জাপের ফাঁকা টেবিলে গল্প খুদেদের। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
ভরা গ্রীষ্মেও কুয়াশার আড়ালে ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছেন হরকাবাহাদুর ছেত্রী।
অথচ, রবিবার সকালে কালিম্পঙের চন্দ্রালোক প্রাথমিক স্কুলের বুথে ভোট দিতে সময়েও কুয়াশা দেখেননি তৃণমূলে সমর্থিক ‘জন আন্দোলন পার্টির’ (জা-আ-প, সংক্ষেপে জাপ) প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে ঘিরে হইচই করে উঠেছে জনতা। উপচে পড়েছে ভিড়।
কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে, কোথা থেকে রাশি রাশি মেঘ জমেছে দার্জিলিং পাহাড়ের আকাশে। জেলা সদর তো বটেই, কার্শিয়াং, কালিম্পঙের বিস্তীর্ণ এলাকা কুয়াশারা চাদরের আড়ালে চলে গিয়েছে। ফলে, কোথায় বুথ, কোথায় ভোটার, কাদের লোক, কে, কখন ভোট দিচ্ছে, কে দিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে, কিছুই ঠাহর করতে পারেননি ‘জাপ’-এর লোকজন।
কিন্তু, পাহাড়ের আবহাওয়া, প্রতিটি চড়াই-উতরাই হাতের তালুর মতো চেনেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। দল সূত্রের খবর, সাতসকালে পাতলেবাসের বাড়ির কাছে বুথে ভোট দিতে যাওয়ার সময়েই সঙ্গীসাথীদের জানিয়ে দেন, আকাশের অবস্থা সামান্য হলেও খারাপ। রোদ হয়ত উঠবে না। একটু পরেই কুয়াশা নামতে পারে।
সেই মতো সব বন্দোবস্ত করে নিতে হবে। সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মুহূর্তের মধ্যেই মোবাইলে কথা চালাচালির মাধ্যমে ‘নেতার নির্দেশ’ জেনে যায় চকবাজার থেকে কালিম্পঙের ডম্বর চক, কার্শিয়াঙের মোটর স্ট্যান্ডের নীচের স্কুল থেকে পানিঘাটা, মিরিকও।
বেলা ১০টার মধ্যেই মোর্চার যুব বাহিনী ‘জিএলপি’র সহযোগিতার হাত পৌঁছে গিয়েছে বুথের ধারেকাছে। কারও পিঠে হাত দিয়ে জিএলপির ছেলেরা ভরসা দিয়েছে। কোথাও আবার বাড়ির দুয়ারেই বসে থেকেছে। তাতে জড়োসড়ো হয়ে গৃহকর্তা ভোট দেওয়ার রাস্তায় হাঁটেননি। কার্শিয়াঙের সেবক বাজার থেকে কালিম্পঙের বাগরাকোট প্রাথমিক স্কুলের বুথের সামনেও শোনা গেল এমনই নানা কায়দায় ভোট দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ।
ব্যাপারটা ঠিক নয় বলে দাবি করলেন মোর্চার জিএলপির কয়েকজন সদস্য। কালিম্পঙের চুনাভাটি নেপালি প্রাথমিক স্কুলের অদূরে দলের পতাকা নিয়ে বসেছিলেন। বেলা ১২টায় সেখানে ৭০০ ভোটারের মধ্যে অর্ধেক ভোট পড়ে গিয়েছে। মোর্চার টেবিলের কাছেই ‘জাপ’-এর ছোট পতাকা টাঙানো রয়েছে। সেখানে চেয়ার-টেবিল থাকলেও লোকজন নেই। ছবি তোলার চেষ্টা করতেই হা হা করে উঠলেন মোর্চার টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন যুবক। তাঁরা বললেন, ‘‘ফাঁকা টেবিলের ছবি তোলা ঠিক হবে না। আমরা কয়েকজন ওখানে বসছি। তা হলে বেশ একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে মনে হবে।’’ সেটা কী করে সম্ভব! ওই যুবকেরা জানালেন, মোর্চা এভাবেই পাহাড়ে সকলকে সহযোগিতা করে থাকে।
কালিম্পং সদরের কয়েকটি এলাকা বাদ দিলে বুথে-বুথে এমনই ঘটেছে বলে আশঙ্কা করছেন জাপ-এর অনেকেই। কার্শিয়াং, দার্জিলিঙেও কোনও কোনও বুথে তৃণমূলের এজেন্ট না থাকায় নিজেদের লোককেই জিএলপি বসিয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ কম নেই।
তাই দিনের শুরুটা ভাল হলেও শেষ বেলায় অভিযোগের সুর শোনা গিয়েছে হরকাবাহাদুর ছেত্রীর গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘বহু মানুষ পাহাড়ে পরিবর্তন চাইছেন। সেটা আঁচ করে নানা বাধা দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের ভয় দেখানো হয়েছে। এভাবে হয় না। মোর্চাকেও একদিন হারের স্বাদ নিতে হবে।’’
কিন্তু, এখনও পাহাড়ের কর্তৃত্ব গুরুঙ্গের হাতেই। মদন তামাঙ্গ হত্যা মামলায় চার্জশিট হলেই বা কি! টাকা তোলা, বেআইনি নির্মাণে মদত দেওয়া সহ যত অভিযোগই তোলা হোক না, তার কোনওটাই যে প্রমাণ হয়নি সেটা মনে করিয়ে দিতে ছাড়েন না গুরুঙ্গ-সহচরেরা। এটাও জানিয়ে দেন, পাহাড়ের যাবতীয় আবহাওয়ার মতিগতি চট করে ধরতে পারেন বলেই ঠিক সময়ে সুবাস ঘিসিঙ্গকে ছেড়ে আলাদা দল গড়ে ফেলেছিলেন মোর্চা সভাপতি। কাজেই সেই তিনি হরকাবাহাদুরের উত্থান ঠেকাতে যে সবরকম চেষ্টা করবেন, তা নিয়ে পাহাড়ের অনেকেরই সংশয় নেই।
তা বলে সহযোগিতার অছিলায় হারিয়ে দেওয়া!
এটাই ‘গুরুঙ্গ-স্টাইল’—ফিসফিস করে বললেন পাহাড়ের একটি বুথের দায়িত্বে থাকা একজন অফিসার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy