সোনালি গুহ
প্রচারে অটো থেকে নামতেই ছুটে এসেছিলেন মেয়েরা। সেই দৃশ্য দেখে চোখমুখ চকচক করে উঠেছিল সাতগাছিয়ার তৃণমূল প্রার্থী সোনালি গুহর। এলাকার মেয়েরা ‘দিদি, দিদি’ বলে হাত ধরে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তাঁর হাতে দেওয়া হল স্টিলের গ্লাস।
এক মহিলা বললেন, ‘‘দিদি, আপনি শুধু জলটুকু খেয়ে বলুন কেমন? চারদিকে এলাকার মহিলারা তখন ঘিরে ধরেছেন প্রার্থীকে। বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছেন সোনালি। অগ্যতা ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে জল খেয়ে হনহন করে বেরিয়ে এলেন তাঁদের দিদি। মুখে এক রাশ বিরক্তি। পথ আটকে দাঁড়ালেন এক মহিলা। কোল থেকে সন্তানকে নামিয়ে চিৎকার করে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আপনি বলুন, দুধের শিশুকে এই জল খাওয়াতে হবে?’’ কোনও রকমে ভিড় ঠেলে সরিয়ে সোজা অটোতে উঠে মাথা হেলিয়ে দিলেন সোনালি। চলতে শুরু করল অটো। ততক্ষণে দিদির সঙ্গীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘জল খেয়ে অসুস্থ বোধ করছেন প্রার্থী। সোজা বাড়ি চলে যাচ্ছেন। ঘোলা জল খাওয়ানো হয়েছে দিদিকে। এটা ঠিক নয়।’’
ঘটনাটি মাস খানেক আগের। সাতগাছিয়া কেন্দ্রে সোনালি গুহ প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পরে প্রচারে গিয়েছিলেন গোবিন্দপুর-কালীচরণপুর পঞ্চায়েতের মুকুন্দপুর এলাকায়। সেখানেই তাঁকে ঘোলাজল খাওয়ানোর ঘটনা ঘটে। তার পরে ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে সাতগাছিয়ায় সোনালির ঘোলাজল।
এক কালে জ্যোতি বসুর কেন্দ্র বলে পরিচিত এই সাতগাছিয়ায় গত ১৫ বছর ধরে বিধায়ক সোনালি গুহ। তিনি যখন এই এলাকায় প্রথম ক্ষমতায় আসেন, তখনও জ্যোতিবাবু জীবিত। তার পরে আরও দু’দফায় জিতে এখানেই বিধায়ক হয়েছেন তিনি। ভরসা ছাড়েনি সাতগাছিয়া। সঙ্গে থেকে দেখেছে তাঁর সব উন্নতি। আজ তিনি ডেপুটি স্পিকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় গেলে তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখাতে এখনও ব্যস্ত থাকেন সোনালি। সাংবিধানিক বিধান না মেনে কার্যত মমতার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকেন
ডেপুটি স্পিকার। কিন্তু সোনালির নিজের বিধানসভা এলাকায় তাঁকে ঘিরে জমাট বেঁধেছে ক্ষোভ।
ওই এলাকার এক তৃণমূল নেতা জানান, ২০০১ সালে পানীয় জলের সঙ্কট দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সোনালি। কিন্তু কেরননি। ২০০৬-এ একই প্রতিশ্রুতি। কাজ হয়নি। ২০১১ সালেও সোনালির উপরে ভরসা ছাড়েনি তাঁর এলাকা। ফের একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতে এসেছিলেন তিনি। তবু কাজের কাজ হয়নি। ১৫ বছর ধরে পানীয় জলের সঙ্কটে ভুগছেন সাতগাছিয়ার বাসিন্দারা। সঙ্গে আরও অভিযোগ, এলাকায় আসেন না বিধায়ক। অথচ তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষেরা টিভিতে দেখেন, গভীর রাতে হাওড়ায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে পুলিশ গিয়েছে বলে সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। পুলিশকে ধমকেছেন। অভিযোগ, সাতগাছিয়ার লোকেরা তাঁকে বারবার খবর দিয়েও এলাকায় আনতে পারেন না। প্রয়োজন যত জরুরিই হোক না কেন।
অভিযোগ, গত ১৫ বছর সোনালি সাতগাছিয়ার মানুষকে ঘোলা জলেই রেখে দিয়েছেন। এলাকায় দেখা না পেয়ে কলেজ স্ট্রিটে বিধায়কের বাড়িতে গেলে বলা হয়, ‘ম্যাডাম নেই’ অথবা ‘ম্যাডামের শরীর খারাপ’। সকাল ন’টা বেজে গেলেও মাঝেমধ্যে খবর আসে, তিনি ঘুম থেকে ওঠেননি। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরে দুপুর ১২টা নাগাদ খবর আসে, দেখা করবেন না দিদি। ‘‘ভোটারেরা তো তবু সহ্যর সীমা বজায় রেখেছেন। শুধু ঘোলা জল খাইয়েছেন। আর কিছু করেননি,’’ বলেন এক তৃণমূল নেতা।
আগে গুঞ্জন ছিল, এ বার আর প্রার্থী করা হবে না সোনালিকে। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরে তাঁকে নিয়ে গোলমালও হয় দলের অন্দরে। এ বার তাঁর জন্য দেওয়াল লেখারও লোক নেই। লোক ভাড়া করে দেওয়াল লেখাচ্ছেন তিনি। প্রচারে গুটি কয়েক নিচুতলার কর্মী সঙ্গে থাকছেন। কারও মুখে কোনও রা নেই। সোনালির সঙ্গী এক তৃণমূল কর্মীর কথায়, ‘‘দলীয় নির্দেশ পালন করছি মাত্র। প্রার্থীর পক্ষে কিছু বলব তো মার খেয়ে মরে যাব।’’ সোনালির নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান রমজান আলি বলেন, ‘‘মানুষ কী করবে, তা ওঁরাই জানেন। আমরা কী করব বলুন?’’ সাতগাছিয়া এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দেওয়াল লেখার লোকের মতো ভোটারও যদি ভাড়া করে আনতে পারতেন তিনি, আমাদের একটু মুখরক্ষা হত।’’ তবে এ সব নিয়ে একেবারেই ভাবিত নন সোনালি। তিনি বলেন, ‘‘দলের কিছু নেতা চক্রান্ত করছেন। তাতে লাভ হবে না। আমার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল, তা স্বীকার করেছি। মানুষের ভোট পাব বলেই আমি আশাবাদী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy