ে আসিয়ান কাপে চাইম্যানকে হারানো সহজ ছিল। ঘরের মধ্যে পঞ্চাশ জনের মিটিং করে মিছিল শুরু করছি। কিছুটা এগিয়ে পিছন ফিরে দেখি দু’জন ছাড়া কেউ নেই,’’ বলছিলেন ষষ্ঠী দুলে। ধনেখালির বিজেপি প্রার্থী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘টাকা ছাড়া কোনও কাজই হচ্ছে না। নমিনেশন পাওয়ার পর আমাদের দলের এক মণ্ডল সভাপতির বাড়ি গেলাম। সে বলল, আগে একটা নতুন কম্পিউটার দাও, তার পর কথা। তোমার জন্য কত চিঠি লিখতে হবে জানো!’’
সত্যিই কাহিল অবস্থা ষষ্ঠীর। জাকার্তায় আসিয়ান কাপের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল কোচ সুভাষ ভৌমিক তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ওদের চাইম্যানকে আটকাতে পারবি?’’ অকুতোভয় ষষ্ঠী জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘লোকটাকে চিনিয়ে দিন। ইংরেজি জানি না। পিঠের নাম পড়তে পারব না। নম্বরটা শুধু বলুন।’’ তেরো বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার মাঠে নেমে ষষ্ঠী বলেছিলেন, ‘‘ইউ চাইম্যান, আই ষষ্ঠী। ইউ জিরো, আই হান্ড্রেড।’’ বিপক্ষের সেরা ফুটবলারকে হেলায় আটকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ষষ্ঠী নতুন মাঠে এত অসহায় কেন? ‘‘কেন আবার? চাইম্যানকে তো সামনে পেয়েছিলাম। এখানে সবাই পিছনে থেকে খেলছে। এখানে প্রদীপদা-সুভাষদার ভোকাল টনিকে কোনও কাজ হয় না। টাকাই টনিক,’’ বললেন হরিপালের ‘চাষার ব্যাটা’। নিজেদের জমিতে এখনও দাদাদের সঙ্গে ধান-কপি-লঙ্কা চাষ করেন তিনি।
ফুটবলের আর এক তারকা রহিম নবির সমস্যা আবার অন্য। জনসভায় উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেমসাইড করে বসে আছেন। প্রচারে বেরিয়ে পায়ে বল নাচাচ্ছেন। হেড করছেন ঘাড় হেলিয়ে। ‘পাবলিক’-এর অনুরোধে চড়া রোদে নেমে পড়তে হচ্ছে মাঠেও। সঙ্গে সেলফি তোলার আবদার তো আছেই। ‘‘শুধু যা সেলফি তুলেছি দেড় মাসে, তারা ভোট দিলেই জিতে যাব,’’ পান্ডুয়ার বৈঁচি গ্রামে রোড শো করতে করতে বললেন তৃণমূল প্রার্থী। পনেরো বছর খেলেছেন কলকাতার তিন বড় ক্লাবে। কিন্তু হারা সিটে লড়তে নেমে পান্ডুয়ার ভূমিপুত্র কোনও হিসাবই যেন মেলাতে পারছেন না। ‘‘কত নামকরা টিমের সঙ্গে খেলেছি। কখনও টেনশন হয়নি। ভোটে নেমে দেখছি কে পক্ষে, কে বিপক্ষে বুঝতে বুঝতেই ম্যাচ শেষ।’’ প্রচারগাড়ি এগিয়ে চলে। জাতীয় বা ক্লাব স্তরে মিশুকে ছেলে বলে পরিচিত নবি ভোট ভিক্ষা করতে করতে বলেন, ‘‘মাঠে দু’টো কাজ করতে হয়। গোল আটকানো এবং গোল দেওয়া। এখানে পিছন থেকে কে ছুরি মারছে নজর রাখতে হচ্ছে।’’
এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে মোট সাত জন ক্রীড়াবিদ ভোট দাঁড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে তিন জন—জ্যোতির্ময়ী শিকদার, ভাইচুং ভুটিয়া এবং দীপেন্দু বিশ্বাস নির্বাচনে নতুন নন। সোনারপুর উত্তরে সিপিএম প্রার্থী এশিয়াডের জোড়া সোনাজয়ী জ্যোতিমর্য়ী আগে কৃষ্ণনগরের সাংসদ ছিলেন। তৃণমূলের ভাইচুং এবং দীপেন্দুর তো জায়গাও বদলায়নি। যেখানে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন সেখানেই ফের ‘গোল’-এর সন্ধানে তারা। বসিরহাট দক্ষিণে তৃণমূল প্রার্থী দীপেন্দু বলেই দিলেন, ‘‘সতেরো মাস আগে দিদি মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। সব চেনা। প্রচুর প্র্যাকটিস করেছি। মাঠে দু’শোর উপর গোল আছে। তবে এই গোলটা করতে অনেক বেশি পরিশ্রম।’’
লক্ষ্মীরতন শুক্লর কাছে কিন্তু রাজনীতির পিচ আর গ্রিন টপ উইকেট দু’টোই সমান মনে হচ্ছে। ‘‘পাটা উইকেটে পিচটা তবু বোঝা যেত। গ্রিন টপে সেটা নেই। মাটি বোঝা ডিফিকাল্ট। রাজনীতির মতোই।’’ একশো রঞ্জি ম্যাচ খেলে রেকর্ড গড়া লক্ষ্মীর গলায় টেনশন নেই। ‘‘আরে টেনশন করলেই তো নার্ভাস সিস্টেম ব্রেক। গ্রিন টপ উইকেটে ৩০-৪ অবস্থা থেকে ১০০ রান করে বাংলাকে জিতিয়েছি। সেই মনোভাব নিয়েই ঘুরছি।’’ হাওড়া দক্ষিণে তাঁর মতোই তারকা প্রার্থী রয়েছেন প্রতিপক্ষ শিবিরে। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। লড়াই প্রতিদিন কঠিন হচ্ছে। সামাল দিতে ঘুসুড়ির চোস্ত ছেলেকে শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল পায়েও নেমে পড়তে হচ্ছে। হাওড়ার পিলখানা বা ফকির বাগানের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বাইশ বছর খেলছি। ইডেন বা হাওড়া যেখানেই খেলবেন টিম গেম চাই। বাংলার হয়ে খেলার সময় যেমন বলতাম, চলো সবাই মিলে লড়াই করি। এখানেও তাই বলছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy