একেই বাম-কংগ্রেসের বোঝাপড়া নির্বাচনের আগে উদ্বেগে রেখেছে শাসক দলকে। এ বার শাকের আঁটির মতো ঘাড়ে চাপল ‘স্টিং অপারেশন!’ যেখানে গোপন ক্যামেরায় তোলা ছবিতে ঘুষ-বিতর্কে নাম জড়িয়ে গেল তৃণমূলের প্রথম সারির এক ঝাঁক নেতা-নেত্রীর।
সোমবার দিল্লির প্রেস ক্লাবে ‘নারদ নিউজ’ নামে একটি ওয়েব পোর্টালের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে। ফুটেজের সত্যাসত্য আনন্দবাজার সংস্থার পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই ছবিকে কেন্দ্র করেই উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলার রাজনৈতিক ময়দান। পোর্টালের দেওয়া ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতারা টাকার বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ওই পোর্টালের প্রতিনিধিরা একটি নকল সংস্থার নাম করে ওই টাকা তুলে দিচ্ছেন তাঁদের হাতে। গোপন ক্যামেরায় তোলা ফুটেজে মুকুল রায়, সৌগত রায়, সুলতান আহমেদ, শুভেন্দু অধিকারী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ছবি দেখা গিয়েছে। তাঁরা সকলেই অবশ্য ভিডি়ওটি ‘জাল’ বলে দাবি করেছেন।
নারদ নিউজের পক্ষ থেকে ম্যাথু স্যামুয়েল এ দিন দাবি করেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে এ বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এই স্টিং অপারেশনটি চালানো হয়েছে। সারদা-কাণ্ডের পরেই আমরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হই। আমাদের কাছে সব মিলিয়ে ৫২ ঘণ্টার ফুটেজ রয়েছে। যার মধ্যে আজ ২৪ মিনিটের ভিডিও জনসমক্ষে আনা হয়েছে।’’ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা। এই স্টিং অপারেশনে মোট ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে এবং কেরলের এক ব্যবসায়ী সেই টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন স্যামুয়েল। টাকার উৎস বা এ বিষয়ে যে কোনও তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত বলেও দাবি করেছেন তিনি।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশ সুপার সৈয়দ হোসেন মির্জা দাবি করছেন, তিনি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের খুব কাছের লোক। এবং দলের হয়ে টাকা তোলেন। মির্জার সূত্র ধরে প্রতিনিধিরা পৌঁছচ্ছেন মুকুলের কাছে। ঘুম ভাঙা চোখে মুকুল প্রতিনিধিদের জানাচ্ছেন, মির্জাকে তাঁর সব বলা রয়েছে। ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে হবে। ফুটেজে শোনা যাচ্ছে মুকুল বলছেন, ৬এ এলগিন রোডে তাঁর দফতরে গিয়ে তাঁর লোককে টাকা দিতে হবে। ওই দফতরে তল্লাশির কারণে টাকা দেওয়ার ছবি তোলা যায়নি বলে জানিয়েছে পোর্টালটি।
কিন্তু টাকা হস্তান্তরের ছবি দেখানো হয়েছে মন্ত্রী সুব্রতবাবু, মদনবাবু, সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার, সুলতান আহমেদ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগতবাবু, মেয়র শোভনবাবুর মতো বর্ষীয়ান নেতাদের ক্ষেত্রে। ভিডিও আরও দেখাচ্ছে, পাঁচ লক্ষ টাকা হাতে নিতে চাননি মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি)। হাতকাটা গেঞ্জি পরে চেয়ারে শরীর এলিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায়, তিনি যদি এত কম টাকার কাজ করেন, তা হলে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কী করবে! ববির নির্দেশে এক তলায় নেমে এসে পোর্টালের প্রতিনিধি তাঁর এক কর্মীর হাতে ওই টাকা তুলে দেন।
এই ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে আসামাত্র সরব হয়েছে বিরোধীরা। পনেরো বছর আগে এমনই স্টিং অপারেশনে বিজেপির তদানীন্তন সর্বভারতীয় সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণের নাম উঠে আসার পরে প্রতিবাদ হিসেবে কেন্দ্রের এন়ডিএ মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছিলেন মমতা। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন বিরোধীরা। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ দাবি করে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘যত ক্ষণ না ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তত ক্ষণ নির্বাচন স্থগিত রাখা যেতে পারে। দরকারে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা যেতে পারে।’’ আর ভিডিও ফুটেজ সিবিআইয়ের কাছে পাঠানোর কথা জানিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের দাবি, যাঁদের ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের যেন ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়া হয়।
বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে এই স্টিং অপারেশন সামনে আসায় হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের অন্দরেও। প্রকাশ্যে অবশ্য গোটা ঘটনাটাকেই ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন দলের নেতারা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মুকুলবাবু সাংবাদিক বৈঠক করে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘২০১৪ সালে স্টিং অপারেশন হয়ে থাকলে এখন বিধানসভা ভোটের মুখে সেটা প্রকাশ করা হল কেন?’’ তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের দেওয়া বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, ‘‘বিরোধীদের এটাই বলতে চাই যে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করুন। নোংরা খেলার আশ্রয় নেবেন না।’’ পরে শিলিগু়ড়িতে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জোট ঘোঁট করে কোনও লাভ হচ্ছে না। তাই এখন কুৎসায় নেমেছে।’’ সংশ্লিষ্ট পোর্টালের বিরুদ্ধে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলা করতে হবে বলেও দলকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যা শুনে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘দেরি করছেন কেন? চ্যালেঞ্জ করুন না! মুখ্যমন্ত্রীকে স্বীকার করতে হবে তাঁর দল চোর-ডাকাত, লুঠেরা, আলিবাবার চল্লিশ চোরের দল!’’
তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের বিদ্ধ করে গোপন ক্যামেরার ছবি প্রকাশ্যে এসেছে ১৪ মার্চ। ‘নন্দীগ্রাম দিবস’ হিসাবে যে দিনটি তৃণমূলের কাছে অন্য রকম তাৎপর্যের। আরও সমাপতন, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে নন্দীগ্রামেরই সিপিআই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের টাকা নেওয়ার ছবি ধরা পড়েছিল সাংবাদিক শঙ্কুদেব পণ্ডার গোপন ক্যামেরায়! অধুনা তৃণমূল নেতা সেই শঙ্কুরও উল্লেখ আছে নারদ নিউজের প্রতিবেদনে!
প্রকাশ্যে পাল্টা চ্যালেঞ্জের পথে গেলেও যে ভাবে শীর্ষ নেতাদের নাম জড়িয়েছে, তাতে যথেষ্ট অস্বস্তিতে তৃণমূল শিবির! যদিও দলের এক শীর্ষ নেতার দাবি, ‘‘এ দেশে দুর্নীতির ঘটনা শুধু শহরের ভোটারদের প্রভাবিত করে। গ্রামে ততটা প্রভাব ফেলে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy