গাড়ির ভিতরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল উঁচিয়ে থাকা বন্দুকের নল। ইনস্যাস, এসএলআর নিয়ে ইস্পাত কঠিন মুখে জনা চার-পাঁচ। চালকের পাশে বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম আর তাঁর পিছনের আসনে বংশীবদন মাহাতো— বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি। বংশীবদনের জন্যই আট বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষীর সরকারি বন্দোবস্ত।
জঙ্গলমহল যখন মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী ‘হাসছে’, তখন নিরাপত্তার এই ঘনঘটা কেন? বংশীবদন ঢোঁক গিলে বলেন, ‘‘প্রশাসন মনে করেছে, আমার নিরাপত্তা দরকার। কী করব?’’
প্রশাসন মনে করেছে, স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের উপরে চোরাগোপ্তা হানা দেওয়ার শক্তি এখনও রাখে প্রয়াত কিষেণজির শিষ্যেরা। খবর আছে, বেলপাহাড়ির লালজল-পাটাঘরের কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা সম্প্রতি দেখেছেন জনা তিরিশ মাওবাদীর একটি দলকে।
বেলপাহাড়ির ওই তল্লাট ধরে মাওবাদীরা তৃণমূল-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, বাঁকুড়ার মহিষামুড়া, হিজলির মতো গ্রামে। সরাসরি ভোট দিতে বলছে বামেদের। ভোটের মুখে তাদের এই আনাগোনায় শাসক দলের নেতাদের নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘুরতে হলেও জঙ্গলমহলের আমজনতার সকলেই ভয় পাচ্ছেন কি?
বেলপাহাড়ির পাথরচাকরি গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব সূর্য সিংহের গলায় অদ্ভুত দৃঢ়তা, ‘‘মানুষ শান্তি চেয়েছিল। সেটাই এসেছে। তা হলে এখন মাওবাদীদের কথা কেন শুনব?’’ মহিষামুড়ার ধুবল তাঁতি বলছেন, ‘‘বনপার্টি (মাওবাদী) যতই যা বলুক, এত তাড়াতাড়ি আর একটা পরিবর্তনের দরকার নেই।’’
অথচ, রাজা-রানি পাহাড় ঘেঁষা মহিষামুড়া গ্রামের ভিতরে রাস্তা এখনও কাঁচা, বর্ষা মানেই এক হাঁটু কাদা। একটা মাত্র নলকূপ, সেটাও গ্রীষ্মে বসে যায়। তখন জল বয়ে আনতে এক কিলোমিটার উজিয়ে পাশের গ্রাম বালিজুড়িয়ায় যেতে হয়। গ্রামে এ বছর এক দিনও হয়নি একশো দিনের কাজ। ধুবলবাবুর দাদা সুবল তাঁতিকে পুলিশের চর সন্দেহে ছ’বছর আগে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে খুন করে মাওবাদীরা। ওই পরিবার কেন্দ্রের তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ছাড়া, রাজ্য সরকারের কোনও সাহায্য পায়নি। তার পরেও পরিবর্তন চান না? ধুবল বলছেন, ‘‘ঘরে শান্তি ফিরিয়েছে তৃণমূল সরকার। এটা অনেক বড় কথা।’’
বামেদের কাছে এই শান্তির অন্য ব্যাখ্যা আছে। সিপিএম নেতা অমিয় পাত্র বলেন, ‘‘এক সময়ে জঙ্গলমহলে মাও-তৃণমূল যুগলবন্দি ছিল। পরিবর্তনের আগে যারা খুনখারাপি করত, তাদের অনেকে এখন ভিড়েছে তৃণমূলে। অশান্তি কমবে না কেন?’’
বিরোধীরা মনে করাচ্ছেন, ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ‘আত্মসমর্পণ’ করে পুনবার্সনের প্যাকেজ পাওয়াদের তালিকায় নিখাদ তৃণমূল কর্মীর নাম থাকার অভিযোগ উঠেছে। তবে তৃণমূল সরকার জঙ্গলমহলকে টানা যৌথ বাহিনীর নজরদারিতে রাখায় মাওবাদী উপদ্রব যে কমেছে, তা-ও মেনেছেন অনেক বাম নেতা।
গত বছর পাঁচেক মাওবাদী-হিংসা বন্ধ থাকা যদি তৃণমূলের তূণে একটি অস্ত্র হয়, আরও শানানো হাতিয়ার তবে দু’টাকা কেজির চাল।
বারিকুলের খেজুরখেন্না গ্রামের শম্ভু পাল, মালতী পালদের বক্তব্য, ‘‘বৃষ্টির অভাবে তিন বছর মাঠের ধান মাঠেই পুড়েছে। দু’টাকা কেজির চালটা পাচ্ছি বলেই বেঁচে আছি।’’ এই খেজুরখেন্না গ্রামেই বাড়ি মাওবাদীদের রাজ্য মিলিটারি কমিশনের সদস্য রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলের, যিনি ফেরার। তাঁর ছোট ভাই হরিপদ পালও বলেন, ‘‘দু’টাকা কেজির চালটা পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত। সেই জন্য তৃণমূলের প্রভাবটাই বেশি দেখা যাচ্ছে।’’
জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের একাংশ দিচ্ছেন সেই ‘প্রভাব’-এর ব্যাখ্যা। তাঁদের বক্তব্য, বাম আমলে ২০০৯-এ জঙ্গলমহলের আদিবাসী প্রভাবিত এলাকাগুলিতে দু’টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু সে ব্যবস্থায় নানা সমস্যা ছিল। চালের মান ও অনিয়মিত সরবরাহ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। ২০১১-র জুলাইতে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই চাল জঙ্গলমহলের আদিবাসী-অনাদিবাসী, বিপিএল-এপিএল— সবার জন্য বরাদ্দ করেন। ২০১২ সালে লালগড়ে গিয়ে চালের মান নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তার পর থেকে চালের মান নিয়ে সমস্যাও মেটে।
এক মত হচ্ছে এক সময় মাওবাদীদের ডেরা বেলপাহাড়ির শিমুলপাল পঞ্চায়েতের গ্রাম শাঁখাভাঙা। গ্রামে ঢোকার রাস্তা কার্যত নেই, একটা নলকূপ অকেজো, গ্রামের এক জন যুবকও পুলিশ বা সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি পাননি। বামফ্রন্ট আমলের মতো পরিবর্তনের জমানাতেও এই গ্রাম অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। তা হলে কি মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ডাক দিলে বা বিরোধীদের ভোট দিতে বললে শাঁখাভাঙা সাড়া দেবে? হাঁ হাঁ করে ওঠেন সিংরাই সরেন, দুলাচাঁদ সরেন, দুলারি মুর্মুরা, ‘‘কী বলছেন, দু’টাকা কেজি চাল দিয়ে যে সরকার পেট ভরাচ্ছে, তাকে ভোট দেব না?’’
পালাবদলের পরও যেখানে মাওবাদীরা তিনটি খুন করেছিল, পুরুলিয়ার বলরামপুরের সেই ঘাটবেড়া-কেরোয়ার দুখু সিংহ, সতীশ রজকেরাও জানান, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের বুথে এ বার ভোট পড়বে। ২০১১-র মতো মাওবাদী হুমকিতে ভোট বয়কট হবে না। তাঁদের যুক্তি—‘‘এই সরকার ঠিকঠাক চাল দিচ্ছে যে!’’
‘‘দু’টাকা কেজির চাল তো আমাদের আমলে দেওয়া শুরু হয়েছিল’’— দাবি করেন জঙ্গলমহলের বাম নেতারা। জোড়েন, ‘‘তখন থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকিও আছে।’’ অথচ, সেই নেতারাই মানছেন, তাঁদের আমলের তুলনায় জঙ্গলমহলের আরও বেশি সংখ্যক বাসিন্দার কাছে চাল পৌঁছে দিয়েছে তৃণমূল।
নামমাত্র দামের ওই চাল যে শাসকদলের কাছে মাওবাদীদের বন্দুকের নল ঠেকানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মানছেন বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা অমিয়বাবু। বলছেন, ‘‘আমরাও এই চাল দিতাম, আর কেন্দ্রও চালের জন্য ভর্তুকি দেয়—এটা আমরা ভোটারদের বোঝাতে না পারলে তৃণমূলের সুবিধে।’’
ভ্রম সংশোধন: বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার পত্রিকার পাঁচের পাতায় ‘পক্ষে মাওবাদী প্রচার, মুখে এখন খই ফুটছে সিপিএমের’ শীর্ষক খবরে সিপিএমের রানিবাঁধ জোনাল কমিটির সম্পাদকের নাম লেখা হয়েছে গুরুপদ মাহাতো। ওই পদে রয়েছেন মধুসূদন মাহাতো। সংশ্লিষ্ট বক্তব্যও তাঁর। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
(সহ-প্রতিবেদন দেবমাল্য বাগচী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy