নিজের বাড়িতে ইসমত খান। —নিজস্ব চিত্র।
ডাক্তার বলছেন, “বড় জোর মাস তিনেক। কেমোথেরাপি করিয়ে কষ্ট দেবেন? ওঁকে ওঁর মতোই থাকতে দিন বরং।” স্বামী, দাদা হতবাক। ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছেন না কেউই। যাঁকে নিয়ে এই দিন-মাসের হিসেব, তিনি তত ক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বসেছেন বাইরের চেয়ারে। ব্যাগে সব সময়ে থাকে একটা নোটবই আর পেন। ১, ২, ৩ করে তিনি লিখে ফেলছেন, তিন মাসে ঠিক কী কী কাজ গোছাতে হবে। স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েকে হস্টেলে পাঠানো, সংসারের খুঁটিনাটি স্বামীকে বোঝানো, বাবা-মায়ের সন্তানশোক সামলানোর জন্য কিছু ভাবনাচিন্তা, এমনকি, নিজের গয়নাগুলো কাকে দিয়ে যাবেন সেগুলো ঠিক করার কথাও ছিলওই তালিকায়।
১২ বছর আগে মুম্বইয়ের নামী ক্যানসার হাসপাতালের আউটডোরে যে জীবননাট্য শুরু, কলকাতার রাধানাথ চৌধুরী রোডের ফ্ল্যাটে প্রতি দিন তা লেখা হচ্ছে একটু একটু করে। প্রতি দিন ৪টি করে ‘অ্যান্টি ক্যানসার ড্রাগ’, আর প্রতি ২১ দিন অন্তর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ‘টার্গেটেড থেরাপি’। সব মিলিয়ে গত ১২ বছরে ৩০০-রও বেশি ক্যানসার প্রতিরোধী ইঞ্জেকশন নেওয়া হয়ে গিয়েছে। আজীবন নিয়ে যেতে হবে এ ভাবেই। কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই ৫৪ বছরের ইসমত খানের। তিনি বলছেন, “আসল তো হল বেঁচে থাকাটা। যত দিন বাঁচব, জীবনকে ভালবেসে বাঁচব। সেই মেয়াদ যদি ১২ বছর আগে মাত্র তিন মাসের হত, তা হলে ওই তিনটে মাসকেই নিজের মতো করে উদ্যাপন করতাম।”
দুই স্তন, বাহুমূল, থাইরয়েড, লিভার, এই সমস্ত অঙ্গে আগ্রাসী ক্যানসার নিয়ে মুম্বই ছুটেছিলেন ইসমত, স্বামী জাহির হোসেন খান এবং ইউরোপ প্রবাসী চিকিৎসক দাদা জুবের কবীর। স্টেজ ফোর ক্যানসার রোগীকে মুম্বইয়ের ওই ক্যানসার হাসপাতাল আক্ষরিক অর্থেই জবাব দিয়ে দেওয়ার পর দাদা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর চিকিৎসক-বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন বোনের রিপোর্ট নিয়ে। সম্মিলিত ভাবে ঠিক হয় চিকিৎসার প্রোটোকল। মুম্বইয়েরই আর এক হাসপাতালে শুরু হয় চিকিৎসা। নিভে যেতে যেতেও একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই চিকিৎসায় সাড়া দেন ইসমত। তার পর থেকে এক যুগ ধরে চলছে চিকিৎসা। এখন কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসক পি এন মহাপাত্রের তত্ত্বাবধানে প্রতি ২১ দিন অন্তর ভর্তি হন তিনি।
চিকিৎসক মহাপাত্র বলেন, “ওঁর ক্যানসার খুবই আগ্রাসী ছিল। এই সব ক্ষেত্রে টার্গেটেড থেরাপিতে কয়েক বছর হয়তো অনেকে ঠিক থাকেন। কিন্তু ওঁর এই দীর্ঘমেয়াদি ভাল থাকার পিছনে ওষুধের পাশাপাশি বড় হয়ে উঠেছে ওঁর মনের জোর। ওই জোরটাই ওঁকে রোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লড়াচ্ছে।”
বাজারহাট থেকে রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সব একা হাতেই সামলান। ছেলেমেয়ে দুজনেই এই মুহূর্তে চাকরিসূত্রে বেঙ্গালুরুবাসী। মাত্র তিন মাস আগে ইসমতের জীবনে ঘটে গিয়েছে এক বিপর্যয়। আগাগোড়া তাঁকে আগলে রাখা জাহির গত অগস্টে চলে গেছেন। ইসমত বলেন, “আমার জন্য চিন্তা করতে করতে মানুষটা নিজের কথা ভাবেনি। মারাত্মক সুগার। ‘মাল্টি অর্গান ফেলিওর’ হয়েছিল। তার আগের ৯ মাস বাড়ি আর হাসপাতাল—এ ভাবেই কেটেছে আমার। কখনও উনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কখনও আমি। তা-ও ধরে রাখতে পারলাম না।” ছেলে-মেয়ে এখন মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চান। ইসমত বলেন, “আমার জীবনটাকে যত্নে রাখতে গিয়ে আমার স্বামী অন্য কোনও কিছু ভাবেননি। ওঁর অবর্তমানে নিজেকে অবহেলা করে সেই চেষ্টাকে বিফলে যেতে দিতেপারি না।”
কেমো পোর্টের মাধ্যমে তিন সপ্তাহ অন্তর ওষুধ ঢোকে তাঁর শরীরে। প্রতি দু’মাস অন্তর ইকোকার্ডিয়োগ্রাম করে দেখা হয় হার্টের অবস্থা, বুঝে নেওয়া হয় পরের ওষুধের জন্য তাঁর হার্ট প্রস্তুত কি না। “যে দিন জানা যাবে প্রস্তুত নয়, সে দিন বুঝব ঘণ্টা বেজে গেছে। অনেকের ক্যানসার সেরে যায়। আমার ক্ষেত্রে তো তা নয়। আমাকে অহরহ রোগটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার টুঁটি চেপে ধরে দমিয়ে রাখতে হয়। আমার জীবনের মন্ত্র ‘দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না’।”
এই মন্ত্র থেকেই প্রতি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ক্যানসার ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী ও তাঁদের পরিবারের মানুষদের কাছে পৌঁছে যান ইসমত। তাঁদের সাহস জোগান। বলেন, ‘লড়ে যাও। আগেই হেরে বসে থেকো না।’ ইসমতের কথায়, “অনেককেই দেখি স্টেজ ওয়ান বা স্টেজ টু। তাতেই তাঁরা মারাত্মক ভেঙে পড়েছেন। কান্নাকাটি করছেন। ধরেই নিয়েছেন, সব শেষ। তাঁদের আমার জীবনের কথা বলি। এতগুলো অঙ্গে রোগ ছড়ানোর পরেও কী ভাবে দিব্যি বেঁচে আছি, সেই গল্প শোনাই।” আর এ ভাবেই ওই হাসপাতালে ইসমত এখন অত্যন্ত চেনা মুখ। তাঁর উদাহরণ মুখে মুখে ঘোরে।
‘টার্গেটেড থেরাপি’ ক্যানসারের কোনও কোনও ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বদল আনছে বলে দাবি চিকিৎসকদের। তাঁরা অনেকেই মনে করছেন, যেহেতু ক্যানসার সম্পর্কে লালিত আতঙ্ক অনেকটাই কাটাতে পারছে এই থেরাপি, অথচ খরচের কারণে অনেকে তার নাগাল পাচ্ছেন না, তাই সরকারি স্তরে এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা বাড়ানো দরকার। তবে সকলেই জোর দিয়েছেন ইতিবাচক মানসিকতার উপরেও। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, “রোগী, তাঁর ডাক্তার, পরিবার, পারিপার্শ্বিক সমাজ— সকলের ভূমিকা রয়েছে। ডাক্তার যদি রিপোর্ট দেখে ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘একেবারেই ভাল বুঝছি না’, রোগী যদি ভাবতে থাকেন ‘চিকিৎসা করিয়ে লাভটা কী’, পরিবার ও পরিজন যদি রোগীকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করায়, তিনি আর ক’দিনের অতিথি, তাঁকে বাড়তি খাতির করে, করুণা করে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে কোনও থেরাপিই তেমন সফল হবে কি? আর স্বাভাবিক আচরণ দরকার ক্যানসার রোগীর সঙ্গে। এটা বোঝার সময় এসেছে।”
ইসমত তা বুঝেছেন। তাঁর পরিবার বুঝেছে।
জীবনের নাম তাই ইসমত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy