স্টিয়ারিংয়ের পিছনে শ্রীনু (বাঁ দিকে)। খড়্গপুরের বাড়ির ঠাকুরঘরে রামবাবু। ছবি: দেবাশিস রায়।
দুধ সাদা অডি এ-ফোর গাড়িটা স্টার্ট করাই ছিল। কাছে যেতেই এক যুবক পিছনের দরজা খুলে বসতে ইশারা করলেন।
বাইরে ঝলসানো রোদ। গাড়ির ভিতরটা ঠান্ডা। সঙ্গী ফটোগ্রাফারকে নিয়ে পিছনের সিটে বসার পরে চালকের আসন থেকে শরীরটা বাঁকিয়ে যে হাত এগিয়ে এল, তার আঙুলে দুটো সোনার আংটি। কব্জিতে সোনার বালা, দু’কানে সোনার মাকড়ি, গলায় মোটা সোনার চেন। দু’হাতে ট্যাটু। মাথার কালো চুলে হাল্কা বাদামি রঙের ছোঁয়া।
ইনি শ্রীনু নায়ডু। তেলুগু যুবককে দেখতে অনেকটা দক্ষিণী সিনেমার নায়কের মতো। রেল-শহরে নাকি এঁরই ‘রাজ’ চলে। প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হল গাড়ির ভিতরে বসে। স্টার্ট করা অবস্থাতেই। শ্রীনুর পাশে ছিলেন তাঁর বন্ধু ওমপ্রকাশ সিংহ।
কী করে খড়্গপুরের রাজ্যপাট শ্রীনুর হাতে এল? সে এক লম্বা কাহিনি।
খড়্গপুরে দীর্ঘদিন অবধি মুকুটহীন রাজা বলতে একটা নামই উঠে আসত— বাসব রামবাবু। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই শহর যাঁকে ভোট দিয়ে বিধানসভায় জিতিয়ে এসেছে, কংগ্রেসের সেই জ্ঞান সিংহ সোহনপালকে লোকে ভদ্র, সজ্জন বলেই জানে। আদতে শহর শাসন করে এসেছেন রামবাবু। রেলের ছাঁট
লোহার কারবারে কোটি কোটি টাকা ওড়ে এই রেল-শহরে। সেই টাকার দখলদারিতে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে। বাম আমলে সেই মৃত্যুমিছিলের তালিকায় বহুচর্চিত দুই নাম ছিল মানস ও গৌতম চৌবে। খড়্গপুরের সিপিআই নেতা নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে। ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে— দু’বছরের ব্যবধানে খুন হন দুই ভাই। সেই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় রামবাবুর। তিনি
জেলে থাকার সময় থেকেই নাকি শ্রীনু দখল করতে শুরু করেন তাঁর সাম্রাজ্য। বেশ কয়েকটি ডাকাতির মামলায় শ্রীনুর নাম জড়িয়ে যায়। গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হয় শ্রীনুকে। রামবাবুর সঙ্গে শ্রীনুর মুখোমুখি আলাপও সেখানেই। সুপ্রিম কোর্টে শর্তাধীন জামিন পেয়ে ২০১০ সালে ফিরে আসেন রামবাবু। সাম্রাজ্য হারানোর আশঙ্কায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীনু অতর্কিতে রামবাবুর উপরে হামলা চালান বলে অভিযোগ। কিন্তু বেঁচে যান রামবাবু। তাঁর দাবি, এখন আর নির্বাচন-রাজনীতিতে তাঁর কোনও উৎসাহ নেই। মালঞ্চের বাড়িতে পরিবার-পুজো আর ব্যবসা নিয়েই থাকেন।
সোমবার নির্বাচনের সকালে শিবমূর্তির সামনে ধ্যানে বসেই অনেকটা সময় কাটালেন রামবাবু। দুপুরে তাঁকে পাওয়া গেল। বাড়ির দোতলায় বিশাল ড্রয়িং রুমে বসে শীতল চোখে বললেন, ‘‘এখনও তো মানুষ সাহায্য চাইতে আসে। এখনও মানুষ ভালবাসে।’’ সে তো সকালে খড়্গপুর স্টেডিয়াম থেকে ভোট দিয়ে বেরিয়ে জ্ঞান সিংহও বলেছিলেন, ‘‘আমাকে মানুষ ভালবাসে। আমিই জিতব।’’ দুপুরে বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ আত্মবিশ্বাসী সুরে বললেন, ‘‘অনেক মানুষের সাড়া পাচ্ছি। বলছে, আমিই নাকি জিতব।’’ আবার তৃণমূলের রমাপ্রসাদ তিওয়ারিরও দাবি, ‘‘খড়্গপুরের মানুষ চল্লিশ বছরের ইতিহাস এ বার পাল্টে দেবেন।’’
রামবাবু কী বলেন? মানুষ এ বার কার দিকে? ‘‘রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও বলব না,’’ থামিয়ে দিলেন রামবাবু। কিন্তু শ্রীনু? সেই প্রসঙ্গ তো আসবেই। রামবাবু আপন মনে মাথা নাড়েন। তার পরে বলেন, ‘‘ও আমাকে আঙ্কল বলে ডাকত। তখন বাচ্চা ছিল। এখনও বাচ্চাই আছে।’’
অডি-র ভিতরের আলাপচারিতায় রামবাবুর এই শ্লেষের কথা উঠতেই হা হা করে হেসে ওঠেন শ্রীনু। ‘‘তা হলে আমার সঙ্গে কথা বলার আগে আঙ্কলের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন? কী জানতে চান বলুন?’’
আপনিই নাকি এখন খড়্গপুর শাসন করছেন? আবার সেই হাসি। বলেন, ‘‘অব রাজনীতি মে মেরা কোই মতলব নেহি। লেকিন এক দিন অ্যায়সা আয়েগা, জব শ্রীনুকে ইশারে পে খড়্গপুর মে হর পেড় কা পত্তা হিলেগা।’’
শ্রীনুর স্ত্রী পূজা এখন খড়্গপুর পুরসভার তৃণমূলের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁর মাথায় শ্রীনুর হাত। আর শ্রীনুর মাথার উপরে যাঁর হাত, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তাঁকে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে কলকাতা নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। গত বছরের পুর নির্বাচনে যিনি দাঁড়িয়ে থেকে ভোট করিয়েছেন বলে অভিযোগ। রামবাবুর উপরে হামলার পরে জেলে থাকা শ্রীনুকে তিনিই নাকি দল বদলের জন্য রাজি করিয়েছিলেন। তখন শ্রীনু ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন বিজেপি-র সঙ্গে।
ভারতী ঘোষের সঙ্গে আপনার খুব ভাব?
শ্রীনুর সহাস্য উত্তর, ‘‘ইয়ে নাম কুছ শুনা শুনা লগ রাহা হ্যায়। শায়দ ইস জিলা মে কভি এসপি থা। কভি দেখা নেহি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy