মুখোশে আছেন। মদন মিত্রের হয়ে প্রচার কামারহাটিতে।—নিজস্ব চিত্র
দাদা রামচন্দ্রের খড়ম সিংহাসনে রেখে রাজ্য চালিয়েছিলেন ভাই ভরত।
এ কালের কামারহাটিতে ‘দাদা’র ফাঁকা চেয়ারের চারপাশে বসেই প্রতিনিয়ত মহারণের কৌশল ঠিক করছেন তাঁর ‘ভাই’রা। যোগ দিয়েছেন দাদার গোটা সংসারও।
তিনি তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্র।
সারদা-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে প্রায় পনেরো মাস ধরে কার্যত নির্বাসনে প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী। তবুও তাঁকে ভোটযুদ্ধে সামিল করেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রার্থী নিজে যুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বে উপস্থিত না থাকায় কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে ভাইয়েরা। ‘দাদা’র
অদৃশ্য উপস্থিতিতেই সব কাজ সামলাতে হচ্ছে।
প্রশ্নটা অবশ্য অন্য জায়গায়। যুদ্ধের সময়ে না হয় মদনের ফাঁকা চেয়ারের পাশে বসেই রণনীতি ঠিক করছেন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু জিতলে কী হবে? সামান্য একটা শংসাপত্র আনতেও কি ফাঁকা চেয়ারের সামনেই লাইন দিতে হবে? নাকি ছুটতে হবে কারাগারের কুঠুরিতে? কামারহাটির আকাশে-বাতাসে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্নটাই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের এই সংশয়কেই প্রচারের হাতিয়ার করে ফেলেছেন বিরোধীরা। ভোটারদের কাছে তাঁরা দাবি করছেন, ‘যদি মদন মিত্রকে জেতান, তা হলে কিন্তু শংসাপত্র আনতে কিংবা অন্য যে কোনও দরকারে জেলে ছুটতে হবে। এ বার ভেবে দেখুন কী করবেন!’
জেলবন্দি মদন অবশ্য ঘনিষ্ঠ বন্দিদের কাছে অন্য কথা বলছেন। দাবি করছেন, কামারহাটির মানুষ জানেন কেমন অন্যায় ভাবে রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার বানিয়ে তাঁদের বিধায়ককে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তাই ভোটে জিতে তিনি গারদে থাকলেও এলাকার উন্নয়নে ঘাটতি হবে না। সব কাজ হয়ে যাবে। শুনে হাসছেন বিরোধীরা। এক সিপিএম নেতা বলছেন, ‘‘জেলে থেকে এ বার তো উনি ম্যাজিকও শিখেছেন দেখছি। আলিপুরে বসে কামারহাটির সব কাজ করে দেবেন!’’
স্থানীয় মানুষ কী ভাবছেন বা বিরোধীরা কী বলছেন, তা নিয়ে অবশ্য তেমন মাথা ব্যথা নেই ‘মদন দাদা’র দলবলের। তাঁদের লক্ষ্য একটাই— ‘যে ভাবেই হোক, দাদাকে জেতাতে হবে।’ আর তাই আলিপুর সংশোধনাগারের মন্দির ওয়ার্ডে বন্দি মদনের হয়ে ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন কামারহাটির সমস্ত কর্মী থেকে ভবানীপুরের বাসিন্দা গোটা মিত্র পরিবার। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাশেই প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রীর ফ্ল্যাট। অফিসঘর তার নীচেই। ভোটের বাজারে সেটাই নির্বাচনের মূল কার্যালয়। প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর থেকেই সেখানে ঘাঁটি গেঁড়েছেন মদনের ছোট পুত্র, সদ্য এমবিএ পাশ করা শুভরূপ মিত্র ওরফে সোম। পাশাপাশি প্রতিদিনই সকাল-বিকেল নিয়ম করে কামারহাটির মাটি আঁকড়ে ধরতে ভবানীপুর থেকে হাজির হচ্ছেন মদন-জায়া অর্চনা মিত্র, বড় ছেলে স্বরূপ মিত্র ও পূত্রবধূ স্বাতী। রোদ পুড়ে-ঘামে ভিজে প্রচার চলছে। ছেলে-বৌমারা বলছেন, ‘‘রামচন্দ্র বাবার কথা রাখতে বনবাসে গিয়েছিলেন। আর আমরা বাবাকে জেতাতে এটুকু করতে পারব না?’’
যদিও রণনীতি ঠিক করছেন খোদ মদনই। প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পরেই জেলে নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ভোট কৌশলের বিভিন্ন বার্তা কামারহাটির ময়দানে পৌঁছে দিতেন। এমনকী নিজের অভাব পূরণে গোটা পরিবারকেও যুদ্ধে সামিল করেছেন। তৈরি করে দিয়েছেন কমিটি। তাতে চেয়ারম্যান সাংসদ সৌগত রায়, আহ্বায়ক কামারহাটির পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহা। এ ছাড়াও বিশেষ দায়িত্বে রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান তুষার চট্টোপাধ্যায়, কাউন্সিলর স্বপন মণ্ডল, বিশ্বজিৎ সাহা, কালামুদ্দিন আনসারি, সমীরণ দাস, নবীন ঘোষাল, বিমল সাহা-সহ অন্যান্য কাউন্সিলরেরা। আর গত বারের মতো এবারেও চিফ ইলেকশন এজেন্ট রেখেছেন দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা অভিজ্ঞ মুখ প্রদীপ ঘোষকে। তবে শুধু ভোট পরিচালনার কমিটি গড়েই থেমে থাকেননি পোড় খাওয়া রাজনীতিক। হীরালাল কলেজ ও ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের তরুণী পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন প্রচার কমিটিও। রয়েছে মহিলা ও যুব সংগঠনও। এ ছাড়া, ভবানীপুরের বাসিন্দা মদনের ঘনিষ্ঠ অনুচর প্রশান্ত প্রামাণিক, রঞ্জিত দে, ঝন্টু দে-র মতো আরও অনেক ভাই-ই
দাদার হয়ে ভোট চাইতে প্রাণপাত করছেন কামারহাটিতে।
শুধু কি কমিটি গড়ে আর মিত্র পরিবারকে ভবানীপুর থেকে উজিয়ে এনে বিরোধীকে হারাতে চান মদন?
ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ‘‘দাদা এত কাঁচা খেলোয়াড় নন।’’
তবে আর কী কৌশল আছে ভাঁড়ারে? প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, জেলে বসেই সব ছক কষে দিয়েছেন মদন। সকালে ঘুম থেকে উঠে গারদে বসেই সাদা কাগজে হিজিবিজি কেটে রণনীতি ঠিক করে ফেলতেন ভিআইপি বন্দি। পরে সেটাই দেখা করতে আসা কর্মী ও পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছে এলাকায়। সেই মতোই গত দেড় মাস ধরে কামারহাটির ২২০টা বুথেই সোম থেকে শনি রুটিন-মাফিক ঘুরছেন মদন-পুত্ররা। সঙ্গে নেতা-কর্মীদের দল। বুথের এজেন্টকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে ভোট চাইছেন। আর ফি রবিবার কামারহাটির রাজপথ জুড়ে মহা মিছিল। তারও রূপরেখা
করে দিচ্ছেন মদন নিজেই। শুধু তা-ই নয়, কামারহাটি, বেলঘরিয়ার সিপিএম নেতাদের বাড়িতে গিয়েও সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ভোট চাইছেন মদন-পুত্ররা।
তবে সারদা-কাণ্ডে মদন জেলবন্দি থাকলেও তা নিয়ে প্রচারে একটি কথাও খরচ করছে না কামারহাটি। ভোট প্রচারের শুরুতেই জেল থেকে কর্মীদের এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে দিয়েছিলেন খোদ মদনই। বড় ছেলে স্বরূপ মিত্র বলেন, ‘‘বিষয়টি বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে আমরা কোনও কথা বলতে চাই না। তবে সত্যের জয় হবেই।’’
কিন্তু শেষ এক মাসে গারদের ওপার থেকে ভোট পরিচালনায় কিছুটা হলেও বিরত রয়েছেন মদন। কারণ, নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়িতে এখন আর বাইরের কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। সপ্তাহের দু’দিন পরিবারের লোকেরা এবং অন্য দিনে বাকি সাক্ষাৎপ্রার্থীরা জেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়েই জেলের নির্দিষ্ট গারদের ফাঁক দিয়েই দেখা করতে পারছেন প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে। সেই ফাঁক দিয়েই ভাইদের কানে ভোটমন্ত্র দিচ্ছেন দাদা। কখনও বা ভাইদের কথা ‘হোমিওপ্যাথির পুরিয়া’র মতো চিরকুট বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দাদার হাতে। প্রত্যুত্তরে আসছে মদন-বাণী। পৌঁছে যাচ্ছে দক্ষিণেশ্বরের নির্বাচনী কার্যালয়ে।
এ বাজারে দাদার হয়ে প্রচারে কে কাকে কত টেক্কা দিতে পারবেন, তা নিয়েও আছে ঠান্ডা লড়াই। কেউ বানিয়েছেন কয়েক হাজার মদন-মুখোশ, কেউ বা তিরিশ ফুটের কাট-আউট, কেউ আবার তৈরি করে ফেলেছেন দাদার ছবি সাঁটা গেঞ্জি। পাঁচ বছরের উন্নয়নের খতিয়ান দিয়ে ছাপা হয়েছে বইও। সব শুনে ঘনিষ্ঠ বন্দিদের মদন বলেছেন, ‘‘কামারহাটির সবাই আমার ভাই। হাজার হাজার ভরত নেমেছে ভোট যুদ্ধে।’’
হাজার হাজার ভরতের হাতে কি অটুট থাকবে রামচন্দ্রের রাজপাট? সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy