প্রথম ইলিয়াস ২০০৬-এ (বাঁ দিকে)। দ্বিতীয় ইলিয়াস ২০১৬-য় (ডান দিকে)।
দু’জনের নামই ইলিয়াস মহম্মদ। বাড়ি নন্দীগ্রামে। একই এলাকায়, চৌরঙ্গিবাজার। এবং আশ্চর্যের হলেও সত্যি, দু’জনের বাড়ির ঠিকানাও এক! এখানেই শেষ নয়, এমন হাজারো টুকরোটাকরা ব্যাপারে দু’জনের গলায় গলায় মিল!
তবে, সেই দিনের পর থেকে দুই ইলিয়াসের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। দু’জনের মধ্যে চিনের পাঁচিল উঠে গিয়েছে যেন! এক বাড়িতে থাকার পাটও চুকেছে। প্রথম ইলিয়াস এখন কোথায় থাকেন? কেউ জানে না। তারা শুধু জানে, শেষ তাঁকে দেখা গিয়েছিল ৫ ডিসেম্বর, ২০০৭।
সে দিনের পর প্রায় ৯ বছর কেটে গিয়েছে। এত দিন পরে কেমন আছেন একাকী দ্বিতীয় ইলিয়াস?
নন্দীগ্রামের তাপমাত্রা ৪২ ছুঁইছুঁই। তার সঙ্গে মিলেছে ভোটপর্বের উত্তাপ। অথচ, চৌরঙ্গিবাজারের একতলা-আটপৌরে বাড়িতে আশ্চর্য নিরুত্তাপ দেখাল তাঁকে। বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেন বাবাকে বাইরে ডেকে আনলেন। ভেঙে যাওয়া চেহারা। তুবড়ে যাওয়া মুখের দখল নিয়েছে দাড়ি। পড়ে যাওয়া দাঁত এবং সেরিব্রাল স্ট্রোকের জেরে কোনও শব্দই প্রায় স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতে পারেন না। পরনে লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি। হাতে ধর্ম সংক্রান্ত একটা বই।
‘ভাল আছি। বিচারের অপেক্ষায় আছি।’ আসলে প্রথম জনের কথা এখনও স্পষ্ট ভাবে মনে করতে পারেন দ্বিতীয় ইলিয়াস। আর তাই বাকি বিচারের দিকেই তাকিয়ে আছেন তিনি। কাছাকাছির মানুষেরা জানেন, সেই দিনটার পর থেকে তিনি বড্ড বেশি ঘরকুনো। বড্ড বেশি মনমরা। চুপচাপ। বড় বেশিই ধর্মনির্ভর। তবুও, বৈশাখী দুপুরে প্রথম জন সম্পর্কে সব কথা শোনালেন সেই মনমরা দ্বিতীয় জনই।
দেখুন নন্দীগ্রামের ভিডিও
প্রথম ইলিয়াস সিপিআই করতেন। চাকরিও করতেন রাজ্য সরকারের এক দফতরে। চাকরির বয়স তিন বছর হতে না হতেই দলের নির্দেশে তাঁকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় বিধানসভা ভোটে। ২০০১-এর নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে প্রায় সাড়ে আট হাজার ভোটে জিতেছিলেন ইলিয়াস মহম্মদ। এর পর ২০০৬ সালেও নন্দীগ্রাম তাঁকে বিধানসভায় পাঠিয়েছে। তাঁর সেই বিধায়ক জমানার দ্বিতীয় পর্বেই জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম। বামফ্রন্ট সরকার নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব করবে বলে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর তাকে ঘিরেই চড়চড় করে বেড়েছিল উত্তেজনা। নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে দু’বার মারও খেয়েছিলেন তিনি।
ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সেই আন্দোলন সাফল্য পেলেও তত দিনে নন্দীগ্রামে প্রাণ গিয়েছে প্রচুর মানুষের। ২০০৭-এ ১০ নভেম্বরের ভয়াবহ সেই দখল-পুনর্দখলের পালা সবে শেষ হয়েছে। এমন একটা সময়ে, ওই বছরেরই ৫ ডিসেম্বর কলকাতার এমএলএ হস্টেলে প্রথম ইলিয়াস মহম্মদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শঙ্কুদেব পণ্ডা। তিনি তখন একটি সংবাদ মাধ্যমের কর্মী। কিন্তু, ইলিয়াস সে কথা জানতেন না। দ্বিতীয় ইলিয়াসের দাবি, নন্দীগ্রামের ওই পরিস্থিতিতে একটি এনজিও সেখানে উন্নয়নের কাজ করতে চেয়েছিল। আর সেই কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল বিধায়কের একটি শংসাপত্র। সেটি নিতেই এসেছিলেন শঙ্কুদেব। অভিযোগ, শংসাপত্র হাতে পেতেই বিধায়কের পকেটে ১০ হাজার টাকা গুঁজে দেন শঙ্কু। কিন্তু, প্রথম ইলিয়াস বাধা দেন। এর পরে উন্নয়নের নামে দলের ফান্ডে টাকা দেওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করেন তিনি। দ্বিতীয় ইলিয়াসের কথায়, ‘‘পকেটে টাকা জোর করে ঢোকানোর সময় তার ছবি তুলে নেয় শঙ্কুদেব। আর সেই ছবিতে বিভ্রাট ঘটায়।’’ এর পরেই বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। কিছু দিন পরেই বিধায়ক পদ, এমনকী, দলের সদস্য পদও ছেড়ে দেন ইলিয়াস মহম্মদ।
দ্বিতীয় ইলিয়াস কিছুই করেন না। সামান্য ক’টাকা পেনশন পান। তাতে কোনও ভাবে পেট চলে যায়। কিন্তু, সম্প্রতি অসুস্থ হওয়ার পর জমি বিক্রি করে চিকিত্সা করতে হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই সম্পর্ক নেই। সিপিআই করা ছেলে সাদ্দামের নাম এ বারের বিধায়ক পদপ্রার্থী হিসেবে ওঠার পরেও অনুভবে কোনও পরিবর্তন আসেনি। পরে যখন দল সাদ্দামের বদলে কবীর মহম্মদের নামে সিলমোহর দেয়, তখনও নির্বিকার থেকেছেন। কিন্তু, সম্প্রতি রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া নারদ-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর তিনি আর চুপ করে থাকতে পারেননি।
আরও পড়তে ক্লিক করুন
বিচার বাকি, অপেক্ষায় শঙ্কু-তাড়িত সেই ইলিয়াস
২০০৭-এর ৫ ডিসেম্বরের ঘটনাটা বার বার মনে পড়েছে। মনে পড়েছে শঙ্কুদেব পণ্ডার কথা। মনে পড়েছে সৌগত রায়কেও। নারদের গোপন ক্যামেরায় ‘টাকা নিতে গিয়ে’ ধরা পড়েছেন দু’জনেই। দ্বিতীয় ইলিয়াসের কথায়, ‘‘ইতিহাস কথা বলে জানেন! সেই শঙ্কুদেব, যিনি এমএলএ হস্টেলে ঘুষের টোপ দিয়েছিলেন। সেই সৌগত রায়, যিনি বিধানসভায় নন্দীগ্রামের বিধায়ককে চোর সম্বোধন করে চিত্কার করেছিলেন।’’
এর মধ্যেই চৌরঙ্গিবাজারের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। কথা থেমে যায়। আজান শেষ হতেই নীরব ইলিয়াস বলে ওঠেন, ‘‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’’
আসলে সেই দিনটা ইলিয়াস মহম্মদের কাছে কোনও একটা দিন নয়। অনেকগুলো দিন মিলিয়ে একটা বোধ, অপমান বোধ। আর সেটাই আস্তে আস্তে একটা গোটা মানুষকে কুরে কুরে খেয়েছে। তাঁকে দু’টি সত্তায় ভেঙে দিয়েছে। তার পরে একটা সময়ে সেই দুই সত্তাকে সরিয়ে দিয়েছে একে অপরের কাছ থেকে লক্ষ যোজন দূরে।
তাই নাম, ঠিকানা, বসত একই থেকে গেলেও সে দিনের সেই বিধায়ক ইলিয়াস মহম্মদের সঙ্গে কোনও মিলই নেই ধর্মনির্ভর এই ইলিয়াস মহম্মদের।
এক ইলিয়াসের ঘরে যে আসলে বসত করে আর এক ইলিয়াস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy