তখনও তুঙ্গে প্রচার। রামনগরের রাস্তায় জোটপ্রার্থী তাপস সিংহ ও তৃণমূল প্রার্থী অখিল গিরি (ডান দিকে)। সোহম গুহর তোলা ছবি।
তিনি দিদিগিরিতে আছেন। দাদাগিরিতে আছেন। কিন্তু অধিকারীতে নেই!
দিদি তাঁর হয়ে দিঘার সৈকতটা সাজিয়ে দিয়েছেন। দাদা টিকিট বাঁচিয়েছেন, দেব আর শিউলি সাহাকে নিয়ে প্রচার করে গিয়েছেন। অধিকারীরাও তেতো ওষুধ গেলার মতো করে রামনগর ছুঁয়ে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়েই জল্পনা উড়ছে, অখিল গিরির তরী এ বার নাকি সমুদ্রে ডুবে যেতে পারে অধিকারীদের অভিশাপেই!
তৃণমূলের মধ্যে গিরি আর অধিকারীদের আক্ষরিক অর্থেই পারিবারিক বিবাদ সেই কবে থেকেই। কিন্তু এ বার যেন মুষল-পর্বের গন্ধ আরও একটু ঝাঁঝালো! সেই যে শুভেন্দু অধিকারীর নাম না করে অখিলবাবু কর্মিসভায় বলে বসলেন, ভোট লুঠ করে জেতার গল্প জানা আছে আর তমলুকের সাংসদও তার পাল্টা দিলেন, তখন থেকেই নাকি ঘুঁটি সাজানো চলছে। বেনফিশের তহবিল, রামনগর কলেজে ছাত্র ভর্তির টাকা নিয়ে বিবাদ— এ সব দিয়ে নাকি তিল তিল করে জমি তৈরি হয়েছে। যেখানে এ বার মুষল-পর্বের চূড়ান্ত মহড়া হতে পারে! জল্পনা ছড়িয়ে আছে তৃণমূলের অন্দর মহলেই।
এই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বিরোধীরা জুড়ে দিচ্ছেন, বেনফিশের ২৭ লক্ষ টাকা তছরুপে দায়ী কে? পেশায় সমাজকর্মী বলে পরিচয় দেওয়া এক জন সাধারণ বিধায়কের স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে পাঁচ বছরে ১০১৭% সম্পত্তি বৃদ্ধি হয় কী ভাবে? বিরোধীরা জানেন, পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি বিধানসভা আসনই এখন তৃণমূলের দখলে। এই জোট আর নারদের বাজারে শাসক দলের এখানে আর বাড়তি কিছু পাওয়ার নেই। বরং, যা তারা হারাতে পারে, তা-ই বিরোধীদের লাভ!
অখিলবাবু প্রত্যাশিত ভাবেই এ সব শুনে বলছেন, ‘‘বলার কিছু না পেয়ে বিরোধীরা অপপ্রচার করছে। আমাদের দলে কোনও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নেই। সবাই একজোট হয়ে ভোটে লড়ছি।’’ আর তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, শুভেন্দু এর মধ্যে ঢুকতেই নারাজ। অখিল নিয়ে প্রশ্ন শুনে তাঁর মন্তব্য, ‘‘তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন। নিশ্চয়ই জিতবেন।’’ ব্যাপার দেখে তৃণমূল কর্মীদের একাংশই হেসে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দিদি-দাদার চাপে অখিলবাবুকে জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছিল। সে পদের ভার অধিকারীরা কেমন মাথা পেতে নিয়েছেন, গল্প শাসক দলের মুখে মুখে!
আর এই বাজারে সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারের মতো গোল করে ফেলতে ময়দানে রয়েছেন তাপস সিংহ। সিপিএমের প্রাক্তন সর্বভারতীয় যুব সম্পাদক, স্বচ্ছ ও পরিশ্রমী মুখ এবং অধুনা দলের রাজ্য কমিটির সদস্যের মস্ত সুবিধা, তাঁদের ভোটটা হচ্ছে সকলের শেষে। যখন জোটের নামে বাজার দিঘার সৈকতের মতোই সরগরম! লোকে উজিয়ে জানতে চাইছে, জোটের সরকারই আসছে? রামনগরে কে জিতবে, তার চেয়েও বড় চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে সরকারটা গড়তে চলেছে কারা! জোট-প্রার্থীর হয়ে সভা করে গিয়েছেন রাহুল গাঁধী থেকে সূর্যকান্ত মিশ্র। নিজের কেন্দ্রের উন্নয়নে ঠিক কী কী পরিকল্পনা হাতে আছে, তার ঝকঝকে ফোল্ডার ছাপিয়ে আত্মবিশ্বাসী গলায় তাপসবাবু বলতে পারছেন, ‘‘প্রচারে সময় একটু বেশি পেয়েছি। সংগঠনটাকে খানিকটা গোছানো গিয়েছে। মানুষও তৈরি আছেন দুর্নীতির অন্ধকার সরিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক, জোট সরকার নিয়ে আসার জন্য।’’ সোশ্যাল মিডিয়ার দক্ষ টিমও নিরন্তর রসদ জুগিয়ে গিয়েছে জোট-প্রার্থীর প্রচারে।
মুখে জোটের বিপদ উড়িয়ে দিতে চাইলেও শাসক দলকে দেওয়ালে লিখতে হয়েছে ‘বাম-কংগ্রেস অনৈতিক জোটে’র বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আবেদনের কথা। লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যান যদিও বলছে, সে বার রামনগর বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল ৩৪ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল সিপিএমের চেয়ে। আর কংগ্রেস পেয়েছিল আড়াই হাজারের কিছু বেশি ভোট। তার সঙ্গে অখিলবাবুর সংযোজন, ‘‘এগুলো দু’বছর আগের তথ্য। দু’বছরে আমরা আরও কাজ করেছি। উন্নয়ন আর শান্তির কথা বলছি। হারের কথা ভাবব কেন?’’
কিন্তু অঙ্কই যে শেষ কথা বলে না, ভোটের রসায়ন, মানুষের মনেরও অনেক খেলা থাকে— বোঝানোর চেষ্টা করছেন তাপসবাবুর বন্ধু অভিনেতা বাদশা মৈত্র। জনতার জন্য তাঁর সহজ মন্ত্র, ‘‘৩৪ বছরের সরকার ভুল করেছিল বলেই আপনারা দাপটে সরিয়ে দিয়েছেন। এই সরকারের অন্যায় দেখে তাদেরও সরান। নুতন জোট সরকার এসে যদি ভুল করে, তাদেরও একই ভাবে সরাবেন! মাথা উঁচু করে বাঁচতে থাকুন!’’
প্রশ্নটা শেষমেশ এখন তৃণমূলেরও মাথার দিকে! জেলার ১৬-০ টোল খেলে অধিকারী-রাজেরও মাথা ঝুঁকবে। আবার অখিলের তরী সাগর পেরিয়ে গেলে মাথার উপরে চাপটা মেনে নিতে হবে। জটিল ধাঁধাঁ বৈকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy