বৈশাখের দুপুরে এমুড়ো থেকে ওমুড়ো চষে বেড়াচ্ছে নীল-সাদা টুকটুক। মাথার উপরে দু’দিকে মুখ করে বসানো চোঙা। নাগাড়ে বেজে চলেছে রেকর্ড—‘আর মাত্র একটা দিন। তারপরেই আসছে শুভশ্রী...শুভশ্রী...শুভশ্রী...।’
টুকটুক ঢুকে পড়েছে অন্য পাড়ায়। কিন্তু ‘ইকো’র কেরামতিতে এ পাড়াতে তখনও শুভশ্রীর রেশ থেকে গিয়েছে। গোলায় গোবর লেপা থামিয়ে দিয়েছে গাঁয়ের বউ। আঁশের বঁটি ফেলে একছুটে সদর দরজার দিকে ছুট দিয়েছে দত্তবাড়ির কাজের মেয়ে। রোয়াকে বসা ছেলের দল তাস উল্টে কান খাড়া করে আছে। চণ্ডীমণ্ডপের চাতালে বসা ভিড়টাতেও শুরু হয়েছে গুঞ্জন। দাদা গোছের একজন আবার বেমক্কা টুকটুক থামিয়ে জানতে চেয়েছে—‘কী রে, সঙ্গে দেবও আসছে?’
নাহ্, ডোমকলে এখনও দেব আসেননি। তবে নদিয়ায় এসেছে। সোমবার বিকেলে করিমপুরে এসেছেন সোহম, হিরণ। আগের দিন ঘুরেছেন তেহট্টে। রানাঘাটে এ দিন এসেছেন আমিশা পটেল। দিনকয়েক আগে শান্তিপুরে ঘুরে গিয়েছেন নাগমা। ডোমকলে ঢুঁ মেরে গিয়েছেন পায়েল, রাজ বব্বর। শতাব্দী ঘুরছেন দু’জেলাতেই। ভোটের বাজারে মাইক মাথায় পাড়া গরম করছে টুকটুক কিংবা মারুতি ভ্যানও। কোনওদিন, ‘আর একটু পরেই রোড শো করবেন হিরণ, সোহম’। কোনওদিন আবার রেকর্ড বদলে, ‘বলিউডের সেই দুষ্টু-মিষ্টি নায়িকা আমিশা পটেল...।’ ঘোষণার ফাঁকে ফাঁকে ‘কহো না প্যার হ্যায়’ ও ‘গদর’ সিনেমার গান।
প্রচারের তোড়জোড় দেখে কে বলবে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে ৪০ থেকে ৪৪ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে পারদ। ভোটের ময়দানে তারারা এর আগেও এসেছে। কিন্তু পাড়ার মোড়, তস্য গলিতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন শুভশ্রী, শুভম। নাহ্, মনে করতে পারছে না পড়শি দুই জেলা। তবে হ্যাঁ, মাইকে নিয়ে গাঁ-গঞ্জে এমন প্রচার হয় শীতকালে। সাতসকালে গ্রামের মেঠোপথ ধরে বেরিয়ে পড়ে প্রচারের গাড়ি। পৌষ-মাঘের মিঠে রোদে ধুলো উড়িয়ে মাইকে তারস্বরে প্রচার চলে— ‘সংগ্রহ করুন সিজন কার্ড, চেয়ার কার্ড, জমিন টিকিট...। মহিলাদের বসিবার ও সাইকেল রাখিবার সুব্যবস্থা আছে।’ খেতের ফসল ঘরে উঠে যায়। নেড়া মাঠ সমান করে তৈরি হয় প্যান্ডেল। কুয়াশা ভেজা হিমেল রাতে আলো-আধারি মঞ্চে নেমে আসে তারা।
কিন্তু সে তো নাইট-উৎসব! পয়সা লাগে। তারাদের দেখতে হয় অনেক দূর থেকে। ঝক্কিও বড় কম নয়। কিন্তু এখন? সে সবের বালাই নেই। মঞ্চে উঠে দেব হাত নাড়ছেন। চারদিকে রব উঠছে—পাগলু...পাগলু। চড়া রোদে পরাণ জ্বালিয়ে দিয়ে হুডখোলা জিপে ঘুরছেন শুভশ্রী, নাগমা, পায়েল। ভিড়ের মধ্যে থেকে মহিলারা বলাবলি করছেন—‘দেখেছিস, কী কালার!’ সেই সঙ্গে টলি-বলির সেই তারাদের সঙ্গে হাত মেলানো যাচ্ছে। তোলা যাচ্ছে সেল্ফিও।
ডোমকলের এক কলেজ পড়ুয়া বলছেন, ‘‘বলুন তো, এটা কি কম কথা! যাঁদের দেখার জন্য আগাম টিকিট কাটতে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিনেমা হলের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়, সেই তাঁরাই এখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরছেন! মাঝেমধ্যে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না।’’ করিমপুরের এক মহিলার কথায়, ‘‘কোন দলের হয়ে ওঁরা প্রচারে এসেছেন, প্রার্থী জিতবে না হারবে সেটা বড় কথা নয়। এত কাছ থেকে সোহম, হিরণকে দেখব, বিশ্বাস করুন, ভাবতেই পারিনি!’’
তারাদের আসার খবরে শুধু যে এলাকায় ভিড় হচ্ছে তাই নয়। আত্মীয়েরাও ছুটে আসছেন তারা-দর্শনে। দিনকয়েক আগে মোমিনপুরে এসেছিলেন হিরণ, শতাব্দী রায়। তাঁদের দেখতে মোমিনপুরের আত্মীয়ের বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন আলি মহম্মদ, তারিকুল শেখ, সরিফা বিবিরা। কোনও রাখঢাক না করেই তাঁরা বলছেন, ‘‘বিনি পয়সাও এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি!’’
তবে অন্য ছবিও রয়েছে। একই দিনে দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারে এসেছিলেন শতাব্দী রায় ও কংগ্রেসের তারকা সাংসদ রাজ বব্বর। স্বামী সক্রিয় কংগ্রেসকর্মী। রাজ বব্বরের সঙ্গে থাকবেন। এ দিকে স্ত্রী সাজগোজ করে বসে আছেন শতাব্দীকে দেখতে যাবেন। মেজাজ হারালেন স্বামী, ‘‘শতাব্দী তৃণমূলের লোক। ওখানে গেলে লোকে কী বলবে!’’ স্ত্রী-র সেই এক গোঁ, ‘‘কতদিন স্বপ্নে দেখেছি শতাব্দীর মতো চুল বেঁধেছি। আজ সেই নায়িকা বাড়ির দোরে আসছে। আর ওকে দেখতে যাব না!’’ ভরদুপুরে চরম ঝগড়ার পরে দু’জনের পথ দু’ই তারকার দিকেই বেঁকে গিয়েছিল।
আরও আছে। প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে এসেছেন শুভশ্রী। সেল্ফি তোলার হিড়িকে একসময় কিঞ্চিৎ বিরক্তি ফুটে উঠেছিল তারকার ঠোঁটে। প্রার্থী বুঝতে পেরেই ধমক দিয়েছিলেন সঙ্গের এক কর্মীকে। ব্যাস, নায়িকা চলে গিয়েছেন। গোসা করে দেখা ক’দিন দেখা নেই সেই কর্মীরও। সঙ্গের লোকজনকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘নায়িকার সামনে ও ভাবে ধমক দেওয়াটা কি ঠিক হল?’’ পরে অবশ্য বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর মান ভাঙাতে হয়েছে।
তা হোক। তবুও তারকাদের আসার বিরাম নেই। শিয়রে ভোট। দুয়ারে তারা। ভোটের মরসুমে মুখে মুখে ঘুরছে সেই তারাদের কথাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy