(বাঁ-দিক থেকে) চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
সকাল আটটা। যশোর রোডে গাড়ির ভিড় শুরু হয়েছে। বারাসতে শেঠপুকুরের পাশে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কয়েকটা গাড়ি, যেমন থাকে। তারই একটিতে সকলের অগোচরে বসে আছেন এক জন, যিনি রাজনীতিক নন। কিন্তু, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভোট-রাজনীতির কঠিন পরীক্ষা দিতে চলেছেন।
একটু দূরে তৃণমূলের রোড-শো শুরু হওয়ার প্রস্তুতি। বেলুন উড়িয়ে, ব্যান্ড বাজিয়ে চলছে শোভাযাত্রাকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা। আর গাড়িতে বসে টলিউডের এক সময়ের নায়ক চিরঞ্জিত বলছেন, ‘‘জিতব, এ বার আরও বেশি ভোটে জিতব।’’ বারাসতে ভোটের অঙ্কে বল এখন কার্যত চিরঞ্জিতের পেনাল্টি বক্সে। লোকসভা ভোটের নিরিখে এই কেন্দ্রে মাত্র সাড়ে তিন হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। পুরসভার ৩৫টি ওয়ার্ডের ২৭টিতেই বিজেপির থেকে পিছিয়ে তারা। তা হলে এত আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে? আর বিরোধীরা তো বলেই বেড়াচ্ছে, হারবেন ভেবেই ক’দিন আগে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা বলেছিলেন চিরঞ্জিত। হেসে প্রার্থী বললেন, ‘‘বলেছিলাম তো, ভোটে দাঁড়াব না। কারণ, আমার বয়স হয়েছে। রাজনীতির লোক নই, আমি সংস্কৃতি জগতের মানুষ। সেখানেই ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, আপনাকে লড়তে হবে। এতেই তো বোঝা যাচ্ছে, মানুষ আমাকে চাইছেন।’’ সঙ্গে বিজেপিকে পাল্টা আক্রমণ, ‘‘ওরা আগে জিতুক। তার পরে এ সব কথা বলবে। এই ধরনের কথা বলার যোগ্যতাই ওদের নেই।’’
বিজেপি থেকে বাম— একটাই প্রচার। গত দশ বছরে এলাকার মানুষ কাছে পাননি টলিউডের নায়ককে। এ বার জেতালে তিনি যে পাশে থাকবেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? কৃষ্ণনগর রোডে দলের নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে বিজেপি প্রার্থী শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘উনি তো এলাকাতেই আসেন না। বিধায়ককে না পেয়ে মানুষ সুখ-দুঃখের কথা আমাদেরই বলছেন।’’ হাসিমুখে জবাব দিলেন চিরঞ্জিত। ‘‘একটাই তো অভিযোগ! তার পরেও মানুষ বার বার আমাকে জেতাচ্ছেন। ফলে বোঝা যাচ্ছে, অভিযোগটা সাধারণ ভোটারদের নয়, বিজেপির।’’ পাশে বসা বারাসত পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুনীল মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘বারাসতে কোনও কাজ তো আটকায়নি। আমি হাজির থাকিনি সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমন এটাও সত্যি যে, এলাকার উন্নয়নে আমাদের নেতারা মানুষের পাশে রয়েছেন।’’ দূরে রোড-শোয়ের প্রস্তুতি সারছেন বারাসত তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অশনি মুখোপাধ্যায়। বারাসতে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ বহু দিনের। কিন্তু চিরঞ্জিতকে সামনে রেখে সেই সংঘাত চোখে পড়ছে না। অশনিবাবু বলেন, ‘‘বিজেপি হারবে। কোনও অঙ্ক কাজ করবে না। কারণ, এ বারের ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেতানোর ভোট। বারাসতে বিজেপি থাকবে তিনে, সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীরও পরে।’’
এক নজরে
এখানকার বিজেপি প্রার্থী শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় উত্তর ২৪ পরগনায় দলের জেলা সভাপতি। নিজের কেন্দ্রে তিনি অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। কারণ, গত বিধানসভা ভোটে চিরঞ্জিত প্রায় ২৫ হাজার ভোটে জিতলেও লোকসভায় সেই ব্যবধান কমিয়ে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেছে বিজেপি। ২০১৬-র বিধানসভায় ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী প্রায় ৭৫ হাজার ভোট পেয়ে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। কিন্তু লোকসভা ভোটে বারাসত বিধানসভা এলাকায় সেই অঙ্ক পাল্টে গিয়েছিল। বামেদের ভোট গিয়েছিল পদ্ম শিবিরে। বাম-কংগ্রেস মিলিয়ে লোকসভায় পেয়েছিল ৩৮ হাজারের কাছাকাছি ভোট। অর্থাৎ, অর্ধেক ভোট কমেছিল তাদের।
চলতি ভোটে সেটাই আশা পদ্ম শিবিরের। কিন্তু লোকসভা আর বিধানসভা ভোটের চরিত্র আলাদা। বাম প্রার্থী শক্তিশালী হলে সেই মানুষগুলি ফিরেও তো আসতে পারেন পুরনো ছাতার নীচে? হাসছেন বিজেপি প্রার্থী। শঙ্করবাবুর সহজ জবাব, ‘‘যা যায়, তা কি ফেরে?’’ তাঁর দাবি, আমপানে দুর্নীতি, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে কাটমানির জবাব দেবেন মানুষ। সঙ্গে মোদী-হাওয়া।
তবে বিজেপি প্রার্থীর পায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধছে দলেরই একটি অংশ। আদি বিজেপির ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে প্রার্থী তালিকায়। পোস্টারে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ছেপে, জনসঙ্ঘ পার্টির প্রার্থী হিসেবে ময়দানে নেমেছেন সুদর্শন দাস। তাঁর প্রতীক ‘ডিশ অ্যান্টেনা’। সেই অ্যান্টেনা অবশ্য বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে না। কারণ, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অস্বস্তি বাড়াতে চাইছেন না তিনি। বিজেপির মতো দলে কেন এমন ঘটনা, প্রশ্ন করলে শঙ্করবাবু তাকিয়ে থাকছেন উপরে ঘুরে চলা ফ্যানের দিকে।
দুই শিবিরের লড়াইয়ের মধ্যে মাঠে নেমেছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী, ফরওয়ার্ড ব্লকের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। বারাসত এক সময়ে ছিল তাঁদের শক্ত ঘাঁটি। গত বিধানসভা ভোটেও বামেদের ভোট ছিল তৃণমূলের পরেই। কিন্তু বিজেপির দ্রুত উত্থান সেই ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এ বার হারিয়ে যাওয়া ভোট ফিরিয়ে আনার মরিয়া চেষ্টায় সঞ্জীব। করোনা আর আমপানে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাম কর্মীরা। সেটাই ভরসা প্রার্থীর। সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর দল আইএসএফ। সঞ্জীব বলছেন, ‘‘এত দিন ছোটজাগুলিয়ার মতো সন্ত্রাস কবলিত অঞ্চলে পৌঁছতেই পারছিলাম না। আইএসএফের সহযোগিতায় সেই জায়গা এখন মুক্তাঞ্চল।’’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাংশ পাশে থাকবেন, এটাই আশা তাঁর।
বারাসতে যেমন প্রাক্তন নায়কের অগ্নিপরীক্ষা, পাশের কেন্দ্র মধ্যমগ্রামে তেমনি টলিউডের এক অভিনেত্রীর পরীক্ষা ভোট রাজনীতিতে প্রবেশের। সেখানে বিজেপির প্রার্থী অভিনেত্রী রাজশ্রী রাজবংশী। তাঁর বিপরীতে এলাকার ১০ বারের বিধায়ক, তৃণমূলের রথীন ঘোষ। বহু বছর পুর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত রথীনবাবুর দাবি, ‘‘দল দেখে নয়, কাজ করেছি জনপ্রতিনিধির ধর্ম নিয়ে। সে কারণেই বার বার মধ্যমগ্রামের মানুষ জোড়াফুলকে চেয়ে এসেছে।’’ বস্তুত, ২০১১ থেকে প্রতিটি ভোটে জোড়াফুল ব্যবধান বাড়িয়ে এসেছে মধ্যমগ্রামে। তৃণমূল প্রার্থী বলেন, ‘‘২০১১ সালে ৩৫ হাজার, ২০১৬-তে ৩৬ হাজার আর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ৩৭ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলাম। ফলে জয় নিয়ে সংশয় নেই।’’
তবে এ বার বিজেপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে ভিড় হচ্ছে যথেষ্ট। যদিও রাজশ্রীর অভিনেত্রী ভাবমূর্তির প্রভাব আলাদা করে পড়ছে না। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিব শিকদার বলেন, ‘‘রাতে মাঝে মাঝে ইউটিউবে সিনেমা দেখি। তবে ওঁর নাম আগে শুনিনি।’’
রথীনবাবুর প্রশ্ন, ‘‘দলে যোগ দেওয়ার কয়েক দিন পরেই যিনি প্রার্থী হলেন, তাঁর পক্ষে এলাকার সমস্যা বোঝা সম্ভব?’’ তবে এটাও ঘটনা, পদ্মের সভাগুলিতে ভিড় হচ্ছে। মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় বিজেপির নির্বাচনী দফতরে প্রায় উৎসবের পরিবেশ। এক দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, প্রার্থীর ঘর বন্ধ করে দলের নেতারা বৈঠকে বসেছেন। আর অভিনেত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরের বাইরে। দলে সদ্য যোগ দেওয়া প্রার্থী বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করবেন।
ঘাসফুল ও পদ্মকে টক্কর দিতে সংযুক্ত মোর্চা মধ্যমগ্রাম আসনটি ছেড়েছে আইএসএফ-কে। এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৭৪ হাজার। ভোটে বরাবর তৃণমূলের পাশে থেকেছেন তাঁরা। এ বার সেই দুর্গে ভাঙন ধরাতে চাইছে সিদ্দিকীর দল। বিজেপি তাকিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগির দিকে। তৃণমূলের অবশ্য দাবি, উন্নয়নের জোরেই দুর্গ অটুট রাখবে তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy