কংগ্রেস কর্মী দু’হাতে হাত চিহ্ন ও কাস্তে-হাতুড়ির পতাকা নিয়ে নাচানাচি করছেন। তাঁর পাশেই এক দঙ্গল ছেলে সিপিএমের পতাকা নিয়ে নাচছেন। জোটের এমনই বার্তা যখন নিচুতলায়, মঞ্চে তখন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী বলছেন, ভিড় দেখে রাহুল বলেন, “এটা দেখতেই পাচ্ছি, যে মমতার পক্ষে এই ভোট সহজ নয়। ওরা হারবে। জনতাও তাই চায়”। রাজ্যে এই জোটই ক্ষমতা পাচ্ছে ধরে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখানে যে সরকার হবে, তা হবে মানুষের সরকার। সবার সরকার হবে।’’ চৈত্রের রোদ্দুরে পুড়ে যাওয়া তামাটে মুখগুলো তখন গালভরা হাসি। হাততালিতে কেঁপে উঠছে বাঁকুড়ার তামলিবাঁধ ময়দান।
শনিবার বেলা সাড়ে ১২টায় রাহুলের সভা করতে আসছেন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। তার আগে থেকেই সভাস্থল কানায়-কানায় ভর্তি। রাহুলকে কাছ থেকে দেখতে হবে তো! ঘড়ির কাঁটা ২টো টপকে যখন রাহুলের চপার মাঠে পাক খেয়ে হেলিপ্যাডের দিকে উড়ে গেল ততক্ষণে মাঠ, স্টেডিয়ামে গাদাগাদি অবস্থা। মঞ্চে হাজির বাঁকুড়ার কংগ্রেস প্রার্থী শম্পা দরিপা, বিষ্ণুপুরের কংগ্রেস প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য, ওন্দার ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী মানিক মুখোপাধ্যায়-সহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রের জোটের প্রার্থী। রাহুল সভায় আসার আগে মঞ্চে বক্তব্য রেখেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র, জেলা সম্পাদকমণড্লীর সদ্যে প্রতীপ মুখোপাধ্যায়, আরএসপি-র জেলা সম্পাদক গঙ্গা গোস্বামী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলমাধব গুপ্ত। দর্শকদের মধ্যে চারপাশে উড়ছিল কংগ্রেস ও বামেদের পতাকা। সার্বিক ভাবে জোটের এই ছবি দেখে অধীর জেলা বামফ্রন্ট নেতাদের অভিনন্দন জানিয়ে, দারুণ কাজ করেছেন বলে মন্তব্য করেন। সভা শেষে বাম ও কংগ্রেস নেতারা একবাক্যে দাবি করেন, ভিড় মোটেই হাজার পঁচিশের কম ছিল না। যদিও ওই ভিড়ের বহর নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তৃণমূল নেতৃত্ব।
বস্তুত সিপিএম নেতারা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, কংগ্রেস হাজার ছয়েক মানুষকে সভায় নিয়ে আসুক। বাকি মাঠ কী ভাবে ভরাতে হয় তাঁরা দেখিয়ে দেবেন। এ দিন রাহুলকে ভরা মাঠ দেখাতে পেরে জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের তাই আপ্লুত অবস্থা। চপার মাঠে পাক মারতেই জনতার মধ্যে থেকে শোর ওঠে— ‘রাহুল’, ‘রাহুল’। অনেকে আবার চিৎকার করে ওঠেন, ‘ওই তো এসে গিয়েছে’।
আরও প্রায় মিনিট দশেক পরে রাহুল যখন সভাস্থলে ঢুকছেন তখন হাত উঁচিয়ে কেউ বন্দেমাতরম, কেউ ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিলেন। কেউ লালঝান্ডা নিয়ে লাফাচ্ছেন, কেউ আবার হাত চিহ্নের পতাকা নিয়ে। তাঁকে সামনে থেকে দেখার জন্য দু’দলের কর্মীদের মধ্যেই ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায়। ব্যারিকেডের সামনের ভিড় তখন সামলে উঠতে বেগ পাচ্ছেন স্পেশাল সিকিউরিটি গ্রুপ-এর কর্মীরা। হুড়োহুড়ি সামাল দিতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একশা এক কর্মী বলেই ফেললেন, “জনতা হ্যায় না, জোশ মে আকে হোশ খো দিয়া হ্যায়!’’
এমনিতেই জোটের আবহে অনেক আগেই মিলে গিয়েছে বাম-কংগ্রেস ভেদাভেদ। সম্প্রতি বাঁকুড়ার বঙ্গবিদ্যালয়ের মাঠে সভা করতে এসেই তা আগেই টের পেয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হল না। এ দিনের জমায়েত দেখেই অধীরবাবু বলেন, “এই উপস্থিতিই জানান দিচ্ছে তৃণমূলের দিন শেষ হচ্ছে।”
জোট গড়া হলেও বামেরা কি পাশে থাকছেন? দিল্লির কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে সংশয় হয়তো রয়েছে। শম্পাদেবী বলেন, ‘‘বাঁকুড়া স্টেডিয়ামে চপার থেকে নেমেই রাহুল জানতে চান, বামফ্রন্ট আমার সাথে রয়েছে কি না। আমি তাঁকে জানিয়েছি, বামফ্রন্ট ২০০ শতাংশ সাহায্য করছে।’’ মঞ্চে রাহুল জোট বার্তা দিয়ে বলেন, “পোলিং বুথ থেকে শহর, গ্রাম, গঞ্জ, রাস্তা সর্বত্রই হাতে হাত মিলিয়ে চলুন। মিলেমিশে এসে সরকার গড়ুন।” রাহুলের মুখ থেকে এই কথা শুনেই মাঠে উপস্থিত জনতাও উল্লাসে ফেটে পড়ে। এ দিন গোটা সভাস্থল ছিল কংগ্রেস, সিপিএম, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের পতাকায় ভরা।
কংগ্রেস সহ-সভাপতির সভার এমনই নানা ছবির সাক্ষী হয়ে থাকল বাঁকুড়ার তামলিবাঁধ ময়দান। শনিবার ক্যামেরাবন্দি করেছেন অভিজিৎ সিংহ।
রাহুলের সভাকে সফল করতে কংগ্রেসের পাশাপাশি কার্যত আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন বাম নেতৃত্ব। শেষ পর্যন্ত সভাস্থল ভরিয়ে তাই দু’দলেরই মুখই প্রসন্ন। রাহুল চলে যাওয়ার পরে ফাঁকা মঞ্চে গোল হয়ে বসে সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য প্রতীপ মুখোপাধ্যায়, জেলা কমিটির সদস্য সুবিকাশ চৌধুরী, জোট প্রার্থী শম্পা দরিপা, কংগ্রেস নেতা পদ্মনাভ বিশ্বাসরা এ দিনের সভা ও রাহুলকে নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
প্রতীপবাবু বলছেন, “২৫ হাজার লোক হবে বলেছিলাম। তার চেয়েও বেশি লোক হয়েছে।” প্রতীপবাবুর মুখের কথা ফুরোবার আগেই সুবিকাশবাবু অভিযোগ করেন, “আমাদের অনেক গাড়ি বিভিন্ন জায়গায় আটকে দিয়েছে তৃণমূল। না হলে আরও লোক হতো।” পদ্মনাভর কথায়, “জোটের ক্ষমতা কতখানি প্রমাণ হয়ে গেল।” নিজেদের মধ্যে আড্ডা সেরে প্রতীপবাবুরা যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন তখনই অভিনন্দন জানাতে ছুটে এলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক দীপিকা পান্ডে, মনোজ কুমার। উল্লেখ্য, রাহুলের সভার জন্য হপ্তাখানেক ধরেই তাঁরা বাঁকুড়ায় রয়েছেন। সভার প্রস্তুতির উপরেও এই দু’জনের কড়া নজর ছিল। দীপিকাদেবী প্রতীপবাবুকে বলেন, “আপনাদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। প্রচুর খেটেছেন আপনারা।” এই কথায় সায় দিয়ে মনোজবাবু বলেন, “এ ভাবে যেন আগামী দিনেও সাহায্য পাই।” প্রতীপবাবু হেসে বলেন, “আপনারা খুশি হলেই আমরাও খুশি। আপনারাও কম পরিশ্রম করেননি।”
জোটের বার্তা শুধু নেতৃত্ব স্তরেই নয়, দুই দলের নিচুতলার কর্মীদের কাছ থেকেও মিলছে। এ দিন সভায় আসা জুনবেদিয়া অঞ্চলের প্রবীণ সিপিএম কর্মী নির্মল বাউরি, শ্যামল দাসরা বলেন, “আমাদের এলাকায় এই সভায় আসার জন্য গাড়ি পাওয়া যায়নি। তাই আমরা কয়েকশো কর্মী সাইকেল নিয়েই সভায় এসেছি। শম্পা দরিপা কংগ্রেসের প্রতীকে দাঁড়াচ্ছেন তো কী হয়েছে, উনি তো আমাদের জোট প্রার্থী। যে ভাবেই হোক তৃণমূলকে এ বার জিততে দেওয়া চলবে না।” দুই দলের কর্মীদের হাতে পতাকা নিয়ে মাঠের ইতি উতি একসাথে ঘুরে বেড়াতেও দেখা গিয়েছে এ দিন।
জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “ওঁরা তো সারা জেলার মানুষকে নিয়ে এসেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক একটি কেন্দ্রে এর থেকে ঢের বেশি লোক টানছেন।’’ আজ রবিবার বাঁকুড়া শহরে তৃণমূল নেত্রীর পদযাত্রা রয়েছে। রাহুলের সভার পরের দিন সেই শহরেই ভিড়ে টক্কর দিতে আপাতত ব্যস্ত তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল নেতারা বলছেন, “জনজোয়ার কাকে বলে রবিবারই তা দেখবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy